ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জলে ভাসা পদ্ম

প্রকাশিত: ০৭:২২ এএম, ২৪ মে ২০১৫

টাকা-পয়সা নগদ কিছুই দেওয়া লাগবে না। সাগরপথে পিকনিক করতে করতে যাবা। বিদেশের বাতাসেও টাকা ওড়ে। কামাই করবা। ফুটানি করবা। অল্প অল্প করে বিদেশে যাওয়ার খরচ পরিশোধ করবা। ঠিক এটাই প্রলোভনের ভাষা হয়তো নয়। এর চেয়েও মনোলোভা আরো বেশি আন্তরিক কোনো কথা হয়তো বলেন দালালরা। তাদের কথার শক্তিমত্তা নিয়ে এখন আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকে হারিয়েছেন সর্বস্ব, কেউ কেউ স্বপ্ন, কেউবা হারিয়েছেন তার চেয়েও দামি জীবন।

ঠিক কয় শত মানুষ অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। গণমাধ্যম যা প্রকাশ করছে তা আনুমানিক। সরকারও সম্ভবত সঠিক সংখ্যাটি জানে না। তাই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সাগরে ভাসমান বাঙালির সংখ্যা অল্প। অবশ্যই তা রোহিঙ্গাদের তুলনায়। নরসিংদীর এক সাংবাদিকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। দানা মিয়া নামের এক দুর্ভাগা মানুষের গল্প তিনি শুনিয়েছেন। যিনি ফিরে এসেছেন নানা ভোগান্তির পর। অনেকেই সমুদ্রে ও জঙ্গলে আটকা আছেন। কারো বা কোনো খোঁজই নেই। নরসিংদী জেলা প্রশাসন জানে না ঠিক কতোজন মানুষ পাচার হয়েছে। তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর জেলার প্রায় দু`শো মানুষ সেই সাংবাদিক বন্ধুটির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ থেকে ঘটনার গভীরতা সম্পর্কে একটা আঁচ করা যায়।

বলে রাখি, সরকারি অভিযান টের পেয়ে দালালরা গা ঢাকা দিয়েছেন আগেই। তবে পালাতে পারেননি কক্সবাজারের চিহ্নিত পাঁচ পাচারকারী। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন তারা। এদিকে, কক্সবাজারে নিখোঁজ পাঁচ শতাধিক। সিরাজগঞ্জে তিন শতাধিক। ধারণা করা হচ্ছে প্রথমে পাচারের শিকার হয়েছে কক্সবাজারের বাঙালি এবং রোহিঙ্গারা। পরে উত্তরবঙ্গসহ দেশের ১৯ জেলার মানুষদের এই লোভের জালে জড়িয়ে ফেলা হয়। সেখানে যুবক আছে, আছে কিশোর, আছে শিশু, আছে নারীও।

রোহিঙ্গা এবং বাঙালিরা কেন এভাবে দেশ ছাড়ছে? এ প্রশ্ন এখন শুধু দেশেই নয়, ঘুরপাক খাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলেও। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেরি হার্ফের বক্তব্যেও এ প্রশ্নের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, প্রাণহানির হুমকি জেনেও অভিবাসন প্রত্যাশীরা কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা পর্যালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পিত বঞ্চনার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক সংকট রয়েছে, এটা সত্য। রাজনৈতিকদলগুলো তা মোকাবেলা করছে নিজেদের মতো কৌশল-আন্দোলন, অপেক্ষা-শাসন নানা পদক্ষেপে। দেশের ১৯ জেলায় সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো হঠকারিতার কারণে মানুষ পালিয়ে বাঁচতে যায়, এমন পরিস্থিতি এসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের সাগর পাড়ি দেওয়ার পেছনে কাজ করছে, এমন তথ্যও আমাদের হাতে নেই। তারা যাচ্ছে কাগজপত্র ছাড়াই। অতি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার লোভে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা যাচ্ছে আরো উন্নত জীবনের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে।

অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদেরকে নিজেদের নাগরিক মনে করে না মিয়ানমার। তারা মনে করে চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে সেখানে থাকছেন তারা। নাগরিক সুবিধা না পেয়ে, নির্যাতনে থেকে, অনিশ্চিত এক জীবন থেকে মুক্তি পেতে রোহিঙ্গারা ভাসছেন সাগরে। হয়তো তারা কোনো এক মুসলিম দেশে যেতে চায়। বেঁচে থাকতে চায় পরিবার পরিজন নিয়ে। এর জন্যে সাগর পাড়ি দেওয়া তার অস্তিত্বের জন্য দরকার। বাঙালি যাচ্ছে আরো আয় বাড়ানোর আশায়। একজনের লক্ষ্য অস্তিত্ব বাঁচানো অন্যজনের স্বচ্ছলতা। দুই ধরনের দুই চাহিদার মেলবন্ধন হয়েছে ভাসমান নৌকায়। অবশ্যই দালালদের কারসাজিতে। উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও গন্তব্য এবং পরিণতি হয়েছে তাদের একই। এক কথায় এ পরিণতিকে প্রকাশ করলে বলতে হয় একটিই শব্দ- দুঃখজনক।   

বিবিসি বাংলায় উদ্ধার হওয়া এক অভিবাসন প্রত্যাশীর সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। তিনি জানালেন, নৌকা ছাড়ার পর একটা গণ্ডগোল হয়। তা থামাতে একজনকে গুলি করে মেরে ফেলে দালাল ও নৌকার ক্যাপ্টেন। পরিস্থিতি শান্ত হয়। যাত্রীদের সাগরে ফেলে স্পিডবোটে পালিয়ে যায় দালাল ও নৌকার লোকজন। দায়িত্ব নেয় মিয়ানমারের মানুষ। শুরু হয় বাঙালিদের ওপর নির্যাতন। পানিতে ফেলে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয় বাঙালিদের। সংঘর্ষ হয় আরেক দফা। কাড়াকাড়ি হয় খাবার নিয়ে। থাকতে হয় গাদাগাদি করে। তারপরও সবাই পৌঁছাতে পারে না গন্তব্যে। বর্ণনায় মানুষের চেয়ে ক্রীতদাসের জীবন খুঁজে পাওয়া যায় বেশি। যেন সাগরের যতোটা গভীরে যেতে থাকে অভিবাসন প্রত্যাশীরা ততো বেশি তারা যেতে থাকে আদিম জীবনে। এ যেন ঠিক এ সময়ের জীবন নয়, যেন কোনো এক সিনেমা। হলিউডে বানানো। আবারো প্রমাণ হয় জীবন গল্পের চেয়েও নির্মম। জীবনের নানা পরতে আইনের যতো লঙ্ঘন করে মানুষ, গল্পের বাঁকে বাঁকেও হয়তো অতোটা অনাচার থাকে না। গন্তব্যে পৌঁছার পর নিস্তার নেই। কেউ কেউ অল্প পারিশ্রমিকের চাকরি পায় কারখানায় বা বাগানে। কারো বা বাড়িতে ফোন আসে মুক্তিপণ চেয়ে। জমি-বাড়ি বিক্রি করে যারা যায় তারা মুক্তিপণ দিতে গিয়ে আরো নিঃস্ব হয়। অবশিষ্ট সম্পদ হারায় কেউ কেউ। পুরো জগতটি আইনের প্রতি, মানবাধিকারের প্রতি এক উপহাস হয়ে রইলো।  

নির্মম হলেও সত্য, শ্রম বাজারে অবৈধ অভিবাসীর চাহিদা রয়েছে। তারা কাজ করে বেশি, টাকা নেয় কম। তারা জীবন-যাপন করে ক্রীতদাসের মতো। আবার কোনো কোনো দেশের নাগরিকরা অডজব করতে চায় না। অবৈধ অভিবাসীরা আইনের ভয়ে থেকে সেসব কাজ করে জীবন অতিবাহিত করে। এ সুযোগটাই নেয় পাচারকারীরা। মানুষ তাদের কাছে মানুষ নয়, পণ্য। পণ্যের ব্যবসায় বৈধ-অবৈধের সীমারেখা নির্ধারণ করে লোভ। এক লোভী স্বপ্নচারী বেকারকে প্রলোভনের জালে জড়িয়ে মুনাফা করে। এ মুনাফা ঘামের নয়, রক্তের। কথাটি তাদের বোঝাবে কে?

সরকার ও এনজিওর এখানে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তা হলো জনসচেতনতা বাড়ানোর। সংবাদপত্র পড়তে জানে কিংবা টিভি থেকে তথ্য জানাতে পারে এমন জনগোষ্ঠী হয়তো সহজেই সচেতন হতে পারে। কিন্তু যাদের কাছে যোগাযোগের এ মাধ্যম পৌঁছায় না তাদের জন্য সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম নিতে হবে সরকার ও এনজিওকে। সেটা সভা করে হোক কিংবা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে হোক। তথ্য জানা গেলে যেকোনো সমস্যার একটা সমাধান আশা করা যায়। যতোদিন মানবপাচারের এ রুট সম্পর্কে মানুষের কাছে তথ্য ছিলো না, ততোদিন নীরবে কতো মানুষের প্রাণ গেছে তা আমরা জানতে পারিনি। সম্প্রতি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কার হওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি লোমহর্ষক নানা তথ্য। এক পাচারকারীকে আটকের পর আবিষ্কার হয় গণকবর। এর পর সাগরে ভাসমান আট হাজার মানুষের খোঁজ আসে। কে কোন জাতি তা বিবেচনা না করে বিশ্বের মানুষের হৃদয় আর্দ্র হয়েছে। তাড়িয়ে দিতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত সাময়িক আশ্রয় দিতে চেয়েছে উপকূলের সংশ্লিষ্ট দেশ।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্পর্কে কিছু বলতেই হয়। সেখানে শ্রমের চাহিদা আছে। আমাদের সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তিও আছে শ্রমিক পাঠানোর। কিন্তু অভিযোগ আছে জি টু জি চুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত মাত্র আট হাজার শ্রমিক পাঠানো গেছে। এ সংখ্যা আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। সরকারের এই লোক পাঠানোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা না। বেসরকারি খাতে নানা অনিয়মের কারণে সরকারের সংশ্লিষ্টতা সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সাগরে ভাসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের এ মানবেতর জীবন সরকারের জি টু জি চুক্তিকে আবারো আলোচনায় নিয়ে এলো।

যাহোক, রোহিঙ্গারা ঘর ছাড়া মানুষ। সরকারি নির্যাতনে তারা থাকতে পারছেন না মিয়ানমারে। মানবিক বিবেচনায় তাদের একটা অংশকে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে কেউ কেউ। অনেকেই আবার বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষে এই অতিরিক্ত বোঝা নেওয়া সত্যিই কঠিন। যদিও এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সাগরে ভাসমানদের অভিবাসন দেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে এক সঙ্গে সমুদ্রে ভাসমান অভিবাসীদের উদ্ধার ও সহায়তার তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছে মিয়ানমার। এমনকী সে দেশের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সং সূচির দলও মুখ খুলেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে।

বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা, অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। আমরা আশা করবো রোহিঙ্গা বিষয়ে একটা গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে মিয়ানমার সরকার নেবে। বাংলাদেশ সরকার আরেকটা কূটনৈতিক সাফল্য পাবে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া আরো মজবুত হবে। বিশেষ করে বন্ধ হবে অবৈধভাবে দেশ ছাড়ার প্রবণতাও। অবহেলা করার সুযোগ আমাদের নেই। তৈরি পোশাক রফতানি ছাড়া অন্য যে খাতটি প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে তা কিন্তু এ বৈধ-অবৈধ অভিবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।


এইচআর/বিএ/এমএস