জন্মদিনের নতুন সূর্যোদয়

শনিবার ছিল মারিয়ার জন্মদিন। ৫৯ বছর পেরিয়ে এলো সে, আর আমি তার সঙ্গে আছি ৩২ বছর ধরে। এত বছর পরেও সে আমার কাছে ধাঁধার মতো—তার পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস, স্বপ্ন সবই পরিচিত, তবু যেন নতুন নতুন রঙে ধরা দেয়। সন্ধ্যায় আমরা ঘরোয়া এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলাম, সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙতেই অনুভব করলাম, কিছু একটা বদলে গেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, যেন সমগ্র বিশ্ব থমকে আছে। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কোনো গাড়ির শব্দ নেই, পাখির ডাক নেই, এমনকি পাশের বাড়িগুলোরও কোনো সাড়া নেই। আমি জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
জানালা খুলতেই চোখে পড়লো এক অদ্ভুত আলো। সূর্যের আলো নয়, যেন এক শীতল নীলাভ আভা, যা ধীরে ধীরে চারপাশকে ঢেকে ফেলছে। আকাশের রং অচেনা, বাস্তবের বাইরে কোনো স্বপ্নের মতো। মনে হলো, আমরা কোনো নতুন জগতে এসে পৌঁছেছি, যেখানে পুরোনো পৃথিবীর অস্তিত্বও মুছে যাচ্ছে।
মারিয়া আমার পাশে এসে দাঁড়াল, চোখে ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্র প্রতিচ্ছবি।
সে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কিছু অনুভব করছ?’
তার কণ্ঠস্বর যেন বাতাসে মিশে যাচ্ছিল।
আমি গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে বললাম, ‘এটাই পরিবর্তন।’
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো। ‘কিন্তু সবকিছু এত নিঃসঙ্গ কেন? আমরা কি অন্য কোথাও চলে এসেছি?’
আমি জানি না। কিন্তু অনুভব করছিলাম, এই পরিবর্তন শুধু বাইরের নয়, আমাদের ভেতরেও ঘটছে। পুরনো দুনিয়া কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার বদলে এক নতুন উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
- আরও পড়ুন
- দুর্নীতি মোকাবিলায় কিছু পরামর্শ
আকাশের নিস্তব্ধতা আমার ভেতরেও এক অজানা ভয় সৃষ্টি করলো। মেঘগুলো ভারী হয়ে এলো, যেন পৃথিবীই আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি সব শেষ? নাকি নতুন কোনো সম্ভাবনার দ্বার খুলছে?
মারিয়া হঠাৎ বললো, ‘আমরা কি ভয় পাচ্ছি, নাকি সামনে যা আসছে, তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি?’
তার কথায় আমি একটু থামলাম। সত্যিই তো, পরিবর্তন কখনও স্থির থাকে না। ভয়ও একসময় শক্তিতে পরিণত হয়, যদি আমরা সেটিকে বুঝতে পারি।
বিজ্ঞাপন
আমরা পরস্পরকে শক্তি দিতে শুরু করলাম। নতুন পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু দর্শক হয়ে থাকব না—আমরা সেই পরিবর্তনেরই অংশ হবো। এই শূন্যতার মাঝেই নতুন কিছু সৃষ্টি হবে, নতুন দিগন্ত খুলবে।
আমি মারিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হয়তো এই পরিবর্তনই আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখাবে।’
সে মাথা নেড়ে বললো, ‘এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? ভয়ই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।’
বিজ্ঞাপন
আকাশের নীলাভ আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছিল। কিন্তু আমাদের ভেতরের আলো, যা এতদিন শঙ্কার আড়ালে ছিল, তা এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরিবর্তন আমাদের নতুন শুরুর দিকেই নিয়ে চলেছে। আমরা সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে একসঙ্গে আড্ডা দিতে।
মারিয়া আর আমি বাল্টিক সাগরের পাড় দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ সূর্যোদয় হয়েছে। মারিয়া হাঁটতে হাঁটতে সুইডিশ ভাষায় বলতে লাগল—
নতুন সকাল, আর আমি তোমার করুণায় জেগে উঠি,
তুমি সর্বদা আমার প্রতি সদয়।
নতুন সকাল, আর সত্য এখনো একই—
তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যাওনি।
ভাবতে অবাক লাগে, তোমার করুণা আমার সমস্ত বোঝা ঢেকে দেয়,
আমি তোমার কাছে আসতে পারি, ঠিক যেমন আমি আছি।
আমার আত্মা যেন উচ্চস্বরে গাইতে পারে,
প্রতিটি সুর যেন শুধু তোমার জন্য হয়।
আমি যে পথ চলি, যে নিঃশ্বাস নিই,
সব যেন তোমার মহিমা গানে ভরে ওঠে।
যদি কখনো আমার গান থেমে যায়,
প্রভু, আবার মনে করিয়ে দিও—
সে ভালোবাসার কথা, যা কখনো মরে না,
সে পরিত্রাণের কথা, যা কেবল তোমাতে রয়েছে।
নতুন সকাল, তোমার শান্তি নিয়েই আমি জাগি,
তুমি আমার হয়ে প্রতিটি যুদ্ধ জিতেছো।
নতুন সকাল, তোমার আলো নতুন আশার জন্ম দেয়,
আমার সব ধূসরতা রঙিন হয়ে ওঠে তোমাতে।
যখন আমি একা থাকি, তুমি পাশে থাকো,
তোমার সঙ্গেই আমি সারাজীবন চলতে চাই।
আমার আত্মা যেন উচ্চস্বরে গাইতে পারে,
প্রতিটি সুর যেন শুধু তোমার জন্য হয়।
আমি যে পথ চলি, যে নিঃশ্বাস নিই,
সব যেন তোমার মহিমা গানে ভরে ওঠে।
যদি কখনো আমার গান থেমে যায়,
প্রভু, আবার মনে করিয়ে দিও—
সে ভালোবাসার কথা, যা কখনো মরে না,
সে পরিত্রাণের কথা, যা কেবল তোমাতে রয়েছে।
তোমার মতো আর কেউ নেই, যে ভাঙা হৃদয়কে পূর্ণ করতে পারে,
প্রতিটি নতুন সকালে তোমার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা বাড়ে।
কারণ, হে প্রভু, কেবল তুমিই আমার গানের যোগ্য,
আমি আবারও কণ্ঠ তুলব, তোমার নামে গাইব।
বিজ্ঞাপন
জন্মদিন কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি নতুন উপলব্ধির, পরিবর্তনের এবং নতুন শুরুর প্রতীক। এই দিনটি আমাদের শিখিয়ে দেয়, প্রতিটি সূর্যোদয়ই এক নতুন জীবনের আমন্ত্রণ। শুভ জন্মদিন মারিয়া।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস
বিজ্ঞাপন