ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অনন্য বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী

আলমগীর হোসেন | প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ২৯ মে ২০২৪

‘হ্যালো.. বাঙলা। বাংলাদেশ গুড। উই লাভ বাঙলা।’ এ কথাগুলো সরাসরি আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর গোমা শহরে গিয়ে শুনেছিলাম। ২০২১ সালের জুলাই মাসের কথা। ওই সময়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কঙ্গো (মুনস্কো) পরিদর্শনকালে গোমা বিমানবন্দর থেকে এগোতেই দেশটির স্থানীয় মানুষের মুখে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন কথা শুনে মনটা আনন্দে চনমনে হয়ে উঠেছিল। বুকটা গর্বে ভরে ওঠেছিল। এরপর কয়েকদিন সেখানে অবস্থানকালে যেখানেই গিয়েছি, কেবলই বিস্মিত হয়েছি। মনে হচ্ছিল- বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী সদস্যরা স্থানীয়দের সঙ্গে একটি হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ। যেখানে পদচারণা সেখানেই স্থানীয়দের আনন্দ উচ্ছ্বাসিত সাড়া। এমনকি খুব অবাক করেছিল- আফ্রিকার অনেক সাধারণ মানুষ এবং শিশু-কিশোররা বাংলা ভাষায় কথা বলছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি বা বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের জন্য স্থানীয়দের এতো উচ্ছ্বাস ভালোবাসার নেপথ্যের কারণ কি ?

কারণ হিসেবে স্থানীয় আফ্রিকানরা বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অন্যদের চেয়ে আচরণগত দিক থেকে অনেকটাই আলাদা। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা যেমন সন্ত্রাসী গোষ্ঠিদের হাত থেকে সাধারণ-নিরীহ স্থানীয়দের সাহকিতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করে রক্ষা করেন, তেমনি বিপদে-আপদে আমাদের পাশে দাঁড়ান। নিয়মিত চিকিৎসাসেবা, বিনামূল্যে ওষুধ, খাবার, কর্মসংস্থানে সহায়তার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণসহ নানা মানবিক আচার-ব্যবহারে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অনন্য।’

এইসকল বিষয় বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের বিশ্বব্যাপী যে সুনাম ও মর্যাদা তা তাঁদেরই অর্জন করা অনন্য এক সম্পদ। যা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সম্মানজনক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের উচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক গুনাগুনের প্রতিফলন হিসেবে আজ বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ।

গত বছরের মাঝামাঝিতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে গেলে সেখানেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের পেশাদারিত্ব ও মানবিক গুনাবলির ব্যাপক প্রশাংসা শোনা যায় সেখানে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের শান্তিরক্ষী কর্মকর্তাদের মুখে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে মালি মিশন (মিনসুমা) পরিদর্শনে গেলে একজন সাংবাদিক হিসেবে কৌতুহল থেকেই সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছিলাম ওখানকার মিশনে নিয়োজিত ভিনদেশী কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে। সে সময়ে কথা হয় উচ্চ পর্যায়ের অন্যতম একজন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের (মিনসুমা) মালির ‘হেড অব গাও রিজিওনাল অফিস’ মিস. হাওয়া আহমেদ ইউসুফের সঙ্গে। মিস. হাওয়া আহমেদ ইউসুফ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীরা সবসময় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিলে মিশে থাকেন। তাদের সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টগুলো (শান্তিরক্ষী) স্থানীয় জনগণের সঙ্গে খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত (ভেরি ক্লোজ)। অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীরা খুব সহজেই স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। মূলত এসব গুনের কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অন্যদের চেয়ে আলাদা। যা তাদের (বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী) শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনাকে অনেক সহজ করেছে, তেমনি দেশের সুনামও বাড়িয়েছে।’

মালির গাও প্রদেশে সেই সময়ে নিযুক্ত ইস্ট সেক্টর কমান্ডার নেপাল সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হরেন্দ্র পাঠক বলেছিলেন, ‘সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত পেশাদার এবং দায়িত্বশীল। এছাড়া তাদের অনেক মানবিক ও সামজিক কর্মকাণ্ড আছে যা তাদের অনন্য করে তুলেছে।’

ভিনদেশী শীর্ষ শান্তিরক্ষী কর্মকর্তাদের মুখের কথাগুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের শীর্ষ মর্যাদা কিংবা তাদের অনন্য সুনাম তাদেরই কর্মগুনের ফলাফল। এই সুনাম-মর্যাদা ‘কারো’ দয়া বা করুণার ফল নয়। এই অবস্থান বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। বাংলাদেশই অন্যতম একটি দেশ যার শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছরের মিশনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ওঠেনি। বরাবরই জাতিসংঘ প্রশাংসায় ভাসিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে।

অথচ, এমন এক চমৎকার পরিবেশের মাঝেই জার্মান ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’ মনগড়া ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন/ডুকমেন্টরি প্রকাশের মাধ্যমে বলে বসলো, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী! কিন্তু কোনো শান্তিরক্ষী মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেন বা কি বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে অথবা কে ডিডব্লিউ অভিযোগ করলো তার কিছুই নেই সেই প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন একটি সংবাদমাধ্যম কি না তাদের সেই প্রতিবেদনে অন্তত কোনো একটি মিশন এলাকা পরিদর্শনের বর্ণনা বা স্থানীয় কারো মন্তব্য পর্যন্ত নেয়নি বা প্রকাশ করেনি। ফলে এটা যে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। তার আরো একটি কারণ হচ্ছে- ২৯ মে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। এই দিবসটিকে সামনে রেখে ঠিক কয়েকদিন আগে ডয়েচে ভেলের ‘উদ্ভট’ এমন সংবাদের নেপথ্যে ভূরাজনৈতিক কোনো ‘খেলা’ আছে ধারণা করা যায়। হয়তো এতে দেশীয় বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠিরও কোনো মদদ থাকতে পারে। যদি তাই হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক আর হতাশারও বটে। কেননা, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শান্তিরক্ষীদের উপর ‘কলঙ্ক’ বা অপবাদ দেওয়ার অপচেষ্টা কোনো সুস্থ মানসিকতা নয়। ক্ষমতার স্বার্থে রাষ্ট্র বা সশস্ত্র বাহিনীকে হেয় করলে তার ফল কারো জন্যই ভালো হয় না।

তাছাড়াও জানামতে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন এমন একটি বিষয় যেখানে কোনো ধরনের আপোস করা হয় না। অর্থাৎ জাতিসংঘ যখন কোনো দেশকে শান্তিরক্ষী প্রেরণের জন্য চাহিদাপত্র পাঠায় তখন বুঝতে হবে কয়েক ধাপের পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বের দায়িত্ব পালনের বিস্তারিত অভিজ্ঞতা যাচাই করেই কেবল সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। তার মানে দাঁড়ালো কি ? বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সকল পর্যায়ের যাচাই বাছাইয়ে সেরা বলেই এখন অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ।

গত সোমবার গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে এক আয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘শুধু সেনাবাহিনীসহ সামরিক বাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৪৩টি মিশনে আমরা দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমানেও আমাদের ৬ হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো একটি মিশনের উদহারণ দিয়ে কেউ কি বলতে পারবেন যে, আমরা কোনো একটা মিশনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছি ? শুধু আফ্রিকা নয়, আমরা ইউরোপে এবং এশিয়াতেও দায়িত্ব পালন করেছি। কখনও কি আমাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে ? আমরা জাতিসংঘ মিশনে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী প্রেরণ করি তখন নানা ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তিরক্ষীদের প্রস্তুত করি। উচ্চপেশাদারিত্বের মাধ্যমে কয়েকটি বাছাই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে থাকি। অথচ কোনো রকম তথ্য প্রমাণ ছাড়ায় কেউ একটা প্রতিবেদন করে বলার চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে! এটা স্পষ্ট যে, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে এভাবে একপেশে ও পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন করা হয়েছে। তাহলে সেই উদ্দেশ্যটা কি ? আমরা সবাই তা বুঝতে পারছি।’

মোট কথায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুসারে যা যা দায়িত্ব পালন করা দরকার তা শতভাগ করেই এবং অতিরিক্ত নানা মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখনো অনন্য, এখনো সেরা। তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন ইরাক-ইরান যুদ্ধ বিরতির অবস্থায় মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের হয়ে প্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন কর্মকর্তা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী (পর্যবেক্ষক) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। এরপর অচিরেই গোলোযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ। লাল-সবুজের বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সেই মিশন এখন বিশ্বে রোলমডেল।

লেখক: সভাপতি, ডিফেন্স জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিজাব) এবং বার্তা প্রধান, দৈনিক সময়ের আলো।

এইচআর/জেআইএম