ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গাড়ি কেনার পূর্বে যেসব বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি

সাইফুল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৩৬ এএম, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর আমি দুজন হাঁটছিলাম। আমার বন্ধু আমার সাথে একটি বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে চাইল। সে বললো, তার কাছে কিছু টাকা আছে, একটি গাড়ি কিনতে চায়। এই প্রশ্নটি শুধু আমার বন্ধুর নয় অনেকেরই।

বয়স বাড়ছে, কিছু টাকা সঞ্চয় হয়েছে, একটা গাড়ি তো কেনা হলো না এই চিন্তা অনেকের মাথায় ঘুরপাক খায়। অধিকাংশ মানুষ ভাবেন অনেকদি ধরে কাজ করছি, আয় করছি কিন্তু নিজেকে তো একটু রিওয়ার্ডেড করা হলো না, নিজের জন্য তেমন কিছু করা হলো না। আসলে গাড়ি কেনা খানিকটা নিজেকে পুরস্কৃত করার মতো যদিও অনেকের কাছে এটা হচ্ছে সাংঘাতিক নেসেসিটি। গাড়ি ছাড়া কোথাও বেরই হতে পারেন না অনেকেই আছেন এমন। আমার বন্ধুর অবস্থা সেটা না। ওনার গাড়ি কিনলে এটাই প্রথম গাড়ি হবে।

কিছু টাকা আছে একটি গাড়ি কিনতে চাই, কিনবো? আপনাকে যখনই কেউ এ প্রশ্নটা করবে যে গাড়ি কিনবো কি না? আপনি সাথে সাথে বলে দেবেন যে কিনে ফেলো। কারণ যদি একটা গাড়ি তাকে কেনাতে পারেন, যে এত দিন গাড়িতে চড়ে নাই, তার স্বপ্ন পূরণ হবে ঠিকই কিন্তু তার গায়ে আপনি একটা খরচের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। বিষয়টা আমি ঠাট্টা করে বললাম।

বিষয় হচ্ছে যখনই আপনি কোনো গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন তখন বেশ কয়েকটা ব্যাপার আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে একটা গাড়ি কেনা শুধু কিন্তু গাড়ি কেনা নয়। যে বিষয়গুলো কনসিডার করতে হবে তার মধ্যে প্রথম বিষয় হচ্ছে আপনি গাড়ি কেনার আগে ভেবে দেখুন যে, আপনার এমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করা হয়েছে কি না।

যদি দেখেন আপনার তিন থেকে ছয় মাস বা এক বছর এরকম সময় চলার জন্য যে টাকাটা দরকার সেটা একপাশে সরানো আছে, তাহলে আপনি একটা ধাপ অতিক্রম করলেন। অর্থাৎ আপনার যদি বিপদ আসে, গাড়ি কেনার পরেও, তাহলে গাড়িটা বেচতে হবে না। আপনার এমার্জেন্সি ফান্ড যেটা আছে সেটা দিয়ে আপনি চালিয়ে নিতে পারবেন।

এরপর আপনি দেখবেন যে, আপনার যে ইনকাম সেই ইনকাম দিয়ে চলতে আপনার খুব কষ্ট হয় কি না। যদি সেই ইনকাম দিয়ে চলতে কষ্ট হয় তাহলে গাড়ি কেনা আপনার জন্য সাংঘাতিক একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ গাড়ি কিনলেই আপনার এখন যে খরচ আছে তার মিনিমাম টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট খরচ বেড়ে যাবে। কারও কারও ক্ষেত্রে তারও চাইতে বেশি। কারণ, গাড়ি কিনলেই আপনার একটা গ্যারেজের প্রশ্ন আসবে। গ্যারেজ ভাড়া করতে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। এখনকার সময়ে বোধহয় পাঁচ হাজার টাকায়ও পাবেন কি না সন্দেহ। অথবা আপনি ভাবতে পারেন এখন যে ফ্ল্যাটে আপনি থাকেন ২০ হাজার টাকা ভাড়া দেন।

একটা গ্যারেজসহ ফ্ল্যাট নিলে আপনার ভাড়া দিতে হবে মিনিমাম ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তাহলে এখানে দেখেন ভাড়া বেশ কিছুটা বেড়ে যাচ্ছে। আপনি যদি এরিয়া চেঞ্জ করেন সেক্ষেত্রে কোনো কোনো এরিয়ার লিভিং কস্ট বেশি, কোনো কোনো এরিয়ার লিভিং কস্ট কম। যদি আপনি একটু লিভিং কস্ট বেশি সেখানে যান তাহলে আপনার লাইফ স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে, আপনার কস্টও বাড়বে।

এবার যদি আপনি পুরোনো গাড়ি কেনেন তাহলে দেখবেন যে, আপনার সার্ভিসিং করাতে করাতে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। দেখা যাবে আজ এই পার্টস নষ্ট, কাল ওটা নষ্ট, পরশুদিন আরেকটা নষ্ট। এর পরের দিন চাকা পাল্টাতে হচ্ছে। দেখবেন প্রতি মাসে কিছু না কিছু খরচ লেগেই আছে। আপনার একটা ড্রাইভার রাখতে হবে। ড্রাইভারের পেছনে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন, তার খাবার খরচ আছে।

আপনাকে এসব বিবেচনায় নিতে হবে। আবার গাড়ির পেছনে প্রচুর জ্বালানি তেল লাগে। ফুয়েল কস্ট অনেক বেড়েছে। ফলে যে গাড়ি কেনেন না কেন প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আপনার এই ফুয়েলের কস্টে যাবে। এটা আপনাকে চিন্তা করতে হবে। হয়তো আপনি ভাববেন, গাড়ি কিনে আমি বেশি দূর যাবো না, অল্প কিছু দূর যাবো। গাড়ি কিন্তু অনেক ছুটতে পারে।

এই গাড়ি ছোটার সাথে সাথে আপনার মনও ছুটতে থাকবে। ফলে, আপনি গাড়ি কেনার পরে দেখবেন ভ্রমণ বাড়িয়েছেন। আগে আপনি শ্বশুরবাড়ি যেতেন একবার। এখন গাড়ি কেনার পরে যাবেন তিনবার। আপনার স্ত্রী আগে যেতেন মাসে দুবার, এখন যাবে চারবার।

 

আমার বন্ধুকেও বলেছি গাড়ি কিনতে। কারণ একটা গাড়ি এখন ঢাকা শহরে খুব দরকার। কিন্তু, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো বিবেচনায় না নিয়ে গাড়ি কেনা উচিত হবে না। যদি এমন হয় যে, আজ আপনি গাড়ি কিনলেন, ছয় মাস পরে গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আবার সেই হাঁটাহাঁটি শুরু করতে হলো, তাহলে সেই গাড়ি কেনার কোনো অর্থ হয় না।

 

আপনি বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে পারতেন না যানবাহনের অভাবে। এখন বাচ্চাদের নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বেরোতে ইচ্ছা হবে। যখন বাইরে ঘুরতে যাবেন শুধু ঘুরবেন না কিছু খাবেন। গাড়ির ফুয়েল-খরচ বাড়বে। তার মানে একটা গাড়ি আপনার জীবনযাত্রার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আপনার খরচকে অনেক উসকে দেবে। একটা গাড়ি থেকে যখন নামবেন তখন

আপনার সুন্দর একটা ড্রেস না হলে কেমন দেখায়। যখন আপনার ড্রেসটা সুন্দর তখন আপনার পরিবারের সবার ড্রেস আরও সুন্দর হওয়া দরকার। আর যদি আপনি ব্র্যান্ডে আসক্ত হন তাহলে তো কথাই নেই। যে একটা ব্র্যান্ড আপনি পরতেন এখন পরিবারের সবাইকে ব্র্যান্ডের পোশাক কিনে দিতে হবে। গাড়ি থেকে নামছেন বলে কথা। সুতরাং, গাড়ির সাথে ড্রেসটা তো মানান সই হতে হবে।

হাতে একটা সুন্দর ঘড়ি না থাকলে কেমন হয়? এরকম অনেক অযাচিত খরচ যেটা আপনি আগে হয়তো চিন্তা করেননি, এ বিষয়গুলো এখন চলে আসবে। একটা গাড়ি আপনার জীবন মানকে বাড়িয়ে দেবে বটে কিন্তু জীবন মানের চাইতে আপনার খরচ টেনে আপনার গলায় রশি পরিয়ে দেবে। তার অর্থ কি এই যে আমি আপনাকে গাড়ি কিনতে না করছি? আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ‘না’ করছি না। তবে গভীরভাবে চিন্তা করতে বলছি।

আমার বন্ধুকেও বলেছি গাড়ি কিনতে। কারণ একটা গাড়ি এখন ঢাকা শহরে খুব দরকার। কিন্তু, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো বিবেচনায় না নিয়ে গাড়ি কেনা উচিত হবে না। যদি এমন হয় যে, আজ আপনি গাড়ি কিনলেন, ছয় মাস পরে গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আবার সেই হাঁটাহাঁটি শুরু করতে হলো, তাহলে সেই গাড়ি কেনার কোনো অর্থ হয় না। ফলে আপনি সব কিছু ভাবেন যে, গাড়ি কিনলে আপনার আয় বাড়বে না কিন্তু আপনার খরচ অনেক বাড়বে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ খরচ আপনি সামাল দিতে পারবেন তো? আপনার যেগুলো সেভিংস স্কিম আছে সেগুলো চলবে তো? আপনার ইন্স্যুরেন্স স্কিম থাকলে সেটা চলবে তো? আপনি বাড়িতে বাবা-মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠান, এটা আপনি পাঠাতে পারবেন তো?

আপনি খাতা কলম নিয়ে ক্যালকুলেশন করুন। গাড়ির মধ্যে আর একটা খরচের কথা আমি বলিনি। সেটা হচ্ছে, ফিটনেসের ব্যাপার আছে। ট্যাক্স-টোকেন করতে হয়, সেই টাকার ব্যাপার আছে। তারপরে আরেকটা খরচ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ যদি হঠাৎ ধরেন তাহলে কেস করলে সেখানে কিছু খরচের ব্যাপার আছে। আবার যদি ওনাদের ম্যানেজ করতে চান সেখানেও কিছু খরচাপাতির ব্যাপার থাকবে। সব মিলিয়ে কিন্তু গাড়ি আপনার একটা ভালো খরচ করিয়ে দেবে। আর, যদি ব্যাংকের ইন্সটলমেন্ট দিয়ে নেন তাহলে মাসে মাসে ইনস্টলমেন্ট পেমেন্ট করতে হবে। সেটাও একটা বাড়তি খরচ সার্বিকভাবে।

এখন সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দেখেন গাড়ি কিনে সেটা মেনটেইন করা আপনার সাধ্যের মধ্যে পড়ে কি না এবং গাড়ি কেনার পরে আপনি আপনার জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবেন কি না। যদি পারেন আমাকেও ডাকেন, চলুন আমরাও একসাথে মিলে আপনার গাড়ি কিনি। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন