ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

নেতৃত্ব অযোগ্যদের হাতে: রাসুলের ভবিষ্যৎ বাণীর ভয়ংকর বাস্তবায়ন

প্রবাস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র

ভালো মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, সৎ মানুষ ও যোগ্য মানুষেরা আজ রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছেন। যারা একসময় সমাজের চালিকাশক্তি ছিল, যারা ন্যায়-সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে দ্বিধা করত না, যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শ রাজনীতির স্বপ্ন দেখত-তারা আজ রাজনীতিকে অযোগ্যদের নোংরা খেলার মাঠ হিসেবে দেখছে।

কর্দমাক্ত এই ক্ষেত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে তারা জীবনের অন্য পথ বেছে নিচ্ছে, আড়ালে চলে যাচ্ছে, নীরবতা অবলম্বন করছে। আর তাদের এই সরে দাঁড়ানোর সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে দেশের সেই অযোগ্য অথর্ব, মূর্খ, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও চরিত্রহীন গোষ্ঠী, যাদের না আছে শিক্ষা, না আছে নৈতিকতা, না আছে রাষ্ট্র পরিচালনার ন্যূনতম যোগ্যতা। তবুও তারা রাজনীতির মাঠে দৌড়ঝাঁপ করছে, জায়গা দখল করছে, ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠছে এবং বিস্ময়ের বিষয়-যারা যোগ্য, শিক্ষিত, নীতিবান-তাদেরই শাসন করছে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাদিসে উল্লেখিত কেয়ামতের যেসব আলামত বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো-যখন নেতৃত্ব অযোগ্যদের হাতে চলে যাবে, যখন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে মূর্খ ও চরিত্রহীন লোকেরা, যখন যোগ্যদের মূল্যায়ন হবে না এবং অযোগ্যরা নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে ফেলবে। এই ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা আজ আমাদের সমাজে ভয়াবহভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

অতীত কয়েকটি সরকারের দিকে তাকালে দেখা যায়, যে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব যাদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, যাদের সংসদ সদস্য বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই বাংলায় একটি অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। এমনকি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের বাক্যগঠনে লজ্জায় চোখ নামিয়ে আনতে হয়। অথচ এরা জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করেছে, আইন প্রণয়ন করেছে, মানুষের অধিকার-স্বার্থ-জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নয়; দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়ার্ড থেকে জেলা, উপজেলা থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন অসংখ্য নেতা রয়েছে, যারা শিক্ষার গন্ধ পর্যন্ত পায়নি। যাদের রাজনৈতিক ভাষণ ভরা থাকে অশালীনতা, হুমকি, বেপরোয়া বক্তব্য আর ক্ষমতার আস্ফালনে। যাদের নীতি-নৈতিকতার মান শূন্যের কোঠায়। যাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কিন্তু তারা মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে আগ্রহী। সমাজ যখন দেখে এদের উত্থান, তখন প্রশ্ন ওঠে-এরা রাজনীতিতে এত আগ্রহী কেন? রাজনীতি কি তাদের জন্মগত অধিকার? নাকি রাজনীতি এখন এমন একটি পেশা, যেখানে টাকা কামানো যায়, ক্ষমতা দেখানো যায়, মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা যায় এবং বিচারহীনতার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বোঝা যায়-যেসব কারণে ভালো মানুষরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, ঠিক সেসব কারণেই অযোগ্যরা রাজনীতির দিকে ছুটে আসছে। রাজনীতি এখন আর সেবা নয়; এটি সুবিধার উৎস, ক্ষমতার সোর্স, প্রভাবের ব্যবসা। এখানে সততা, যোগ্যতা বা চরিত্রের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন শুধু পেশিশক্তি, দলীয় আনুগত্য, অর্থের রং, আর যে কোনোভাবে নেতা হওয়ার লোভাতুর মানসিকতা। যোগ্য মানুষ এ নোংরা খেলায় অংশ নিতে চায় না, কিন্তু অযোগ্যরা এ খেলায় নিজেদের জন্য সুযোগ দেখে-এ কারণেই তারা রাজনীতিতে এত আগ্রহী।

শিক্ষিত, সৎ, বিবেকবান মানুষরা রাজনীতিতে ঢুকতে চান না কয়েকটি কারণে। প্রথমত, তারা দেখে রাজনীতিতে সততার মূল্য নেই। শিক্ষা বা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখানে উন্নতির সুযোগ নেই। বরং দলীয় নেতার পায়ের কাছে নতজানু থাকা, ক্ষমতাবানদের তোষামোদ করা, হুমকি দিয়ে প্রতিপক্ষকে দমন করা-এসবই রাজনীতির মুদ্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সমাজে সততা দুর্বলতা, সেখানে সৎ মানুষ কীভাবে টিকে থাকবে?

দ্বিতীয়ত, তারা দেখে-একবার রাজনীতিতে ঢুকলে তাদের সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে। কারণ রাজনীতি এখন এমন এক জায়গা যেখানে চরিত্রবান মানুষ টিকে থাকতে পারে না। প্রতিদিন এমন কাজ করতে হবে যা তাদের নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায়। এমন বক্তব্য দিতে হবে যা সত্য নয়। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা বিবেকের বিরুদ্ধে। তাই তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

অন্যদিকে অযোগ্যদের জন্য রাজনীতি হলো স্বর্গ। এখানে তাদের শিক্ষা লাগে না। চরিত্র লাগে না। মেধা লাগে না। লাগে শুধু দলীয় পরিচয়, কিছু টাকা, কিছু ভয় দেখানোর ক্ষমতা, আর হঠাৎ করে মানুষকে মোহিত করার ক্ষমতা। যে মানুষ সমাজে একসময় হাস্যরসের পাত্র ছিল আজ দেখা যাচ্ছে সে-ই বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে মানুষ ব্যবসায়, শিক্ষায় বা সমাজসেবায় সফল হতে পারেনি, সে-ই আজ রাজনীতিতে ‘নেতা’ হিসেবে পরিচিত। কারণ রাজনীতি এখন এদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল; এখানে চুরি করলে ধরা পড়ে না, দুর্নীতি করলে শাস্তি হয় না, মানুষের ওপর অত্যাচার করলে বিচার হয় না। বরং এসব করার মাধ্যমেই তারা আরও শক্তিশালী হয়।

এটির ভয়াবহ প্রভাব দেশের ওপর প্রতিনিয়ত পড়ছে। সংসদে আইন প্রণীত হয়, কিন্তু অনেক সময় যারা আইন তৈরি করে তারা সেই আইনের একটি লাইন পর্যন্ত বোঝে না। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা করে এমন মানুষ-যারা মানচিত্র পড়তে জানে না, অর্থনীতি বোঝে না, পররাষ্ট্রনীতি কি তাও জানে না। যারা নিজের বাচ্চার স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট লিখে দিতে পারে না, তারা রাষ্ট্রের ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। এটি কি স্বাভাবিক? এটি কি কোনও সভ্য জাতির চিত্র? নাকি এটি সেই অন্ধকারযুগ যার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল?

যখন সমাজের যোগ্য মানুষরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়, তখন রাষ্ট্রে যে শূন্যতা তৈরি হয় তা পূরণ করে দুর্নীতিগ্রস্তরা। যারা একসময় সমাজের বোঝা ছিল, তারা আজ রাষ্ট্রের চালক হয়ে যায়। আর যে যোগ্যরা দেশের উন্নতির নকশা তৈরি করতে পারত, যারা নেতৃত্ব দিতে পারত, যারা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শাসন দিতে পারত-তারা নীরব দর্শকে পরিণত হয়। তাদের মনে জন্ম নেয় অনীহা, ক্ষোভ ও হতাশা। তারা ভাবে-এই রাজনীতি তাদের নয়। আসলে রাজনীতির মাঠ থেকে তাদের তাড়ানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। কারণ দুর্নীতিগ্রস্তরা জানে-যদি সৎ মানুষ রাজনীতিতে আসে, তাহলে তাদের লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে।

জাতির উন্নয়ন তাই থমকে গেছে। দুর্নীতি এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে মনে হয় এটি এখন সমাজের সংস্কৃতির অংশ। হানাহানি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভূমিদখল, সন্ত্রাস-এসব যেন এখন নেতৃত্বের যোগ্যতার মাপকাঠি। কেউ যত বেশি ভয় দেখাতে পারে, তত বেশি ‘নেতা’। কেউ যত বেশি টাকা লুট করতে পারে, তত বেশি ‘ক্ষমতাবান’। এমন পরিবেশে যোগ্য মানুষ টিকে থাকবে কীভাবে?

সমাজবিজ্ঞান বলে-যে সমাজে নেতৃত্ব অযোগ্যদের হাতে চলে যায়, সেই সমাজের পতন নিশ্চিত। ইতিহাস বলে-যে সভ্যতায় নীতিহীনদের আধিপত্য ঘটে, সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়। ধর্ম বলে-যে সময়ে অযোগ্যরা নেতা হয়, সেটিই বিপদের সময়। আজ বাংলাদেশে রাজনীতির যে চিত্র তা এই সত্যগুলোরই প্রমাণ।

কিন্তু সমাধান কী?

সমাধান একটাই-যোগ্য মানুষদের রাজনীতিতে ফিরে আসা দরকার। কারণ রাজনীতি ছাড়লে রাষ্ট্র থেকে দূরে থাকা যায় না। রাষ্ট্র আমাদেরই, আর রাষ্ট্র পরিচালনা যদি অযোগ্যদের হাতে যায়, তার ক্ষতি আমরাই ভুগব। তাই ভালো মানুষদের রাজনীতিকে পরিত্যাগ করা মানে খারাপ মানুষদের হাতে দেশ তুলে দেওয়া। সৎ মানুষের দায়িত্বই হলো সমাজে আলোর উৎস হয়ে ওঠা। নীরব থাকা নয়, নেতৃত্ব দেয়া। মূর্খদের হাতে দেশ ছেড়ে দেয়া নয় বরং সত্যিকার নেতৃত্বের পথ তৈরি করা।

আজকের প্রজন্মকে বুঝতে হবে-রাজনীতি ব্যবসা নয়; এটি নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব। যদি সৎ মানুষ উঠে আসে, রাজনীতি হবে শুদ্ধ। যদি মেধাবীরা নেতৃত্ব দেয়, দেশ এগোবে। যদি চরিত্রবানরা রাষ্ট্র পরিচালনা করে, সমাজ আলোকিত হবে। আর এটি সম্ভব শুধু তখনই-যখন ভালো মানুষরা ভয় নয়, দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করবে।

অন্যদিকে জাতিকেও পরিবর্তন হতে হবে। আমরা যদি শিক্ষিত, যোগ্য, নীতিবান মানুষদের মূল্যায়ন না করি, তারা কখনোই নেতৃত্বে আসবে না। ভোটকে যদি আমরা অভ্যাসগত লেনদেন বানিয়ে ফেলি, তবে অযোগ্যরাই নেতৃত্বে আসবে। কিন্তু যদি বিবেক দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করি, তবে মানসম্মত নেতৃত্ব সম্ভব।

রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে যোগ্যতা নেতৃত্বের প্রধান শর্ত। যেখানে আইন থাকবে এমন-শিক্ষা ছাড়া কেউ নেতা হতে পারবে না; দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে কেউ পদ পাবে না; চরিত্রহীন জীবনযাপন করলে কেউ নেতৃত্বে আসতে পারবে না। এমন ব্যবস্থা ছাড়া রাজনীতি শুদ্ধ হবে না।

শেষ কথা একটাই-যোগ্য মানুষকে শাসন করবে অযোগ্যরা-এটা যে জাতির জন্য লজ্জা, তার জন্য শাস্তিও। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হয়ে যাচ্ছে-এটি শুধু ধর্মীয় সতর্কতা নয়; এটি বাস্তবতার ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। এখনো সময় আছে-যোগ্যদের ফিরিয়ে আনতে হবে, রাজনীতিকে পরিষ্কার করতে হবে, অযোগ্যদের আধিপত্য ভাঙতে হবে। নইলে এই অযোগ্যতার শাসন একদিন পুরো জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে; যার প্রতিকার তখন আর সহজ হবে না।

আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম