গায়েবের ওপর ইমান
গায়েবের ওপর ইমান। ছবি: ক্যানভা
ইফতেখারুল হক হাসনাইন
কোরআনে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যারা গায়েবের ওপর ইমান আনে, নামাজ কায়েম করে, আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, যারা ইমান আনে ওই কিতাবের ওপর যা আপনার প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং সেই কিতাবগুলোর ওপরও যা আপনার আগে (অন্য নবীদের ওপর) নাজিল করা হয়েছিল, আর তারা আখেরাতেও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। (সুরা বাকারা: ৩-৪)
এ আয়াতে মুত্তাকিদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে—‘গায়েব বা অদেখা বিষয়ের ওপর ইমান আনা।’ ওলামায়ে কেরাম বলেন, অদেখা বলতে বোঝায় সেইসব বিষয় যা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায় না এবং সরল যুক্তি দিয়েও ধরা যায় না। যেমন আল্লাহর সত্তা, ফেরেশতাগণ, জান্নাত-জাহান্নাম, কেয়ামত, আসমানি কিতাব, নবীদের নবু্য়্যত, তকদির, মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান, আখেরাতের হিসাব-নিকাশ ও শাস্তি-পুরস্কারের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি (রহ.) বলেন, আবু মুসলিম (রহ.) ইসফাহানি লিখেছেন, গায়েবের ওপর ইমান আনার আরেক অর্থ হলো, যেমন তারা (মুমিনগণ) প্রকাশ্যে রাসুলের সামনে ইমান প্রকাশ করে, তেমনই তার অনুপস্থিতিতেও একইভাবে ইমান রাখে। তারা মুনাফিকদের মতো নয়, যারা মুমিনদের সামনে বলে, আমরা ঈমান এনেছি। কিন্তু নিজেদের সাথী শয়তানদের কাছে গিয়ে বলে—আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি, মুসলমানদের সঙ্গে শুধু মজা করছি। (সুরা বাকারা: ১৪)
অর্থাৎ প্রকৃত মুমিনের বাহ্যিক প্রকাশ আর অন্তর একই রকম হয়। আর মুনাফিকদের অন্তর তাদের বাহ্যিক অবস্থার বিপরীত হয়। আল্লাহ বলেন, তারা মুখে যা বলে, তাদের অন্তরে তা থাকে না। (সুরা আলে ইমরান: ১৬৭)
সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের ইমানের অবস্থা নিয়ে সবসময় চিন্তা করতেন। তারা শুধু কথা ও কাজের মিল রাখতেন না, বরং অন্তরের অবস্থা ও মনে আসা চিন্তাভাবনাও পরীক্ষা করতেন। প্রকৃত ইমান হলো কথা ও কাজে যেমন সামঞ্জস্য থাকবে, অন্তর ও বাহ্যিক অবস্থাও এক হবে।
এক হাদিসে এসেছে, হজরত হানজালা (রা.) বলেন, একবার আমরা রাসুলের মজলিসে ছিলাম। তিনি জান্নাত-জাহান্নামের এমন বর্ণনা দিলেন, মনে হলো যেন আমরা চোখে দেখছি। কিন্তু ঘরে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে সেই ভাব কেটে গেল। তখন আমার মনে হলো আমি তো মুনাফিক হয়ে গেছি!
তিনি হজরত আবু বকরের (রা.) কাছে গিয়ে নিজের অবস্থা বললেন। আবু বকর (রা.) বললেন, আমার অবস্থাও তো এ রকমই। তারপর তারা দুজন নবীজির (সা.) কাছে গেলেন। নবিজি (সা.) বললেন, হানজালা! তুমি যদি সব সময় সেই অবস্থায় থাকতে, তাহলে ফেরেশতারা রাস্তায়-ঘরে এসে তোমাদের সঙ্গে হাত মেলাত। কিন্তু এ অবস্থা সবসময় থাকে না। (সুনানে ইবনে মাজা: ৪২৩৯)
প্রকৃত মুমিন গায়েব বা অদেখা বিষয়সমূহ ততটাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, যতটা বিশ্বাস করে চোখে দেখা বিষয়সমূহ। তাই তারা গুনাহের কথা চিন্তাও করতে পারে না। যেমন একজন সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কখনও আগুনে হাত দেয় না, কারণ সে জানে আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। সাপের কাছে যায় না কারণ সে জানে সাপ ছোবল দিলে মৃত্যু অনিবার্য। একইভাবে যে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে জানে ও বিশ্বাস করে গুনাহ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে, সে কীভাবে গুনাহ করতে পারে!
একবার হারিস বিন মালিক (রা.) রাসুলের (সা.) সামনে এলে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, হারিস! আজ সকালে তুমি কেমন আছ? তিনি বললেন, আমার অবস্থা এখন প্রকৃত মুমিনের মতো।
নবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ইমানের প্রমাণ কী? তিনি বললেন, আমি দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে গেছি। আমার রাত ইবাদতে কাটে, দিন কাটে রোজা রেখে। এমন অবস্থা হয়েছে, মনে হয় আমি আমার রবের আরশ দেখছি, জান্নাতিদের সাক্ষাৎ করতে দেখছি আর জাহান্নামিদের আর্তনাদ শুনছি।
নবী (সা.) বললেন: হারিস! তুমি ইমানের আসল স্বাদ জেনে গেছ, এখন এটাকে আঁকড়ে ধরো। (তাবরানি)
লেখক: মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মাকবুলিয়া মাদরাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা
ওএফএফ