ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘নিস’ হামলা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৫:০৫ এএম, ১৭ জুলাই ২০১৬

ফ্রান্সের ‘নিস’ শহরে ১৪ জুলাই (২০১৬) ট্রাক সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইএসের বিরুদ্ধে যেসব দেশ জোট করে হামলা চালাচ্ছে তার জবাব স্বরূপ এই হামলা চালানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যঙ্গচিত্রের পত্রিকা শার্লি এবদোয় হামলা হয়। তার পর নভেম্বরে হামলা হয় প্যারিসে। মুক্তচিন্তা ও নিরাপদ পরিবেশের দেশ ফ্রান্স; ফ্রান্স শিল্প-সাহিত্যের তীর্থভূমি। সেই চেনা ফ্রান্সের সুন্দর ছবিটি গত দেড় বছরে সন্ত্রাস আর আতঙ্কে পাল্টে গেছে।

উল্লেখ্য, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসবিরোধী সামরিক অভিযানে ফ্রান্সের অংশগ্রহণ আছে। তবে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকা-ব্রিটেনের পাশে ছিল না ফ্রান্স। সেসময় ইরাক অভিযান নিয়েও আমেরিকার সঙ্গে ফ্রান্সের তীব্র মতপার্থক্য হয়। এসবের মধ্যে ওসামা-বিন-লাদেন নিহত হয়েছে। আর সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াকে কেন্দ্র করে ‘আইএস’ তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। গত পনের বছরে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন জোটের সেনা সংখ্যা হ্রাস করা হয়েছে। উপরন্তু আমেরিকা নিজেদের ভূ-খণ্ডে নিরাপত্তা-বলয় শক্তিশালী করে তুলেছে। পক্ষান্তরে ফ্রান্স নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শৈথিল্য দেখিয়েছে। বিশেষত রাস্তা ও অলি-গলিতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ, গোপনে তথ্য যাচাই করা, জঙ্গি হানা সম্পর্কে সজাগ থাকা কোনোটিই ফ্রান্স করেনি। এজন্য আইএস জিহাদিদের নতুন লক্ষ্যবস্ত হয়ে উঠেছে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম।

আসলে এক অবাক করা বিপর্যয় এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীকে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে গিয়েছে। আর এই শতাব্দীতে মানুষ যখন মানবতাবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তখনই টুইন টাওয়ার ধ্বংস পৃথিবীর বুকে নতুন সন্ত্রাস ও মানবতাবিরোধী তৎপরতা জানান দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আল-কায়েদা, তালেবান, বোকো হারাম, আল-সাবাহ এবং সর্বশেষ আইএস জঙ্গিদের বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে। ১৪ জুলাই ‘নিস’ হামলা স্মরণ করিয়ে দিল সমস্যাটি বৈশ্বিক এবং সম্মিলিতভাবেই এর মোকাবিলা করা জরুরি। এজন্য ১৫ জুলাই মঙ্গোলিয়ার উলানবাটরে একাদশ এশিয়া-ইউরোপ (এএসইএম) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানকারী বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এ ধরনের হামলা প্রতিরোধে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে অবস্থানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তায় বলেছেন, ‘সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ বরাবরের মতোই ফ্রান্সের জনগণের পাশে রয়েছে।’ ‘নিসে’র এ ট্র্যাজেডি এমন সময় ঘটল যখন বাংলাদেশ শোকে স্তব্ধ। কারণ ১২ দিন আগে ১ জুলাই গুলশান হত্যাকাণ্ডে ১৭ জন বিদেশিসহ ২০জনকে নির্মমভাবে খুন করা হয়।

ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ‘নিসে’ বাস্তিল দিবসের আতশবাজি উৎসবে জড়ো হওয়া মানুষের ওপর দ্রুতগতিতে ট্রাক চালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় নিহত হয়েছেন শিশুসহ অন্তত ৮৪ জন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। আহতদের মধ্যে ৫০ জনের অবস্থা গুরুতর। ১৪ জুলাই রাতের এ হামলায় চালক তিউনিশিয়া বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক মোহাম্মদ লাহোইজেই বুহেলকে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে ট্রাক থামায়। ওই শহরের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আতশবাজি পোড়ানো দেখছিলেন বলে জানা গেছে। সাড়ে তিন লাখ অধিবাসীর শহর ‘নিস’ পর্যটন ও জাঁকজমকপূর্ণ রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি এ শহরের বেশ কয়েকজন মুসলিম অধিবাসী ইউরোপের অন্য দেশ হয়ে সিরিয়া গেছে। তারা আইএসে যোগ দিতে পারে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, জনসমাবেশে ট্রাক তুলে দিয়ে মানুষ হত্যার এই ঘটনা বৈশ্বিক জঙ্গিবাদেরই নতুন মাত্রা। গত বছর (২০১৫) ১৩ নভেম্বর প্যারিসের হামলায় তিনটি দল আলাদাভাবে কাজ করছিল বলে জানিয়েছে তদন্তকারীরা। একজন হামলাকারী প্যারিসেরই একটি শহরতলীর বাসিন্দা, যার বিরুদ্ধে আগেও অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আরেকজন হামলাকারীর কাছে সিরিয়ার পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। ওই হামলায় নিহতরা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল।

চলতি বছর ১৪ জুলাই ‘নিস’ এবং গত বছর ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের যে এলাকায় সর্ব শ্রেণির মানুষ এবং প্রগতিশীল তরুণ ও মধ্যবিত্তের সমাবেশ হয় সে জায়গায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়- এটা মনে রাখা দরকার। কারণ একইভাবে আমাদের দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ওপর আঘাত এসেছে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার মধ্য দিয়ে। প্যারিসের প্রথম ঘটনাটি ঘটে শহরের কেন্দ্রস্থলে বাটাক্লঁ কনসার্ট হলে। কনসার্ট দেখতে ওই হলে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। অন্তত তিন হামলাকারী কনসার্ট হলে ঢুকে কালাশনিকভের মতো দেখতে রাইফেল বের করে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। পরে হামলাকারীরা ওই হলে অনেককে জিম্মি করে ফেলে। ওইদিন প্যারিসের ছয়টি স্থানে বোমা হামলা হয়। তবে হামলার ঘটনায় আট হামলাকারী নিহত হয়। তাদের মধ্যে সাতজন ছিল আত্মঘাতী। বাটাক্লঁ কনসার্ট হলেই নিহত হয় চার হামলাকারী। তাদের মধ্যে তিনজন নিজেদের সঙ্গে রাখা বোমায় আত্মঘাতী হয়। আর একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। তিনজন হামলাকারীর মৃত্যু হয়েছে জাতীয় স্টেডিয়ামের কাছে। আর একজন প্যারিসের রাস্তায় গুলিতে নিহত হয়েছে। আর হামলাকারীদের আক্রমণে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ১৫০-এর অধিক তাজা প্রাণ, আহত হয় দু’শর অধিক। গুলি চালাতে চালাতে হামলাকারীদের জিহাদি স্লোগান দিতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা বলেছে, ‘তোমরা আমাদের সিরিয়ায় যেভাবে হামলা চালাচ্ছ, তার জন্য তোমাদের তো এ মূল্য দিতেই হবে।’

গত জানুয়ারিতে শার্লি এবডো কার্টুন ম্যাগাজিনে হামলার পর প্রশ্ন উঠেছিল- প্যারিস এখন কতটা নিরাপদ। তবে এই প্রশ্ন সত্ত্বেও প্যারিস নিয়ে কিন্তু মানুষ আতঙ্কে ভোগেনি। সেবারের হামলার লক্ষ্য ছিল কার্টুনিস্টরা, ইহুদীরা। সাধারণ মানুষ তখন এই ভেবে নিজেদের নিরাপদ মনে করেছে যে হামলাকারীরা যাকে-তাকে টার্গেট করছে না, সুতরাং তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ‘প্যারিস’ ও ‘নিসে’র ঘটনা সব বদলে দিয়েছে। বাগদাদ কিংবা বৈরুতের রাস্তায় যে হামলা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেই হামলা প্রত্যক্ষ করেছে ফ্রান্স। এর আগে শার্লি এবডোতে হামলার পর দশ লক্ষ মানুষ প্যারিসের রাস্তায় মিছিল করে এর প্রতিবাদ জানায় এবং শার্লি এবডোর কার্টুনিস্টদের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু এখন প্রতিটি মানুষই যখন হামলার সম্ভাব্য টার্গেট, তখন কে কার সঙ্গে সংহতি জানাবে?


বিশ্বব্যাপী মানুষ হত্যার ‘মচ্ছব’ চলছে। চলতি বছর (২০১৬) জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্দুক হামলায় ফ্লোরিডার একটি সমকামীদের নাইটক্লাবে ৫০ জন নিহত এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। হামলাকারী আফগান বংশোদ্ভূত ওমর মতিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। একই মাসে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে বন্দুক ও বোমা হামলা চালিয়ে ৪১ জনকে হত্যা ও ২৩৯ জনকে আহত করা হয়েছে। ৪ জুলাই জেদ্দায় আত্মঘাতী হামলা চালানোর পর সন্ধ্যায় মদিনায় পবিত্র মসজিদে নববী আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। এতে মসজিদে নববীর চারজন নিরাপত্তা রক্ষী ও হামলাকারী নিহত হয়। একই সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় কাতিফ শহরের একটি সিয়া মসজিদেও আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। এতে হামলাকারী মারা যায়। গত ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ হাজারের মতো। এসময় বাংলাদেশে গ্রেনেড হামলা(২০০৪) হয়েছে এবং সিরিজ বোমায়(২০০৫) কেঁপে উঠেছিল সমগ্র দেশ।

ভারতের ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। সেদিন ওই শহরের তাজ হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে ১০টিরও বেশি ধারাবাহিক গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০৮ জন আহত হন। হামলাকারী জঙ্গিরা ছিল পাকিস্তানি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার সদস্য। মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা এশিয়াজুড়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সক্ষমতার একটি চিত্র তুলে আনে। ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ে মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হন ৫২ জন। আহত হন ৭ শতাধিক মানুষ। ব্রিটেনের মাটিতে এটাই ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। লন্ডনে বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ ছিল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে নিহত হয়েছে ১৩০-এর বেশি শিক্ষার্থী। নিহত শিক্ষার্থীদের বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। জঙ্গি হামলায় একই বয়সী আরও অন্তত ১২০ জনের বেশি স্কুলশিশু আহত হয়।

বিশ্বব্যাপী চলা সন্ত্রাসবাদের মধ্যে এটি ছিল ভয়ঙ্করতম। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান এ হামলার দায় স্বীকার করে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লেবাননের বৈরুতে বেশকিছু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে আল-কায়েদা সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। এসব ঘটনায় অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। লেবানন জুড়েই আইএসের তাণ্ডব চলছে। সর্বশেষ বৈরুতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়। দক্ষিণ বৈরুতের শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় গত ১১ নভেম্বর(২০১৫) ৪৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হন। লেবাননে এই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট। শিয়া হওয়ার কারণেই এখানকার মানুষ আইএসের টার্গেট হয়েছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে তাদের বিমান হামলায় জঙ্গি সংগঠন আইএসের জল্লাদ হিসেবে খ্যাত ‘জিহাদি জন’ নিহত হয়েছে।

‘নিসে’র মতো প্যারিস হামলার পরপরই আইএস এর দায় স্বীকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ওই হামলার পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি বাইরে থেকে করা হলেও ফ্রান্সের ভিতর থেকেও সন্ত্রাসীরা সহায়তা পেয়েছিল। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি মুসলিম(৭.৫ শতাংশ) জনগোষ্ঠী বাস করলেও একথা ঠিক সকল মুসলমান এসব জঙ্গিবাদী ধারণাকে লালন করে না। আর আইএসের ভয়ে যারা সিরিয়া কিংবা ইরাক ও লেবানন থেকে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে এসেছে ইউরোপে তারা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সমর্থন জানিয়ে সন্ত্রাসীদের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে থাকবে না। এজন্য ফ্রান্সকে অবশ্যই নির্বিশেষ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দোষী করা থেকে বিরত থাকতে হবে।  সেখানে তিউনিশিয়া, আলজেরিয়ার মতো মুসলিম দেশের দরিদ্র অভিবাসী রয়েছে। এই মুসলিমদের একটি অংশ চাকরি থেকে শুরু করে নানা অর্থনৈতিক-সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে আছে। এদের মধ্যে সহজে জিহাদি মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে আইএস। ফরাসি সরকারের কাছে সমাজ-বিচ্ছিন্ন যুবক-যুবতীদের মধ্যে জিহাদি ধারণা কীভাবে বিস্তার লাভ করেছে তার সম্পর্কে তথ্য ছিল বলে মনে হয় না। অথচ ২০১৪ সাল থেকে ইউরোপের প্রায় ছয় হাজার জিহাদি সিরিয়ায় গেছে। ফ্রান্সের ওই যুব সমাজের একটি বড় অংশ জিহাদে যোগ দেয়। তাছাড়া স্থানীয় স্তরে সমর্থন আছে জঙ্গিগোষ্ঠীর। কিন্তু তৃণমূল স্তরের সঙ্গে ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ভাল যোগাযোগ না থাকায় হামলা সম্পর্কে আগাম তথ্য পায়নি তারা। এমনকি গত বছর নভেম্বরে প্যারিস হামলার অন্যতম চক্রী সালাহ আবদেল সালামকে ধরতে প্রায় ছয় মাস লাগে। কারণ ব্রাসেলসের যে আস্তানা থেকে তাকে ধরা হয়েছে, তার কয়েকটি বাড়ি পরেই আবদেল সালামের মূল বাড়ি। স্থানীয় সমর্থন ছিল বলেই গোয়েন্দাদের সক্রিয়তা সত্ত্বেও সে লুকিয়ে থাকতে সক্ষম হয়।

১৬ জুলাই কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, শার্লি এবদোর ঘটনার পর সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে ফ্রান্স যতটা তৎপরতা দেখিয়েছে, নিজের ঘরের খবর রাখতে সেভাবে উদ্যোগী হয়নি। ফলে নভেম্বরে আবার হামলা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া, বিচ্ছিন্ন স্তর থেকে জিহাদিরা উঠে এসেছে। জিহাদি হওয়ার আগে ছোটখাটো অপরাধে যুক্ত ছিল তারা। শার্লি এবদো নিয়ে পথে নেমেছিল ফ্রান্স। আবারও নামবে। হয়তো ইরাক, সিরিয়ায় বিমান হানা বাড়বে। কিন্তু নিজের ঘরের দিকে চোখ ফেরানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সমাজ-বিচ্ছিন্ন যুবক-যুবতীদের আবার মূল স্রোতে ফেরাতে না পারলে, সহানুভূতির সঙ্গে তাদের অভাব-অভিযোগ না জানতে পারলে এদের মন থেকে জিহাদের ছায়া সরানো সহজ নয়। এ ধরনের হামলার আশঙ্কা থেকেই যাবে।’

আসলে জনগণের জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য জঙ্গিবাদের শ্বাসরোধ করতে জঙ্গিদের অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে। কারণ অর্থ আর জঙ্গিবাদ হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অর্থই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক, অর্থই জঙ্গিবাদের শক্তি আর এই অর্থই জঙ্গিবাদের অক্সিজেন। জঙ্গিবাদকে রুখতে হলে এই অক্সিজেনের সরবরাহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শকে নির্মূল করার জন্য অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ ও অর্থ জালিয়াতি বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মানের আইন তৈরি করতে হবে সকল দেশে। সেই আইন অনুসারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারকরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্মূল হবে। অবশ্য তার আগে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে থাকতে হবে। নিজের দেশের মাটিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানো কঠিন করে ফেলতে হবে। যেমন, শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের মাটিতে কাজ চালানো সন্ত্রাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।

প্রকৃতপ্রস্তাবে বৈশ্বিক সন্ত্রাস নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। আবার সন্ত্রাস দমনে প্রচলিত আইনগুলোকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ধরন দ্রুত পাল্টানোর ফলে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের(এফএটিএফ) মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। ইন্টারনেট ভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত আইন প্রয়োগ করতে হবে। কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে সাক্ষ্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে সকল দেশে গৃহীত হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গি দমনে  সংগঠনগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদে অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া প্রস্তাবও আইনে পরিণত করতে হবে; যা বাংলাদেশে করা হয়েছে।  

বিশ্বের সকল গণমাধ্যমের জঙ্গিবিরোধী অবস্থান এবং যে কোনো দেশের যে কোনো সরকারের ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ আইন প্রণয়ন বিশ্বের মানুষকে আশাবাদী করে তুলবে। কারণ ইসলাম পবিত্র ধর্ম, এই ধর্মের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি এর পবিত্রতা নষ্ট করে ‘নিসে’র মতো জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সরকারের এই সদিচ্ছাকে সমর্থন দিতে হবে যে কোনো দেশের সকল গণমাধ্যমকে। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বিশ্ববাসীর দায়িত্ব। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সরকার ও গণমাধ্যমকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ‘নিসে’র ঘটনা থেকে আমরা সেই শিক্ষাই লাভ করেছি।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন