ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হতাশা : এক নিদারুণ বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ২২ জুন ২০১৭

দুঃখে ভেঙে পড়া বা থমকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সে তুলনায় ‘সুখে আছি’ বলতে পারা মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছেই। যদিও জীবনে সুখী হতে গেলে দুঃখকে জয় করেই তা অর্জন করতে হয়। যিনি তার চলার পথে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশের জের ধরে অপ্রাপ্তির ছোঁয়া কে ছায়া বানিয়ে নিজের কায়াকে পরিশ্রান্ত করে তুলবেন তিনি সহজেই হতাশার চোরাবালিতে তলিয়ে যাবেন। বের হওয়ার উপায় সেখানে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

এটা ঠিক যে, আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে অধিকাংশ মানুষই নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যান। জীবনে নানা টানাপোড়েনের সাথে মানিয়ে নিয়েই আমাদেরকে চলতে হয়। নিত্য এই মানিয়ে চলতে গিয়েই নিজের অজান্তেই  হয়ত আমরা হাঁপিয়ে উঠি। ফলে এক সময় হতাশা ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধে। যার মূলে শুধু ব্যক্তি নয়; পরিবার , সমাজ এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।  বেকার, পেশাজীবী, ছাত্র কিংবা চাকরিজীবী— যে কারো সাথেই কথা বললেই দেখা যায় তাদের ভেতরে একধরনের হতাশা আছে। হতাশার ধরন এবং ধারণে হয়ত পার্থক্য আছে সেখানে।  কিন্তু হতাশা, অল্প স্বল্প যেমনই হোক না কেন- সেটা যে আছে সহজেই তা বোঝা যায়। হতাশা নামক এ অসুখ  সমাজে আজ এমন ভয়াবহরূপে বিদ্যমান ভাবলেই অবাক হতে হয়।

আমাদের উদ্বিগ্নতা শুরু হয় সকাল ঘুম থেকে উঠেই। মোটামুটিভাবে সকালের খাবার খেয়ে রেডি হয়ে রাস্তায় নামতেই শুরু হয় মানসিক অস্থিরতা। সেই সাথে বিরক্তি। দিনশেষে আসে একরাশ হতাশা। কারণ বাস, রিক্সা, সিএনজি বা টেম্পো যাই হোক না কেন তা ঠিকঠাক পেয়ে তাতে করে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারা বা না পারার টেনশন দিয়ে যে দিনের শুরু হয় তা শেষও হয় একইভাবে। পারিবারিক টানাপোড়েনের রকমফের,  অফিসে কাজের চাপ আর পথের এ বিরক্তিকর ঝামেলা— সবকিছু মিলেমিশে জীবনকে যখন  প্রতিনিয়ত অস্থির করে তোলে তখন হতাশা আসে বৈকি। নানা রকম পরীক্ষা বা ক্লাস টেস্ট নিয়ে থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বিগ্নতা। আর বেকার জীবনে থাকে চিরাচরিতভাবে চাকরি জোগাড়ের নানা ধান্দা ফিকির। হতাশা নেই কোথায়?

চাকরি বাকরি এবং সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবা-মায়ের সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় থাকেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। একদম ক্লাস ওয়ানে ভর্তি নামক এক অসহায় যুদ্ধ দিয়ে যার শুরু। তারপর জিপিএ ৫ পাবে কিনা! জিপিএ ৫ পেলেও সেটা গোল্ডেন হবে কিনা!  তারপর আছে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা নামক বিষময় পদ্ধতি। তার আগে কোচিং এ ভর্তির ব্যাপার থাকে। সেই সাথে চলে টাকার শ্রাদ্ধ। দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে, অপরিচিত এ জায়গাসমূহে ছুটে ছুটে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ছেলে-মেয়েকে পাঠানোর এক কঠিন অনিশ্চয়তাভরা উদ্বিগ্নতা। ছেলেরা তবুও কিছুটা ঘুরেঘুরে পরীক্ষা দিতে পারে। মেয়েরা তাও পারে না।
তারপর কোনমতে ভর্তি হয়ে গেলে শুরু হয় রাজনীতি নামক আর এক জটিল  অংকের দৃশ্য। হলে সিট পেতে সমস্যা। বড় ভাই জিন্দাবাদ না বললে সিট মেলে না অধিকাংশ সময়ই। সিট পেলেই কি সব হয়ে গেলো? না হলো না। কারণ এরপরও অনিশ্চয়তা আছে। সেটা হচ্ছে আচমকা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণে মারা পড়ার সদা উদ্বিগ্নতা।

এবার পড়াশুনা তো শেষ হলো। আসুন চাকরির বাজারে। চাকরির বাজারে প্রশ্নপত্র ফাঁস  ( এ আর নতুন কি!এখন তো প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষা থেকে প্রশ্নফাঁস শুরু হয়!)  থেকে শুরু করে মামু-খালুদের অবাধ দৌরাত্ম্য। এমন মামু খালুদের পেতে হলে পকেটে নাকি টাকা থাকা লাগে! প্রবাদ আছে, টাকা থাকলে নাকি বাঘের দুধ মেলে। চাকরির বাজারেও শোনা যায় নাকি টাকা দিলে বাঘের দুধের মতো পছন্দমতো চাকরিও মেলে। আর সে জোর না থাকলে ঘুরতেই থাকো। পরীক্ষা দিতেই থাকো। কপাল ভালো হলে চাকরি মিলতেও পারে। এমনই অনিশ্চয়তা! ফলে দিনে দিনে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তাদের ভেতরে হতাশাও তেমনিভাবেই বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে এই যে ভাংচুর, দলাদলি, গালাগালি আর কানাগলি- এ সবই হচ্ছে উচ্চমাত্রার হতাশা নামক বিষের বহিঃপ্রকাশ; রাজনীতি যেখানে উপলক্ষমাত্র। আর তরুণরা হচ্ছে তার হাতিয়ার।

এখন তো আবার নতুনকরে শুরু হয়েছে জঙ্গিবাদ নামক এক ভয়াবহ সমস্যা। সন্তান আবার সেদিকে পা বাড়ালো না তো!এটা নিয়ে  ভেতরে ভেতরে সবাই উদ্বিগ্ন। সাথে আছে মাদকের হাতছানি। এত এত চিন্তা!! সবকিছু তো আর মনের মতো করে চলে না। নিজের হাতেও তো অনেক সময় করার মতোও  তেমন কিছুই থাকে না। ফলে উদ্বিগ্নতা একসময় হতাশায় পরিণত হয়। এগুলোর  অধিকাংশই ব্যক্তি নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে সমস্যার সমাধান না হলে  তা ব্যক্তি জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ফলে একসময় সে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ব্যক্তি নিজে নিজে হয়ত মুক্তির উপায় খোঁজে ঠিকই কিন্তু তাতে কি আর সমাধান মেলে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১২১ মিলিয়ন বা ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ কোন না কোনভাবে হতাশাগ্রস্ত। যদিও তাদের মধ্যে মাত্র ২৫%  এর কম মানুষ চিকিৎসা সেবার আওতায় আসার সুযোগ পায়।তাহলে বাদ বাকি ৭৫% মানুষ মানসিক এ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ভেবে দেখুন কি ভয়াবহ ব্যাপার এটা! কিন্তু এ হতাশার কারণ কি? গবেষণা বলছে, আমরা ঠিক কেন হতাশায় নিমজ্জিত হই তার কারণ এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বলা হয়ে থাকে যে, বংশগত এবং পরিবেশগত কারণে মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়। পরিবেশগত কারণের মধ্যে উপরে যে বিষয়গুলোর উল্লেখ করেছি তার সাথে রয়েছে অশিক্ষা, দারিদ্র, চাকরির অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। যদিও তারুণ্যের হতাশার কারণ হিসেবে প্রেম প্রত্যাখ্যাত হওয়া, খারাপ ফলাফল, প্রেমের সম্পর্কে ফাটল ইত্যাদি বিষয়গুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জীবনে হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ থাকবেই। নিরন্তর প্রবহমান সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। তাই কোন কিছু নিয়ে  চূড়ান্তভাবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া অহেতুক ভাবনা যেমন আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না—এ জাতীয় চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।  বিশ্বাস রাখতে হবে আমি পারি এবং পারবোই। আর সমাজ এবং রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে এক্ষেত্রে। সমস্যার সমাধানে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কি পরিমাণে তরুণ বা যুবক  প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে সেটা মাথায় রেখে কর্মমুখি শিক্ষা চালুসহ নানা সেক্টরে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাহলে চাকরির জন্য তরুণ প্রজন্ম সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকবে না। যা করার তা নিজেরোই করে নিতে পারবে। ফলে তারা হতাশার হাত থেকে রেহাই পাবে।

পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন, দুঃখ যত শক্তিশালী হয়েই আসুক না কেন, হতাশার অনুষঙ্গ যত গাঢ় হয়েই দেখা দিক না কেন হাল ছাড়া যাবে না এক মুহূর্তের জন্যও। দুঃখ আর হতাশায় মুষঢ়ে না পড়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে বীর সৈনিকের সম কাতারে দাঁড়াতে হবে। মনোবল অটুট রেখে সামনে এগিয়ে গেলেই এক সময় হতাশার বৃত্তবন্দী জীবন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কোন ব্যাপারই না।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন