ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একটি রেনেসাঁর অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৪:০৫ এএম, ৩০ জুন ২০১৭

অস্বীকারের জো নেই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে একটি তাৎপর্যময় পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হবার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে তার জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি জাতীয় দায়মুক্তির। অন্যথায় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় জীবনের সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার দোসর হয়ে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছে, নির্বিচার হত্যা ও নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, অপহরণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে লাখো নিরস্ত্র মানুষকে, সেই সব শীর্ষ অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজটিও ছিল আরেক ঐতিহাসিক দায়মুক্তির। এ রকম দুটি ঘটনা, তাও আবার দুই যুগের সামরিক ও আধা-সামরিক অপশাসনের পর এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমাজ বহুলাংশে বিভাজিত ও কলুষিত হবার পর, কেবল বড় সাফল্যই নয়, একই সঙ্গে জাতীয় জীবনের জন্যেও তাৎপর্যপূর্ণ । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই বড় কাজ দুটির সম্পাদনই কি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে সুরক্ষা দান করবে? এতেই কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রাপথ কণ্টকহীন হবে?

আমার বিশ্বাস- না। এই দুই কাজের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সামনে এগোবার সিঁড়ি ফিরে পেয়েছে মাত্র, সে সিঁড়ি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল একদিন। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়। লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় সফলতার যাত্রা গতি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সে কারণেই আমার বিশ্বাস যে, বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের যাত্রাপথ অবারিত করতে প্রয়োজন একটি নতুন রেনেসাঁ, একটি নবজাগৃতি, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক নবজাগরণ, যা জাতিধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিকে আবারও এক করবে, সাম্প্রদায়িকতার গ্রাস থেকে মুক্ত করবে, মানবিক করবে, স্লোগানের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যুবতারুণ্যকে মানুষ করবে, বাঙালি করবে।

উনিশ শতকের বাংলায় রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বিশ শতকের প্রথমার্থে যা শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের হাতে। যদিও সে রেনেসাঁর কুশিলবরা সকলেই ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী, তবুও ঔপনিবেসিক সময়ের বিচেনায় সংস্কার হয়েছে বোধ ও বুদ্ধির, জেগে উঠেছে মানুষ কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে, নবযাত্রা শুরু হয়েছে মঙ্গলের পথে। নবজাগৃতির সেই অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী, বিজ্ঞানীসহ প্রায় সকল শ্রেণির সাহসী মানুষেরা। আমার বিশ্বাস আজকের বাংলাদেশেও একটি নবজাগরণ প্রয়োজন, যা এগিয়ে নেবে মানুষকে সত্যের পথে, কল্যাণের পথে।

কেন এই রেনেসাঁ?
ইতিহাসের সত্য অনুধাবন করা জরুরি যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যা সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে এক করে জাতীয় স্বাধীনতার ময়দানে নামিয়েছিল, তা ছিল এই জনপদের এক নবজাগৃতি। ১৯৪৭ এর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জোরদার তত্ত্বকে অস্বীকার করে নতুন এই নবজাগরণ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে একাত্ম করেছিল, মানুষ করেছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ ধরেই সেদিনের জাগৃতি বিকশিত হয়েছিল, তথাপি অনস্বীকার্য যে তাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল বাংলার আবহমান সংস্কৃতি শক্তি- যার ভিত্তিমূলে লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্ত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানি ঔপনিবেসিক শাসকদের হটিয়ে পূর্ববঙ্গের একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিলো না, একই সঙ্গে ছিল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই ভূখণ্ডের অধিকারহীন মানুষের মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু সে স্বপ্নপূরণ হয়নি। পাল্টা আঘাত এসেছে। পরিকল্পিত পন্থায় তাকে অকার্যকর করা হয়েছে, সাতচল্লিশের দৈত্য একাত্তরের চেতনাকে অনেকটাই পর্যুদস্থ করেছে, পরিকল্পিত পন্থায় কূপমণ্ডুকতার পুনরাভিযান ঘটানো হয়েছে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, জাতীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে, এমনকি সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রধর্মবাদের পুনরাভিযান নিষ্কণ্টক করা হয়েছে।

১৯৭১, ১৯৭৫ এবং বিগত কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করে আমার মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পুনরুদ্ধারকৃত চেতনার নবযাত্রাকে নিষ্কণ্টক করতে হলে রাজনীতির নতুন কুশীলবদের আদর্শিক বা সাংস্কৃতিকভাবে সশস্ত্র হতে হবে। অনুধাবন করতে হবে যে, পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে যে শত্রু ছিল চিহিৃত এবং দূরের, তারা বেশির ভাগই আজ অচিহ্নিত ও কাছের। অতএব অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক করতে হবে। সে কারণেই প্রয়োজন আদর্শিক ও ত্যাগী কর্মী, যারা বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলাকে কেবল কণ্ঠে নয়, আত্মায় ধারণ করার সামর্থ্য অর্জন করবেন।

আমার মনে হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারের বার কয়েক অধিষ্ঠান স্বত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে কম নয়। বরং এই চ্যালেঞ্জ আজ নতুন আঙ্গিকে, নতুন মাত্রায় সমাসীন। এই চ্যালেঞ্জ যেমন রাজনৈতিক, তেমনি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। অস্বাভাবিক নয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিপক্ষরা কিছুতেই এ রাষ্ট্রকে স্থীতিশীল দেখতে চাইবে না; গজিয়ে ওঠা ‘নব্য পাকিস্তানিরা’ লক্ষ শহীদের রক্তে গড়া বাংলাদেশকে ব্যর্থ করতে চাইবে; তারা একাত্তরের পরাজয়ের শোধ নিতে চাইবে। কাজেই প্রয়োজন সতর্কতার; প্রয়োজন নবজাগৃতির যে ডাক তাকে এগিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনের মধ্যে আরও দুটি বড় অর্জন সম্পাদন করেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। পাকিস্তানি গণহত্যার শুরুর দিন ২৫ মার্চকে তারা ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করেছে। জাতীয় ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য গুলিকে প্রতিরক্ষা দিতে জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে, যা ইতিহাস অস্বীকারের মতো অপরাধ দমনে বড় ভূমিকা রাখবে। এই কাজগুলো হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানকে যেমন সচকিত করেছে, তেমনি আতঙ্কিত করেছে এই জনপদের পুনর্জাগরিত ধর্মীয় রাজনীতির প্রবক্তাদের, যারা বিগত সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনামলের বদলৌতে নিজেদের সুসংগঠিত করেছে। কাজেই নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা শুরু হয় ২৫ মার্চ, ১৯৭১। ১৯৭০ এর নির্বাচনী রায় অস্বীকার করতে বাঙালি নিধনের স্পষ্ট লক্ষ নিয়ে রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে সামরিক অভিযান চালানো হয় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও সাবেক ইপিআর-এর সদর দপ্তর পিলখানায়। এরপর ঘাতক সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এটা ছিল কেবলই শুরু, এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং কমপক্ষে এ সময় কেবলমাত্র ঢাকাতেই ৩০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামেরও অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে যায়। বলতে গেলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানেই মানুষ পালাতে থাকে প্রাণ ভয়ে। নাৎসিরা যেভাবে ইহুদি পুরুষদের বর্বরভাবে হত্যা করেছে, তেমনি বাঙালি তরুণদের নিধন করা হয়েছে ১৯৭১ সালে। মৃত্যু উপত্যকা সৃষ্টি করা হয়েছিল গোটা বাংলাদেশকে। বাঙালি মেয়েরা ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে যত্রতত্র। চালানো হয়েছে দলগত পাশবিক ধর্ষণ ও পীড়ন। পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের তুলনা করা হয়েছে জাপানি সৈন্যদের হাতে নানজিং ও জার্মানদের হাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় সংগঠিত ঘটনাবলির সঙ্গে।

বলাই বাহুল্য, মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এসব অপরাধের মূল সহযোগী ছিল বাঙালি ও অবাঙালি রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও পিস কমিটির নামে সংগঠিত স্থানীয় পাকিস্তানপন্থীরা। মোটকথা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই গণহত্যা বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর এক হত্যাযজ্ঞ। রুয়ান্ডায় যে ৮ লক্ষ মারা গেছে, এমনকি ১৯৬৫-৬৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ১০ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ মারা গিয়েছিল, সম্ভবত তারও চেয়ে বেশি। ২৬৭ দিনের মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অবিশ্বাস্য।

আরও একটি সত্যকে গ্রহণ করলে সত্যের প্রতি সুবিচার করা হবে। একাত্তরের ঘাতক ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকলেও চেতনার অমিল আছে মনে করার কোনো কারণ নেই। একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতক ও তাদের সমর্থকরা চিন্তা ও চেতনায় অভিন্ন। এরা সাতচল্লিশের চেতনাধারী, একাত্তর তাদের কাছে পরাজয়ের গ্লানি বহনকারী দুঃস্বপ্ন মাত্র, যাকে তারা ধুয়ে-মুছে দিতে চায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গ এলে অবধারিত ভাবেই শেখ হাসিনার কথা আসে। প্রায় ছয় বছর বিদেশ নির্বাসনের পর শেখ হাসিনা দেশের মাটিতে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। তাঁর সেই স্বদেশ ফেরা বাংলাদেশের মাটিতে নতুন যুগের সূচনা করে। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে তাঁরই কন্যাকে অভ্যর্থনা জানাতে সেদিন ঢাকা বিমানবন্দরে এসে জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ, যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছে, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছে।

অতএব শেখ হাসিনার এই স্বদেশ ফেরার মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক অভিযাত্রা আছে, অনেক বেদনার মাঝেও আরেক বিজয় আছে। জেনারেল জিয়াউর, রহমান জেনারেল এরশাদের শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও একাত্তরের ইতিহাস ও চেতনাকে আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে। কাজেই শেখ হাসিনার সামনে ছিল বড় দায়িত্ব। দলকে সংগঠিত করা, ঘাতক ব্যষ্টিত শাসককূলের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ সৃষ্টি করা, লুণ্ঠিত গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সৃষ্ট বাংলাদেশকে স্বমহীমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে জনপ্রত্যাশা সেদিন যেমন আজও প্রায় তেমনিই অপরিসীম - এতোটাই যে বেশিরভাগ মানুষই যেন ভুলতে বসেন যে কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনায়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করার চেষ্টা হয়েছিল! কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি; প্রবল প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও তিনি ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে ফিরিয়ে আনেন, সবটা না হলেও অনেকটাই। ১৯৮১ থেকে ২০১৭। বাংলাদেশ আজ তার আগের চেহারায় নেই। কয়েক যুগ ধরে পরিকল্পিত পন্থায় যে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল বাঙালির ইতিহাস ও চেতনার ওপর, মুক্তিবুদ্ধির ওপর, সংস্কৃতির ওপর, তার বিপরীতে আজকের অর্জন মোটেও কম ভাবার কারণ নেই। এরপরও মানতেই হবে যে, বাংলাদেশ বিরোধীরা হাল ছেড়ে দেয়নি, তারাও শক্তিশালী হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুবাদে কট্টর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরা আজ নানা আঙ্গিকে প্রস্তুত; রাষ্ট্রের বিরোধীরা নানা ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ।

আমি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যতোটা দেখি তার চাইতেও বেশি দেখি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিনি রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার যুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর দুই যুগের যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তার বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহস ও প্রজ্ঞা সে কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য।

আমার বিশ্বাস, বহুবিধ প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার পরও একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ভয়ংকর এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। কাজেই বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে। প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি মহলের প্রতিরোধ স্বত্ত্বেও এগিয়ে যেতে হয়েছে। এ সাহস ও যৌগ্যতাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

সকলেই জানি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকারবিরোধীদের স্বাধীন কার্যক্রম জরুরি। এছাড়া রাষ্ট্র আধুনিক হয় না, মানবিক হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সমন্বয়ে যে মোর্চা তারা রাষ্ট্রের মৌলিক ইতিহাস ও চেতনার পরীক্ষিত প্রতিপক্ষ এবং প্রতিপক্ষ তারা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের, রাষ্ট্রের ইতিহাসের। কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত, যে বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতার প্রাপ্তিকে ছিনতাই করা হয়, যে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয় সাতচল্লিশের চেতনায়, সেই বাংলাদেশের হৃতগৌরব উদ্ধারে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী নেতৃত্ব ইতিহাসের নতুন আশীর্বাদ বৈকি।

কিন্তু এই যুদ্ধকে কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শ চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে; মনে রাখতে হবে যে ধর্মান্ধ অপশক্তির সঙ্গে আপোস করার মতো ভুল আত্মঘাতী হবে। ভুললে চলবে না যে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শতত্রুরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে। কাজেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রাষ্ট্র ও সমাজকে অগ্রসর করে, মুক্ত করে। রাজনীতিতে যদি ধর্মের ব্যবহার ঘটানো হয় তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ বিপন্ন হয়, এমনকি ককুষিত হয় ধর্মও। এ প্রবণতা সুস্থ সমাজ ধারাকে বিঘ্নিত করে, সহমর্মীতা ও পারস্পরকি সৌহার্দ্য বিপন্ন করে। কাজেই এর থেকে নিস্তার পাওয়া জরুরি। কাজেই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার রোধ একটি অপরিহার্য নাগরিক দায়িত্ব। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি কোনো সমাজের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনেনি। পাকিস্তানি শাসকরা সেটিই করেছিল কিন্তু ফল শুভ হয়নি। বাঙালি জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ করেছে, বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র হয়েছে।

ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মের গুরুত্ব বজায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় সকলের সমান সুযোগ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম বিরোধিতা নয় ; কারণ ধর্ম রাষ্ট্রের হয় না, হয় ব্যক্তির। আমার আরও দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমাদের জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেক্যুলারিজমের ভিত্তির ওপরই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা রাখতে হবে। কথা হচ্ছে, কীভাবে এই সংকটের মোকাবিলা করা যাবে? ধর্ম যে মানুষের ব্যক্তিক চর্চার বিষয়, রাজনীতির বিষয় নয়, সাধারণ মানুষকে তা বোঝাতে হবে। পিছিয়ে পড়া সমাজে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, শুধু গণতন্ত্র বা বহুত্ববাদ বিপন্ন হবে না, একই সঙ্গে বিপন্ন হবে মনুষত্ব এবং সভ্যতা। কাজেই মুক্তমনা মানুষদের সাহসী ভ‚মিকা রাখতে হবে; সাম্প্রদায়িক হামলা, সন্ত্রাস, মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের জনসংখা যখন দ্রুত বেড়ে চলেছে তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে! পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত চার দশকে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মালম্বীদের হার উদ্বেগজনক হারে কমেছে। ১৯৪১ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল ২৮.০ শতাংশ। ১৯৪৭ এর দেশভাগ এবং ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মালম্বী তাদের জন্মভূমি ছেড়ে চলে যায়। ফলে ২৮ থেকে ২২ শতাংশে নেমে আসে সে সংখ্যা। অন্যদিকে হাজার হাজার মুসলমান আসে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকে। সেদিনকার মুসলিম লীগের চরম হিন্দু বিদ্বেষ এবং একই সাথে ভারত বিদ্বেষ পদে পদে স্মরণ করিয়ে দেয়, পাকিস্তান হচ্ছে মুসলমানের দেশ। কাজেই ভিন্ন ধর্মালম্বীদের আতংক কাটেনি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে এক কোটি দেশত্যাগী মানুষ, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে, নব্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে আসে। ধ্বংস ও রক্তপাতের মধ্য থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জেগে ওঠে। কিন্তু সে জেগে ওঠা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সাম্প্রদায়িক শক্তি। দুটি সামরিক শাসন, দুটি আধা-সামরিক শাসন, সংবিধানে পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী ইত্যাদি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নতুন করে আতংকে নিপতিত করে। সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতা ক্ষুদ্র আদিবাসীসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করে। একাত্তর পাল্টে দিয়ে সাতচল্লিশের চেতনা নতুন করে বাংলাদেশকে গ্রাস করে।

সংখালঘুর এ যে সংখ্যা হ্রাস তার প্রধান কারণ নতুন করে গজানো সাম্প্রদায়িকতা, যে সাম্প্রদায়িকতাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কবর দিয়েছিল। জে. জিয়া ও জে. এরশাদের সামরিক শাসন এবং বিএনপি-জামায়াতের সাবেক জোট সরকার মূলত সাবেক মুসলিম লীগ সরকারের নীতি অনুসরণ করে। এতে একদিকে যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের মগজে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ঢুকেছে, অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা বিপন্ন হয়েছে; একুশ এবং একাত্তরের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় মৌলবাদ জেঁকে বসে, জঙ্গিবাদের উদ্ভব ঘটে, যা সাতচল্লিশের মতো একশ্রেণির দুর্বৃত্তের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি করে।

অস্বীকার করিনি, আমরা এমন এক সমাজ ধারণ করি যেখানে দুর্বলদের অধিকার সংরক্ষণ হয় না, সবলরাই তাদের অধিকার নিশ্চিত করে। এটি কেবল সংখ্যালঘু নয় সংখ্যাগুরুদের বেলাতেও প্রযোজ্য। কাজেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল, ভয়-হুমকি-ধমকি, ঘরবাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন, অনেকেই দেশান্তরিত হবার মতো ভয়ংকর কষ্টকর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শে যদি সমাজ বিনির্মাণ করতে হয়, তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রকে সামনে এগোতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রদায়িকতা কখনোই শুভ প্রবণতা নয়। এতে যেমন সামাজিক সহনশীলতা বিনষ্ট হয়, একই সঙ্গে প্রতারিত হয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পবিত্রতা। অতএব এর প্রতিকার প্রয়োজন। এ প্রতিকার দিতে হবে গোটা সমাজকে, সকল গণতন্ত্রিক মানুষকে, দলমত নির্বিশেষে। অন্যথায় বাংলাদেশের সমাজ বিপন্ন হবে, লুটেরা, লুম্ফেন সত্য ও সুন্দরকে গ্রাস করবে, আধুনিক সমাজব্যবস্থা বিপন্ন হবে।

সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মানুষের ঐতিহ্য নয়। এ দেশে শতাব্দির পর শতাব্দি সব ধর্মের মানুষ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, একসাথে বসবাস করেছে। কিন্তু একশ্রেণির রাজনীতিবিদ সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে মানুষকে তার চিরায়ত সহমর্মিতার অবস্থান থেকে ছিনতাই করে পশুত্বের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপারটা ঘটেছে পরিকল্পিত ভাবে। ভারত বিদ্বেষ জিয়িয়ে রাখতে পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়া হয়েছে। এতে সাধারণ জনজীবনে প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ‘ব্যুরো অব স্টেটেসস্টিকস’ মতে, ১৯৭১ এর আগে পর্যন্ত যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল ২২ শতাংশ, সেই সংখ্যা আজ নেমে দাঁড়িয়েছে আজ ৮.৫ শতাংশে। এর কারণ আতংক, নীরব দেশত্যাগ। এমন পরিস্থিতি কোনো সুস্থ, বিবেচক সমাজের কাম্য হতে পাওে না। স্বাধীনতার পর সকলেই আশা করেছিল বাংলাদেশ হবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংবিধান সে ধারণাই দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বেশির ক্ষেত্রে ‘পাকিস্তানি লিগেসির’ কাছে ফিরে গেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ নতুন করে ধমীয় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ছে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতিপক্ষরা সম্মিলিত উদ্যোগে আজ আগ্রাসন চালাচ্ছে। এ যুদ্ধে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র হোক যেখানে সব ধর্মবর্ণের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করবে; এই বাংলাদেশে আমরা সাতচল্লিশ, পঞ্চাশ বা একাত্তরের অমানবিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না।

আর সে কারণে চাই একটি নতুন রেনেসাঁ, একটি নবজাগৃতি, যা কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে, মুক্ত-উদার ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সশস্ত্র করবে, সঙ্গবদ্ধ করবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন