ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

মিশিগানে যেমন আছেন বাংলাদেশি অভিবাসীরা

প্রকাশিত: ০৬:০১ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০১৭

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীদের আগমনের শুরু প্রায় চার দশকের বেশি সময় আগে। বর্তমানে মিশিগানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।

চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-যাপনের খরচ সবদিক থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিশিগান রাজ্যে বাংলাদেশিদের আগমন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

মিশিগানের রাজ্যের ডেট্রয়েট এবং এর আশপাশের হ্যামট্র্যামাক, ওয়ারেন, স্টারলিং হাইটস, ট্রয়, রচেস্টার, রচেস্টার হিলস, ফারমিংটন, ফারমিংটন হিলস, নোভাই, নর্থভিল, কেন্টন, ডিয়ারবর্ন হাইটস, টেইলর, সাউথগেট, এন আরবার, ফ্লিন্ট, ল্যান্সিং, শাগিনাও, গ্রান্ড রাপিড ও বে সিটির প্রায় সবখানেই রয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। এসব কমিউনিটির বাংলাদেশিদের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।

সংখ্যার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে সর্বাধিক বাংলাদেশি আমেরিকানদের বসবাস। নতুন অভিবাসীদের কাছে প্রথম পছন্দ নিউইয়র্ক। কিন্তু বর্তমানে বাসা ভাড়া, বাড়ির উচ্চমূল্য, জীবন-যাপনের খরচের কারণে নিম্নআয়ের অভিবাসীদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে মিশিগান। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে টেক্সাস, আলাবামা, ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের অনেক প্রকৌশলীও মিশিগানে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর ডেট্রয়েটের পাশের হ্যামট্র্যামাক শহরে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অভিবাসীদের বসবাস। এ শহরে বাংলাদেশিদের মতো পোল্যান্ড ও ইয়েমেনের অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক।

Misigan

এ কমিউনিটিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ও ঐক্যের কারণে বর্তমানে কাউন্সিল সদস্যের ছয়জনের মধ্যে তিনজনই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এমনকি, একক প্রার্থী দেয়া সম্ভব হলে পরবর্তী নির্বাচনে বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্য থেকে মেয়র নির্বাচিত হবার সম্ভাবনাও প্রবল।

বাংলাদেশের সঙ্গে দূরত্ব ও পরিবেশের বিস্তর ফারাক থাকলেও হ্যামট্র্যামাক শহরে তা বুঝে ওঠা কঠিন। এখানে রয়েছে বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্ট, মনোহারি দোকান, মসজিদ, হাফেজি মাদরাসা, মন্দির, স্কুল, ড্রাইভিং স্কুলসহ অনেককিছু। এ অঞ্চলের ১০টি মসজিদের সাতটির তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন বাংলাদেশিরা।

শহরে বেশকিছু বুটিকসের দোকানে বাংলাদেশি শাড়ি ও পোশাক পাওয়া যায়। ঈদ আর পূজায় প্রতিটি সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আমেজে মেতে ওঠে এ শহর।

এদিকে, শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’ নামে। এছাড়া গত বছর মিশিগানের গভর্নর রিক স্নাইডার শহরটিকে ‘বাংলা টাউন’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি এ শহরের নির্বাচনের ব্যালট পেপার ছাপা হয় বাংলায়।

এখানে বসবাসরত বাংলাদেশিরা প্রধানত ব্যবসায়ী। অনেকেই গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তবে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা পড়াশোনা শেষে চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হচ্ছেন।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় একটি অংশের বসবাস হ্যামট্র্যামাকের পাশের শহর ওয়ারেনে। বিশ্বখ্যাত জেনারেল মোটরসের ওয়ার্ল্ড টেকনিকেল সেন্টার এই শহরে। এই সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি প্রকৌশলীর সংখ্যা শতাধিক। এখানে গড়ে ওঠেছে যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী এবং তারা বাংলাদেশি অভিবাসী।

এ শহরে রয়েছে বহু মসজিদ, যেগুলোর অধিকাংশের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এছাড়া বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে মন্দির।

ওয়ারেন শহর লাগোয়া দুই শহর স্টারলিং হাইটস ও ট্রয় শহরেও রয়েছে বাংলাদেশিদের বড় কমিউনিটি। উত্তর আমেরিকাতে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি এখানেই। এছাড়াও বেশ কিছু বাংলাদেশি চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীদের বসবাসও এখানে। সেইসঙ্গে রয়েছে বাংলা স্কুল ও প্রকৌশলীদের সংগঠন।

তবে এ শহরে বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়মূল্য বেশ উচ্চহারের। তা সত্ত্বেও এখানে সম্প্রতি বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। ট্রয় শহরে বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধায়নে মসজিদ রয়েছে। উন্নত স্কুল ব্যবস্থাপনার কারণে এই শহর বাংলাদেশিদের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে।

রচেস্টার ও রচেস্টার হিলস শহরেও বাংলাদেশিদের বসবাস বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। এ শহরে অধিকাংশ বাংলাদেশি গাড়ি নির্মাণ ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তবে রয়েছে বেশকিছু চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী পরিবারও। এখানে রয়েছে বাংলাদেশি হালাল মাংস ও খাবারের দোকান এবং বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে মসজিদ।

গ্রেটার ডেট্রয়েটের পশ্চিম প্রান্তের শহর ফারমিংটন, ফারমিংটন হিলস, নোভাই ও নর্থভিল শহরেও বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের একটি বড় অংশের বসবাস। এসব শহরে বাংলাদেশি ছাড়াও প্রচুরসংখ্যক ভারতীয়, পাকিস্তানি ও জাপানি অভিবাসীদের বাস। তাই রয়েছে অনেক দেশি খাবারের রেস্টুরেন্ট, যেগুলোর অধিকাংশ বাবুর্চি বাংলাদেশি।

এ শহরগুলোতে মসজিদ ও মন্দির ছাড়াও রয়েছে বেশ উন্নতমানের স্কুল। তবে এখানকার বাড়ি ভাড়া ও বাড়ির মূল্য বেশ উচ্চহারের। এ শহরগুলোতে বেশকিছু দেশীয় মনোহরি দোকান রয়েছে।

ক্যান্টন ও এন আরবার শহরেও বাস করেন অনেক বাংলাদেশি। এদের অধিকাংশই কাজ করেন স্থানীয় গাড়ি ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। কেউ কেউ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি। এ শহরগুলোতে আরও রয়েছে মসজিদ ও ইসলামিক স্কুল।

Misigan

ফোর্ড গাড়ি প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান ও সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাসিন্দাদের বসবাসের কারণে আলোচিত শহর মিশিগানের ডিয়ারবর্ণ। তবে এখানে বাড়ছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা। পাশের ডিয়ারবর্ন হাইটস, টেইলর, সাউথগেট মিলে বাংলাদেশি শতাধিক পরিবারের বসবাস এখানে।

ল্যান্সিং মিশিগান অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। এখানকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছেন জনাবিশেক বাংলাদেশি ছাত্র। এছাড়া ল্যান্সিং, মেসন, হল্ট শহরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের কমিউনিটির পদচারণা চোখে পড়ার মতো।

গ্র্যান্ড র্যাপিড শহর এবং পাশের হল্যান্ড, জিল্যান্ড, বিগ র্যাপিড মিলে বেশ বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি। কলকাতার বাংলাভাষীদের নিয়ে এখানে প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বাংলাদেশিরা। তবে ভারতীয় কিছু গ্রোসারি দোকান থাকলেও বাংলাদেশিদের কোনো দোকা-পাট নেই এখানে।

ফ্লিন্ট শহরে বাংলাদেশিদের বসবাস বেশ আগে থেকেই। এখানে বাস করেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখানকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বাংলাদেশিদের জন্য রয়েছে আরবের হালাল মাংসের দোকান, বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মন্দির।

শাগিনাও, মিডল্যান্ড, বে সিটি মিলে বেশ বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। এদের অধিকাংশ গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এখানে বসবাস করেন কিছু বাংলাদেশি চিকিৎসক। এদের মধ্যে ডা. দেবাশিষ মৃধা গতবার অঙ্গরাজ্যের সিনেটর পদে নির্বাচন করেন। এছাড়াও শাগিনাও ভ্যালি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অন্যতম শক্তি ডেমোক্র্যাটিক দলের বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক ককাস (বিএডিসি) এ রাজ্যে বেশ সক্রিয়। এছাড়া দল নিরপেক্ষ সংগঠন বাংলাদেশি আমেরিকান পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (ব্যাপাক) বাংলাদেশি অভিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, মিশিগানে বাংলাদেশিদের অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে রয়েছে প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেকচার (আবিয়া)’, চিকিৎসকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা’, ইমামদের সংগঠন ‘ইমাম সমিতি’ এবং অনেক জেলা সমিতি। এছাড়াও মিশিগানে বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন রয়েছে।

মিশিগানের প্রবাসী বাংলাদেশি ও সেখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মিশিগানেও রয়েছে সব রকম নাগরিক সুবিধা, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুযোগ। যার সবকিছুতেই মেলে নিখাদ বাংলাদেশি সমাজের বৈশিষ্ট্য।

এখানে বাংলাদেশিদের জন্য মসজিদ, মন্দিরসহ দেশীয় রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট ও দেশীয় বুটিক হাউস রয়েছে। সম্প্রতি কিছু পরিবার বাণিজ্যিকভাবে দেশীয় শাকসবজি চাষ শুরু করেছেন।

অন্যদিকে, দেশের মতোই বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবসগুলো ঘটা করেই পালন করেন এখানকার অভিবাসী বাংলাদেশিরা। চাকরি, ব্যবসা, পড়াশোনা ও নানা কারণে পরবাসী হলেও বাংলাদেশের ভালো খবরে উল্লাসে মাতেন এখানকার বাংলাদেশিরা। আবার খারাপ খবরে হৃদয় কাঁদে সবার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিজয়ে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ আয়োজন এখনকার নিত্য ঘটনা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে সবসময় মনে ধারণ করা মিশিগানের বাংলাদেশি অভিবাসীরা নিজেদের বাংলাদেশি আমেরিকান পরিচয়ে গর্বিত।

এসআর/জেডএ/আরআইপি

আরও পড়ুন