লিবিয়ায় নারকীয় জীবনের কথা বিশ্বকে জানাতে চান বাংলাদেশি
পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের অবস্থা বদলাতে চান ১৭ বছর বয়সী রহিম/ছবি-আলেসান্দ্রো পুলিয়া/ইনফোমাইগ্রেন্টস
চলতি গ্রীষ্মের সূর্যটা বেশ চোখ রাঙাচ্ছে ভূমধ্যসাগর পাড়ের দ্বীপ লাম্পেদুসায়। ইতালির দক্ষিণাঞ্চল সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের অংশ এটি। মাসখানেক আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপটিতে পৌঁছেছেন কয়েকজন বাংলাদেশি ও সুদানি তরুণ। লিবিয়ার যন্ত্রণাদগ্ধ দিনগুলো ছেড়ে আসা এসব তরুণের চোখে এখনও বিস্ময় খেলা করে।
এই তরুণদের আশ্রয় দিয়েছে আগ্রিজেন্তোর স্থানীয় একটি গির্জা। ওই গির্জা আয়োজিত গ্রীষ্মকালিন নানা কর্মকাণ্ডে মেতে আছে স্থানীয় শিশুরা। প্রখর রোদেও ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো তারা। মাঠের এক কোণে ছায়ায় বসে তা দেখছিলেন সদ্য সাগর পেরিয়ে আসা অভিবাসী তরুণেরা।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে দেশটিতে আসা অভিবাসীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৯২। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই শীর্ষে রয়েছেন। এই সময় এসেছেন ১০ হাজার ৯৮৯ জন বাংলাদেশি। এরপরেই আছে ইরিত্রিয়া আর মিশরের নাগরিকেরা।
তপ্ত দুপুরে কথা হয় বাংলাদেশ থেকে আসা ১৭ বছর বয়সী তরুণ রহিমের* সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপে উঠে আসে, লিবিয়ায় অভিবাসীদের ভয়ঙ্কর জীবনের কথা, পাচারের শিকার অভিবাসীদের হাতবদলের গল্প।
লিবিয়া ছেড়ে এসেছেন মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু লিবিয়ার জীবন নিয়ে কথা বলতে এখনও খুব কষ্ট হয় তার। কিন্তু যন্ত্রণা চেপেও সেই গল্পটা বলতে চান রহিম।
তিনি বলেন, ‘এ বছরের ২৫ জুন আমরা লাম্পেদুসায় পৌঁছেছি। আমাদের উদ্ধার করে ইতালির একটি সামরিক জাহাজ। জুওয়ারা থেকে একটি কাঠের নৌকা নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম আমরা।’
ইতালি পৌঁছার আগে ১৪ মাস লিবিয়া থেকেছেন রহিম। বললেন, ‘এই সময়ের মধ্যে আমরা তিনবার জায়গা বদল করেছি।’ এই ১৪ মাসের কিছুদিন ত্রিপোলি, সাব্রাথায় এবং জুওয়ারায় কেটেছে তার।
এত জায়গা বদলের কারণ হিসেবে রহিম বলেন, ‘লিবীয় পাচারকারীরা বাংলাদেশি মাফিয়ার সঙ্গে মিলে আমাদের একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’
গল্পের শুরু
বাংলাদেশ থেকে রহিম যাত্রা শুরু করেছিলেন ২০২৪ সালের ৩ মার্চ। রাজধানী ঢাকার কাছের জেলা মাদারীপুরের কালিকাপুর গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা।
রহিম বলেন, ‘বাংলাদেশি মাফিয়াদের জন্য যারা কাজ করে আমরা তাদের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। ঢাকা থেকে প্রথমে আমরা দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হই। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে আসা হয় মিশরের আলেকজান্দ্রায়। সেখান থেকেই লিবিয়া রওনা দেওয়ার কথা। সেখানে একটি ঘরে আমাদের রাখা হয়। লিবিয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে সেখানে বাংলাদেশিদের নাকি দুই থেকে চারদিন রাখা হয়।’
এই কথার সত্যতা পাওয়া গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টেক্স-এর অনুসন্ধানেও। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশিদের ঢাকা থেকে লিবিয়া পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিশরের আলেকজেন্দ্রা একটি অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট।
নরকের দিনগুলো
লিবিয়া পৌঁছার পরের গল্পটাও বলেন রহিম। তিনি বলেন, ‘শুরুতে লিবিয়ার ত্রিপোলির একটি ঘরে আমাদের রাখা হয়েছিল। কিছুদিন পর সেখানে এক লোক আসে। ওই লোক বাংলাদেশিদের ইতালিতে পাচারের কাজ করতো। সে-ই লোক আমাদের ত্রিপোলির ওই ঘর থেকে সাব্রাথায় নিয়ে যায়।’
সাব্রাথায় তাকে-সহ অন্যদের রাখা হয়েছিল ছোট একটি কক্ষে। সেই কক্ষের একটি ভিডিও করতে পেরেছিলেন রহিম। সেখানেই তার নারকীয় জীবন শুরু হয় বলে জানান রহিম।
ইতালির লাম্পেদুসায় দুই সিস্টারের সঙ্গে বাংলাদেশি রহিম ও তার অভিবাসী বন্ধু। নিরাপত্তার স্বার্থে তার মুখ ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে। ছবি/আলেসান্দ্রো পুলিয়া/ইনফোমাইগ্রেন্টস
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকে ওই ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার মতো অনেক তরুণ সেখানে ছিলেন। বয়স্করাও ছিলেন। তারা আমাদের খাবার দিতো না এবং আমাদের মারধর করতো। পরে আমাদের তিনটি আলাদা কক্ষে ভাগ করা হয়েছিল। তিন জন লিবিয়ান নাগরিক এবং এক বাংলাদেশি ওই ঘরটির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল।’
ওই কক্ষগুলোর ভেতরে যা ঘটেছিল তা খুবই ভয়াবহ বলে জানান রহিম। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের পরিবারের ফোন নম্বর জানতে চেয়েছিল। আমাদের মারধর করার সময় পরিবারের কাছে টাকা চেয়ে ভিডিও কল দিয়েছিল। তারা প্রায় এক হাজার ইউরো চেয়েছিল এবং তারা বলেছিল যে সাত দিনের মধ্যে টাকা দিতে হবে। আমার পরিবারের কাছে টাকা ছিল না, তাই তারা আমাকে মারধর করে এবং আমার একটি নখ উপড়ে ফেলে। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং পরে কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।’
শরীরে ক্ষত, হৃদয় বিক্ষত
রহিম তখন তার ডান হাতের আঙুলটি দেখান। যা তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে।
রহিম আরও বলেন, ‘তারা ছয় মাস ধরে প্রতিদিন আমাদের মারধর করে, রাত ৩টায় আমাদের মারধর করা হতো, তখন বাংলাদেশে সকাল ৭টা। আর ভিডিও কল দিয়ে সেই দৃশ্য দেখিয়ে টাকা দাবি করতো।’
রহিমের মা আর বেঁচে নেই। বাবা আছেন, কিন্তু ভীষণ অসুস্থ। আর আছে দুই ভাই। সেই দুই ভাই বয়সে তার চেয়েও ছোট।
রহিম বলেন, ‘আমি পাচারকারীকে আমার খালার নম্বর দিয়েছিলাম। কারণ আমি চাইনি আমার বাবা এটা দেখুক।’
কান্না জড়ানো গলায় রহিম বলেন, ‘আমার পরিবার দরিদ্র এবং আমার একমাত্র ইচ্ছা হলো আমার বাবা এবং ভাইদের উন্নত জীবনযাপনে সাহায্য করা। আমি তাদের শান্তিতে রাখতে চাই।’
সাগর পেরোনোর সাহস
সাব্রথায় দীর্ঘ সময় কাটানোর পর রহিম এবং অন্যান্য বাংলাদেশি অভিবাসীদের জুনে জুওয়ারায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। রহিম বলেন, ‘রাতে জুওয়ারার এক মরুভূমিতে রাখা হয় আমাদের। সেখান থেকে হেঁটে এক মসজিদে পৌঁছাই আমরা। সেখানে হাজার খানেক বাংলাদেশি ছিলেন।’
‘জুওয়ারা থেকেই আমরা ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি’, বলে জানান রহিম। ভয়াল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে চড়ে বসেন একটি কাঠের নৌকায়।
৯ জুন ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে ৮৯ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করে গার্ডিয়া ডি ফিনাঞ্জা। উদ্ধারের পর অভিবাসীদের পৌঁছে দেওয়া হয় লাম্পেদুসায়। অভিবাসীদের মধ্যে ২৮ জন ছিলেন বাংলাদেশি৷ তাদের একজন রহিম।
নির্যাতনের গল্প জানুক বিশ্ব
রহিম যখন ইতালি পর্যন্ত নিজের ভ্রমণের কথা ভাবেন, তার কাছে সবকিছু বিস্ময় লাগে। তিনি বলেন, ‘আমি কখনও এই অমানবিক আচরণের কথা ভাবতে পারিনি। যখন আমি আমার গ্রামে ছিলাম, তখন আমি কখনও ভাবতে পারিনি লিবিয়া আসলে বাংলাদেশিদের জন্য কোন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। বিশ্বের সবার জানা উচিত লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের সঙ্গে কী ঘটে।’
হাহাকার মেশানো গলায় প্রশ্ন ছোঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘মানুষ কীভাবে অন্য মানুষের ওপর এভাবে অত্যাচার করতে পারে?’
‘আউসিলিয়া ই ব্রাভা, তি আমো’
৮০ বছর বয়সী সিস্টার আউসিলিয়ার আদর-স্নেহ আর মমতায় এখন সময় কাটছে রহিমের। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের প্রধান গন্তব্য লাম্পেদুসার মোলো ফাভালোরোতে তিন বছর ধরে কাজ করছেন এই সিস্টার। রহিমের কাছে এই প্রবীণ নারী মায়ের সমতুল্য। রহিম অকপটে বলেও ফেললেন সেই কথা, ‘তিনি আমার মা।’
পোস্ট কার্ডের ঢঙে নিজের লেখা দেখান রহিম। সেখানে লেখা, ‘আউসিলিয়া ই ব্রাভা, তি আমো’। এর অর্থ ‘আউসিলিয়া খুব ভালো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
লাম্পেদুসায় এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে রহিমের। এই কদিনে ইতালিয়ান কিছু শব্দ শিখেছেন এই তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করতে চাই, তারপর একটি চাকরি খুঁজে বের করব যেন পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি। আমার বাবা এবং ভাইদের জন্য আমি সর্বোচ্চ করতে চাই।’
*এই বাংলাদেশি অভিবাসী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে তার প্রকৃত নামের বদলে ছদ্মনাম হিসেবে ‘রহিম’ ব্যবহার করা হয়েছে।
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস
এমআরএম/জিকেএস