ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একলা-মা, সামাজিক একাকীত্ব

প্রকাশিত: ০৫:২৯ এএম, ৩০ মে ২০১৫

শুক্রবার, সরকারি ছুটির দিন। গণমাধ্যম কর্মীদের ছুটি নেই। তবে কাজ কম থাকে। তবুও সকাল সকাল অফিসে এলাম। রিসেপশন থেকে ফোন, স্যার একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে চান। অনুমতি পেয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো তাকে।

পরিপাটি সাজে, সালোয়ার কামিজ পরা একটি মেয়ে এসে ঢুকল। চিনতে পেরেছেন? প্রশ্ন তার, আমি তাকিয়ে থাকি। চিনতে পারছিনা। পরে বুঝলাম, অনেক আগে একটি দূতাবাসে খণ্ডকালীন কাজ করার সময় তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। সাথে তার সাত আট বছরের একটি ছেলে।

ওর জন্যই আপনার কাছে আসা, আপনি পারবেন আমাকে হেল্প করতে, বললেন তিনি। “ওকে, একটা বোর্ডিং স্কুলে দিতে চাই, কিন্তু লোকজন না থাকলে সিট পাওয়া যায় না, ওকে যে স্কুলে দিতে চাচ্ছি, সেটি আপনার বন্ধুর, আমি খোঁজ নিয়েই এসেছি”। বললাম, ওর বাবা? উত্তর এলো নেই, মারা গেছে।

সিঙ্গেল মাদার, একা-মা। বলছেন, আমি ছাড়া কেউ নেই ওর, আমার চাকুরিটাও করতে হবে, ছেলেটিকেও মানুষ করতে হবে। স্কুলে আনা নেয়া করে চাকুরি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে,  কিন্তু চাকুরিটা ছাড়াতো আমরা বাঁচবোনা। বলালাম, আপনার পরিবার? বলেন, তারা কেউ আমাকে গ্রহণ করছে না, বলে দিয়েছে তোমার জীবন তুমি দেখ।

কথায় কথায় জীবনের গল্পটি বলছেন তিনি। হিন্দু মেয়ে, ভালবেসে বিয়ে করলেন মুসলিম সহকর্মীকে। তাদের জীবন তাদের মতোই চলছিল, কারণ দুই পরিবারই স্বধর্মে বিয়ে না করায় তাদের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করে। স্বামী, সংসার, চাকুরি নিয়ে দিন যখন জীবন যখন কেবল উন্নতির পথে, তখনই ঘটে দুর্ঘটনা, মারা যায় ছেলেটি। ভদ্র মহিলা ফিরতে চেয়েছিলেন বাবার বাড়ি, কিন্তু বাবা-মাহীন পরিবারে ভাইরা বলে দিয়েছে একা বেরিয়ে গিয়েছিলে, একাই থাক, ফিরে এসোনা।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মায়ের ম্লান, ক্লান্ত মুখ। সন্তানকে একা মানুষ করার লড়াইটা তিনি চালিয়ে যাবেন এই সংকল্প নিয়েই নেমেছেন পথে এই একলা মা।

ছেলে তার প্রাণ। কিন্তু তার কাজটাকেও তিনি ভীষণ ভালবাসেন। ভাবছেন আরো ভাল কিছু করবেন। তাই চলছে রাত জেগে পড়াশোনা। কিন্তু কোনো ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ না থাকায় ছেলের জন্য এখন বোর্ডিং স্কুলই ভরসা।

ছেলের ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবেই করা গেল। তিনি চলেও গেলেন। কিন্তু আমি ভাবতে থাকি এখনতো চলছে এমনটা, কিন্তু জীবনে যদি আবার কোনো পুরুষ আসেন, তখন পরিস্থিতিটা কেমন হবে তার? কিংবা যদি নাও আসে, তবুও নির্ভেজাল জীবন কাটানো যায়? এই মহিলার একটি উপায় তাও আছে, নিজের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট আছে এই শহরে, কিনেছিলেন দু’জনে মিলেই। যার এইটুকু নেই, তিনি চলতে পারেন একা একা?

সমাজে একক মায়েরা সংখ্যায় আগের চেয়ে বাড়ছে। কিন্তু আমরা বদলাচ্ছি কি? তিনি বলেন, নিজের ফ্ল্যাট, কিন্তু খুব সতর্ক থাকতে হয় মানুষের কথার আঘাতের কারণে।  বাড়িতে কোনো বন্ধু বা পরিচিত পুরুষ এলেই  অন্য বাসিন্দাদের অতি কৌতূহল, ছেলেকে পর্যন্ত প্রশ্ন কে এলো, কেন এলো? একা মানুষটিকে সাহায্যের হাত না বাড়ালেও সমালোচনার জন্য, আক্রমণ করার জন্যতো লোকের অভাব নেই।

নেই অন্য সুবিধাদিও। ডে-কেয়ার সেন্টার অপ্রতুল, বোর্ডিং স্কুলের সংখ্যা সামান্যই। তাই চাকুরি করা একলা মা’র লড়াইটা চলতেই থাকে।  

আছে আরেক ধরনের একাকীত্ব। অনেকের মাঝে থেকেও একা। এই যে, একা থাকা একে কি বলবো আমরা? লোনলিনেস নাকি সলিটিউড?

এসবের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না সহজে। অনেকদিন পর হয়ত কোনো প্রিয় মুখের সাথে দেখা হলো। বসলাম কোনো রেস্তোরাঁয়। এটা দু’জন হলে যেমন, বেশি হলেও তাই। কথা থেমে যায়, এগুতে চায় না। এক দু’কথা, কুশল বিনিময়, নতুন কি করা হচ্ছে, এসবের পর খাবার, চা/কফি এলো, টুক টাক খাওয়া হচ্ছে, চুমুক চলছে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে। কারণ আমরা সবাই ব্যস্ত যার যার হাতের স্মার্ট ফোন নিয়ে। কেউ হয়তো রেস্তোরাঁয় প্রবেশের সময়ই ফেসবুকে জানিয়ে দিল এমন আড্ডার কথা। ব্যস, এখন বারবার চোখ রাখ কত লাইক, কত কমেন্ট, কি কমেন্ট। দাবি আসতে থাকবে ছবি পাঠাও। পোজ দিয়ে ছবি তোলারো সময় নেই, ধৈর্য্য নেই, যারা যার সিটে বসে মাথাটা কাত করে তোলো সেলফি, আপলোড করে। আবার দেখ সেলফিতে কেমন সাড়া পড়া শুরু হলো। সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশের এমন তাগিদে প্রিয় মুখের মুখটিই আর ভাল করে দেখা হচ্ছে না।

কী নেই যা আজ আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরছি না? পথের ছবি, নতুন জামার ছবি, নতুন বন্ধুর ছবি, শপিং, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, সবই সামাজিক মাধ্যমের নিউজ ফিডে। মানুষের মাঝে নিজে নিজেকে তুলে ধরার সুখ। কিন্তু সেই মানুষ থেকেও নিজে কত বিচ্ছিন্ন !

এই ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে হেঁটে হেঁটে আমরা ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছি, আমার চেনা জানা, প্রিয় অপ্রিয় মানুষ আর পরিবেশ থেকে। এক অদ্ভুত স্ব-প্রেম। আজ আমরা চোখে চোখ রেখে কথা বলিনা। হৃদয়ের স্পর্শ বুঝি না, বা বুঝতে পারি না। আমরা আয়নায় নিজেকে দেখি না। দেখি সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালে। আমরা অজস্র মানুষের সাথে সংযুক্ত থাকি, চ্যাট করি, কিন্তু, আমরা একা। তাই এই একাকীত্ব সলিটিউড নাকি আদতে লোনলিনেস।

গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস-এর মতো আমরা আজ সামাজিক নার্সিসিজমের ব্যাপক চর্চা করে যাচ্ছি। সলিটিউড সৃষ্টির প্রেরণা দেয়, লোনলিনেস হতাশা আনে। আজ আমাদের অনেকেরই, বিশেষ করে, তরুণ-তরুণীদের সেই অর্থে সমাজ নেই, পরিবার নেই, ফেসবুকই তার পরিবার, তার জগত।

তবে ভিন্ন বক্তব্যও আছে। ফেসবুক তথা সামাজিক মাধ্যম শুধু বিচ্ছিন্ন করে না, সংযুক্ত করে। কতো হারানো জনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। হারিয়ে যাওয়া কতো মুখ আবার জেগে ওঠে, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। তাই এখানেই সব কিছুর জানান দেয়া। রাজনীতি থেকে প্রেম বিরহের সব কথা এখানেই উচ্চারণ করা। প্রেম বা সংসার হলো কি-না, ভেঙে গেলো কি-না, নতুন সম্পর্ক হলো কি-না সবই আছে এখানে। একটা আগ্রাসী নেশার মতো এখানেই ছুটে আসা, এখানেই সব বলা।

অতীতে বন্ধুরা, স্বজনরা একজন অন্যজনের বাড়িতে আসত অনেক বেশি। তখন ছুটির দিনে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা এলে খাওয়া-দাওয়ার পর অ্যালবাম খুলে ছবি দেখানোর চলছিল। আজ এ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির যুগে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-পরিজনের আসার সময় যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে এক জনের মাধ্যমে আরো বহু জনের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ।

এখানেও অনেকে আছেন পরিবারকে তুলে আনেন, পরিবারের কথা, সামাজিক, পারিবারিক সম্পর্কের বিষয় মনে করিয়ে দিতে চান। তাইতো উঠে আসে রান্না-বান্নার ছবিও। তবে দিন শেষে সেই আমিত্বই সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকে পরিচালিত করে।


এইচআর/বিএ/এমএস