নিরাপদ ভোটের স্বপ্ন কি অসম্ভব? ভয়, সংঘর্ষ ও বিভ্রান্তির বাংলাদেশ
আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতিশয় উদ্বেগজনক। ভোটের আগে তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা সাধারণ মানুষকে আজ সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতা আতঙ্কিত করছে। বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে চলছে সংঘর্ষ; প্রতিটি শহর, গ্রাম, বাজার এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র আজ যেন এক জালামুখী পরিস্থিতির মুখোমুখি।
এক দল অন্য দলের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে, ফেস্টুন অপসারণ করে, ব্যানার ধ্বংস করে—এমন দৃশ্য এখন আর অপ্রত্যাশিত নয়। রাজনৈতিক নেতারা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা নেতাকর্মীদের উত্তেজিত করছে এবং সংঘাতকে আরও তীব্র করে তুলছে। সাধারণ মানুষ আজ আতঙ্কিত, নিরাপদ নয়, ঘর থেকে বের হওয়া নিয়ে শঙ্কিত।
মিডিয়ার ভূমিকা এই পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। অনেক মিডিয়া সংবাদ কেটে, ভিন্নভাবে মডিফাই করে প্রচার করছে। কারও উদ্দেশ্য ভিউ বাড়ানো, কারও উদ্দেশ্য দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা। ফলে সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য পাচ্ছে না। অনেক সময় মিডিয়া পক্ষপাতিত্ব করে—এক দলকে উপস্থাপন করছে নির্দোষ, অন্য দলকে দোষী হিসেবে। এই ধরনের খবর মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং সামাজিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
বিগত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ আশা করছিল—একটি স্বতঃস্ফূর্ত, নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। কিন্তু আজ যা ঘটছে, তা সেই আশা ধ্বংস করছে। নির্বাচনের আগে সহিংসতা, অশান্তি এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা দেশের মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনকে গণতন্ত্রের উৎসবের বদলে রূপান্তরিত করছে অস্থিরতা ও আতঙ্ক।
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বহু বিষয়। প্রথমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা এবং ক্ষমতার লড়াইকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছে। প্রতিটি নির্বাচনের সময় সহিংসতা, উত্তেজনা এবং ভীতি ছড়ানোই হয়ে যাচ্ছে প্রধান কর্মকাণ্ড। নেতারা নিজেদের স্বার্থে জনমত প্রভাবিত করতে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা চাইছেন ভোটের আগে কর্মীদের উত্তেজিত করে রাখা। এর ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে তা যথাযথভাবে হচ্ছে না। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কার্যকর তদারকি নেই। সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অপরাধীরা শাস্তিমুক্ত থেকে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতার অভাব। সমাজে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতি এক ধরনের সহনশীলতা তৈরি হয়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হলেও সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পরিবার, সন্তান এবং ব্যবসা সবই ঝুঁকির মধ্যে। সহিংসতা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা সামাজিক সম্পর্ককে দুর্বল করছে। মানুষের মধ্যে অসহযোগিতা এবং distrust বেড়ে যাচ্ছে।
চতুর্থত, মিডিয়ার ভূমিকা। সংবাদ প্রচার এবং সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার যথাযথ নয়। খবর কেটে, প্রাসঙ্গিক তথ্য পরিবর্তন করে প্রচার করা হচ্ছে। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ কখনো কখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব এবং তথ্যের বিকৃতি সংঘাতের মাত্রা বাড়াচ্ছে।
পঞ্চমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব। দলগুলো ক্ষমতা অর্জন এবং ভোটের ফলাফলকে কেন্দ্র করে কাজ করছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রক্রিয়া তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা নিজের স্বার্থে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। নির্বাচনের আগে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। মানুষ ভোট দিতে চায়, কিন্তু নিরাপদে ভোটের পরিবেশ নেই। ভোট মানে গণতন্ত্রের উৎসব, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা জরুরি। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে দূরে থাকা, আইন মানা, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা—এসব অত্যাবশ্যক। পরিবার, সমাজ এবং নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য।
রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য। প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখবে, প্রতিটি সংঘাত ঠেকাবে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ আচরণ নিশ্চিত করবে। মিডিয়া দায়িত্বশীল হবে, সত্য প্রকাশ করবে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না।
দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। তারা সুষ্ঠু, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিরাপদ ভোটের আশা করছে। কিন্তু সহিংসতা, উস্কানি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণ আতঙ্কিত, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো—সবার সচেতনতা, রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলতা, প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং মিডিয়ার সতর্কতা। একত্রে কাজ করলে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিরাপদ ভোটের পরিবেশ ফিরবে।
ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র নির্ভর করছে এই সময়ের দায়িত্বশীল আচরণের ওপর। ভোটের আগে তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনি পরিবেশ স্বাভাবিক করা, সহিংসতা বন্ধ করা, জনগণকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এগুলো এখন সময়ের দাবি।
সচেতনতা, দায়িত্ব, সততা এবং আইন শৃঙ্খলার মধ্যে মিলেই দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, গণতন্ত্র জাগ্রত হবে। না হলে দেশের মানুষ ভয়, বিভ্রান্তি এবং প্রতারণার শিকার হবে।
সর্বশেষে বলা যায়—ভোটের আগে তফসিল ঘোষণার অপ্রতুলতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা এবং নাগরিক সচেতনতার অভাব—সব মিলিয়ে দেশের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। এখনই প্রয়োজন সকলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষ—সবার সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দেশে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের পরিবেশ ফিরবে।
আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট
[email protected]
এমআরএম