আড়ম্বর নয়, আন্তরিকতার মাধ্যমে ভাষা-শহীদদের সম্মান জানাই
মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। ‘ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় ‘সাধের পাকিস্তান’। কিন্তু, অল্পদিনের ব্যবধানেই বাঙালিরা বুঝতে সক্ষম হয় ‘ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ আসলে মরীচিকা বিশেষ! নবগঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির বাঙালি মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শাসক পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে লাভ করে তীব্র আঘাত। কিন্তু, যে-কোনো আঘাতের সমুচিৎ জবাব দেওয়ার ইতিহাস বাঙালির সর্বকালের। তাই ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের জবাব দিতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেননি এদেশের ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-জনতা।
মর্যদা রক্ষার সেই জবাব দিতে গিয়ে, মাতৃভাষার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্তে শ্যামল-সবুজ এই ভূগোল-বাংলার বিস্তৃত জনপদ রক্তাক্ত করতে হয়েছে এদেশের তরুণদের। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে শহীদ হতে হয়েছে সালাম-রফিক-জব্বার-বরকত-শফিউরসহ অনেককেই। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের রাষ্ট্রভাষা। ইতিহাসের অমোঘ এ সত্য সবারই জানা। যাদের জীবনের বিনিময়ে বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার এই আসন তাদরে সম্মান জানানো উত্তর-প্রজন্ম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভাষা-শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য আমাদের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের প্রয়োজন নেই, খুব বেশি প্রয়োজন নেই অতিকায় ও বিরাট দর্শনের ‘মনুমেন্ট’ নির্মাণেরও। আমরা যদি তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষাকে মান-মর্যাদার সঙ্গে, শুদ্ধভাবে ও প্রমিতরূপে ব্যবহার করি তবেই সকল ভাষা-শহীদের আত্মার শান্তি, তবেই তাদের প্রতি নিবেদিত হয় আমাদের প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা। দুঃখজনক যে, ভাষার প্রতি আমাদের আড়ম্বর-আনুষ্ঠানিকতা যত আছে আন্তরিকতা ততটা নেই।
নানাদিক থেকে নানা মাত্রিক প্রেরণায় ফেব্রুয়ারি মাস আসে বাঙালির আবেগঘন অনুভূতি নিয়ে। সামগ্রিকভাবে বাঙালির চেতনায় তুমুল এক তরঙ্গ বিস্তারের মধ্য দিয়েই এই ফেব্রুয়ারি আমাদের উদ্দীপিত করে। এ হলো মুদ্রার এক পিঠ। কিন্তু, একই মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে ভিন্নতর চিত্র। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত লোক আছেন যারা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতে ভালোবাসেন যে, তিনি বাংলাটা ঠিক ভালোভাবে লিখতে জানেন না। অনেকে আবার কম্পিউটারে স্বচ্ছন্দে ইংরেজি টাইপ করতে পারলেও বাংলাটা তাদের ভাষায় ঠিক পেরে ওঠেন না। আর, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায়শই বলে থাকে যে, বাংলা বানানে তাদের অনেক সমস্যা আছে। জবাবে বলি, যাদের বাংলা বানানে ‘সমস্যা’ ইংরেজি বানানেও তাদের ‘সম্ভাবনা’ নেই।
শিক্ষার্থীদের সরাসরি ক্লাসে পাই তাই বানান ও শুদ্ধ বাক্য গঠনের জন্য ভালো হোক মন্দ হোক দুটো কথা বলতে পারি, শিক্ষকের অধিকার নিয়ে রাগারাগিও করতে পারি খানিকটা। এর কিছুটা হয়তো কাজে আসে, অনেকটাই হয়তো নিরর্থক ‘উপদেশ’। কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা বানান বা বাক্যরীতির প্রয়োগে ভুল দেখিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সহজভাবে নিতে চায় না। বরং পূর্ব-প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে মুদ্রিত বানান দেখিয়ে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করে (আমিতো বই দেখেই লিখেছি, ভাবখানা এমন!)। আবার, কখনো কখনো তাদের কারোর এরকম আব্দারও থাকে যাতে বানানের ভুলগুলো ক্ষমা করে দিই!
মাঝেমধ্যে তাদের বলেও ফেলি আমি ক্ষমা করবার কে? রফিক-জব্বার-সালাম-বরকত-শফিউরের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসো। কারণ বাংলা ভাষায় কথা বলা, গান গাওয়া, মাকে মা বলে ডাকা, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করবার অধিকারের দাবিতে তোমাদের বয়সেই তারা তাদের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে। বুঝি, এসব শোনে তারা কিছুটা হলেও লজ্জিত বোধ করে। কিন্তু উত্তরে তাদের কেউ কেউ যে-কথাটি জানায় তা কিছুটা ভয়ংকর শোনায় আমার কাছে। তাদের ভাষায় ‘স্যার, এতদিন বানানের কথা কেউ এভাবে আমাদের বলেনি’। তাদের কথা সত্যি হলে বিষয়টি খানিকটা তো ভয়ংকরই। ভয়ংকর এজন্য যে, ইংরেজি কিংবা আরবি (আমার ধারণা বাংলা ভাষার পর এদুটি ভাষা এদেশে বেশি চর্চিত) ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে এরূপ স্বেচ্ছাচারিতার কোনো অবকাশ নেই। অথচ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রে আমরা সেই স্বেচ্ছাচারিতা, সেই অনাচার দেখিয়ে যাচ্ছি অনবরত। এই স্বেচ্ছাচারিতা স্কুল থেকে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কর্মক্ষেত্রেও করে যাচ্ছি নিরন্তর।
বাংলা একাডেমি বানান রীতি প্রমিত করার উদ্দেশ্যে একটি অভিধান প্রকাশ করেছে তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু সেই অভিধানের ব্যবহারিক প্রয়োগ স্কুল, কলেজ বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা সচরাচর দেখতে পাই না। অভিধানটিতে বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিভিন্ন শব্দের পরিবর্তিত এবং আধুনিক বানান ও বানান রীতি দেখানো আছে। সেই সাথে বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলা ভাষায় আগত বিভিন্ন শব্দের বানান বিষয়ক আছে কিছু নিয়ম-নীতিও। এসব নিয়মের প্রতি সামান্য যত্মবান হলেই অনেক শব্দের বানান বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব। বানান বিভ্রান্তি বিদূরিত হলে যে কোনো বাংলা রচনা প্রথমত দেখতে ভালো লাগে আর বিধিসম্মত বাক্য গঠনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলতে পারি।
শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের বলা সম্ভব যে, একটি ভাষার জন্য এত মানুষ যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, অসংখ্য মানুষ যদি কারাবরণ করতে পারে তোমরা কেন সে ভাষাটির শুদ্ধ ব্যবহারের জন্য একটুখানি সচেতন হতে পারবে না? ভুল বানান আর অশুদ্ধ বাক্য গঠনের ভারে কেন তোমরা বাংলা ভাষাটিকে দিন দিন দরিদ্র, নিঃস্ব ও শ্রীহীনতায় আক্রান্ত করে তুলবে? মাতৃভাষার প্রতি তোমাদের এমন অসতর্ক, অমনোযোগ ও নির্দয় ব্যবহার অব্যাহত থাকলে তা কেবল শ্রীহীন ও সমৃদ্ধিহীনই হবে না অদূর ভবিষ্যতে একটি ব্যর্থ ভাষায় পরিণত হবে। একথা ছাত্র-ছাত্রীদেরই বলা সহজ। কিন্তু, রাষ্ট্রের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই ভূগোল-বাংলার সর্বত্র ভুল বানানে ভরা সাইনবোর্ড বিলবোর্ড টানিয়ে গণযোগাযোগের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কাজটি করে নিচ্ছে। ভাষা শুদ্ধির বিষয়ে কে তাদের সচেতন করবে, সে দায়িত্বই বা কার?
আবার, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘সরকারি’ এই শব্দটিও শুদ্ধভাবে না লিখে ‘সরকারী’ হিসেবে লিখে থাকে যা প্রমিত বানানরীতির পরিপন্থি। প্রমিত বানানরীতির নিয়মে ‘সোনালী’, ‘রূপালী’, ‘পূবালী’, প্রভৃতি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকসমূহের নামের বানানগুলোও সংস্কারের সময় এসেছে। বাংলা একাডেমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে একাজটি করতে পারে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমাদেরও উচিৎ ভুল বানানে রাখা নিজেদের ‘মিতালী’, ‘গীতালী’, ‘চৈতালী’, ‘বর্ণালী’ প্রভৃতি নামগুলোর বানান সংস্কারে মনোযোগী হওয়া। নিয়ম মেনে ‘ঈ-কার’ ব্যবহারপূর্বক সরকারী, জরুরী, কোম্পানী, রপ্তানী, ফার্মেসী, তৈরী, বেশী, কাশী, গরীব, চাকরী, পদবী, বাড়ী, গাড়ী, শাড়ী শব্দগুলোর সংস্কারও জরুরি। শুধু বানান নয় বাক্য-গঠন ও শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা আজ চরম সংকটের মুখোমুখি- এক ধরনের বিপন্নও বলা যায়।
এদেশের কিছুসংখ্যক চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক নির্মাতা বাংলা ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। তাদের যুক্তি এ ভাষারীতি আধুনিক তরুণেরা পছন্দ করে। প্রকৃতপক্ষে, গণমাধ্যমে এ ধরনের ভাষারীতি প্রচারের মধ্য দিয়ে উঠতি-বয়সী কোমলমতি তরুণদের ভেতর এক ধরনের ‘আসক্তি’র আবেশ তৈরি করে তাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। অন্যদিকে, হীন উদ্দেশ্যে লোক-হাসানোর মসলা হিসেবে এসব নির্মাতা তাদের নাটক বা চলচ্চিত্রে অঞ্চল-বিশেষের উপভাষা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাও বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্পদ। ক্রমশ দেখতে পাচ্ছি এ সম্পদেরও বিনাশ ঘটছে। আবার, নাগরিক জীবনের ‘ক্যাজুয়াল’ কথোপকথন অর্থাৎ শুদ্ধ ও অশুদ্ধ বাংলা ও ইংরেজির (ও কদাচিৎ হিন্দি) মিশ্রণজাত শব্দ ও বাক্যে রচিত সংলাপদৃষ্টে মাঝেমধ্যে নিজেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন তাহলো এই বাংলা ভাষার জন্যই কি ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল? এফএম রেডিও-জকিদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা খাটে। মনে হয় এটাই প্রতিযোগিতা যে, যে-যত বেশি খামখেয়ালিপনায় ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা (বাংলিশ) উচ্চারণে অনর্গল অশুদ্ধ কথা বলতে পারবে চাকরির বাজারে তার মূল্য হবে তত বেশি!
আসলে বাংলা শব্দ লেখার সময় কিংবা বাংলা বাক্য উচ্চারণের সময় আমরা তার শুদ্ধ-অশুদ্ধ নিয়ে চিন্তা করিনা, করতে চাই না। চিন্তা করতে চাই না এটি বাংলা ভাষা বলে, আমাদের মাতৃভাষা বলে। কারণ, মায়ের কাছে সব অপরাধ, সব অন্যায় আব্দার সহজেই করতে পারি! ইংরেজির ক্ষেত্রে আমরা কখনো এমন উদাসীনতা দেখাই না, বিন্দুমাত্র দেখাতেও পারিনা। আরবির ক্ষেত্রেও দেখাই না, কারণ তার সাথে পরকালের সম্পর্ক জড়িত। আরবি বেহেস্তি ও ইংরেজি রাজ-ভাষা বলে তাদের এত কদর! আর মাতৃভাষা বাংলা গরিবের ভাষা বলে এতটাই অনাদর? বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা আজ কোন্ দিকে পিছিয়ে আছে? মাতৃভাষার প্রতি এই দৈন্য ও হীন মানসিকতা আসলে ঔপনিবেশিক চিন্তার ফসল। ঔপনিবেশিক চিন্তার কবল থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের অহংকারের মাতৃভাষারও মুক্তি ঘটবে না। পৃথিবীর সকল জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। মাতৃভাষার মুক্তিদানের মধ্য দিয়েই আমরা ভাষা-শহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানাতে পারি। এজন্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরের চেয়ে ভাষা শুদ্ধির জন্য আন্তরিকতা বেশি প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/আরআইপি