নারীদের সঙ্গে নবীজির (সা.) আচরণ, শিক্ষণীয় কিছু দৃষ্টান্ত
মসজিদে নববি, ছবি: পিক্সাবে
ইলিয়াস মশহুদ
নবীজি (সা.) পরিবারের নারীদের সঙ্গে যেমন উত্তম ব্যবহার করতেন, তেমনই তার চমৎকার ব্যবহার ছিল সমাজের অন্য নারীদের সঙ্গেও। মাঝে মাঝে নারীদের সঙ্গে রসিকতাও করতেন তিনি। এখানে আমরা নারীদের সঙ্গে নবীজির (সা.) আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।
নারীদের শিক্ষক হিসেবে নবীজি (সা.)
রাসুলের যুগে নারীরা ছিলেন জ্ঞানানুরাগী ও স্বাধীনচেতা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক কোনো বিষয়ে নারীরা রাসুলকে (সা.) সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন। ঋতুস্রাব, যৌনকামনা বা একান্ত বিষয়েও জিজ্ঞেস করতেন অকপটে, যেসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে এ যুগের নারীরাও সংকোচবোধ করেন। নারী সাহাবিরা সঠিক মাসআলা জানার জন্য প্রশ্ন করতেন আর রাসুলও অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদের কথা শুনতেন এবং সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
নবীজি (সা.) নারীদের জ্ঞান অর্জন ও জানার আগ্রহকে উৎসাহিত করতেন। তিনি মদিনার আনসারি নারীদের প্রশংসায় বলতেন, আনসার নারীরা কতই-না উত্তম! দীনের জ্ঞানার্জনে লজ্জা কখনো তাঁদের বিরত রাখতে পারে না। (আবু দাউদ: ৩১৬)
নারী সাহাবিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দ্বীন শিক্ষার জন্য পৃথক দিন নির্ধারণ করেছিলেন রাসুল (সা.)। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত; নারীরা একবার বললেন, আল্লাহর রাসুল, পুরুষেরা আপনার কাছে প্রাধান্য পাচ্ছেন সবসময়, তাই আমাদের জন্য পৃথক একটি দিন ঠিক করে দিন, যেদিন শুধু নারীরাই শিখতে পারবেন আপনার কাছে। তখন নবীজি (সা.) তাঁদের জন্য বিশেষ একটি দিনের ওয়াদা করলেন। সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের (বিভিন্ন বিষয়ে) উপদেশ ও নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি: ১০১)
কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না
হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত একবার এক বৃদ্ধা নবীজির (সা.) কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর কাছে দুআ করুন, আমি যেন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। নবীজি (সা.) বললেন, মা, কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
বর্ণনাকারী বলেন, নবীজির (সা.) এই জবাব শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিলেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, তাঁকে বলে দাও, তুমি বৃদ্ধা অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করব আর তাদেরকে করব কুমারী। (সুরা ওয়াকিয়া: ৩৬, শামায়েলে তিরমিজি: ১৭)
নারী সাহাবির সরলতায় নবীজির (সা.) হাসি
আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রিফাআ আল-কুরজি (রা.) এক সময় তার স্ত্রীকে তালাক দেন। স্ত্রী ইদ্দত পালন শেষে আবদুর রাহমান ইবনে জুবায়েরের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের কিছুদিন পর একদিন তিনি বিষণ্ন মনে নবীজির (সা.) দরবারে উপস্থিত হন। সেখানে তখন আবু বকর ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) উপস্থিত ছিলেন। এদিকে অনুমতির অপেক্ষায় দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন সাআদ ইবনে আসও (রা.)। সেই নারী সাহাবি তখন কোনো রাখঢাক না রেখে সবার সামনেই নবীজিকে (সা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি রিফাআর স্ত্রী ছিলাম। তিনি আমাকে তিন তালাক দেন। ইদ্দত পালন শেষে আবদুর রাহমান ইবনে জুবায়েরের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝতে পারি, তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম, আমার হক আদায়ে অপারগ।
এইটুকু বলে তিনি চাদরের এক কোণ ধরে ইশারায় নবীজিকে (সা.) কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন। খালিদ (রা.) তা দেখে আবু বকরকে (রা.) বললেন, আপনি এই মহিলাকে ধমক দিচ্ছেন না কেন? সে তো হাতের ইশারায় নবীজিকে (সা.) অপ্রীতিকর কিছু বোঝাতে চাচ্ছে!
নবীজি (সা.) খালিদের কথা শুনে মুচকি হেসে ওই নারী সাহাবিকে বললেন, তুমি হয়তো তোমার আগের স্বামীর কাছে ফিরতে চাইছ, কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। কারণ তুমি এখন তাঁর জন্য বৈধ নও। হ্যাঁ, একটি পথ আছে তা হলো, তোমাদের দুজনের মধ্যে (নতুন স্বামীর সঙ্গে) পূর্ণরূপে সহবাস হতে হবে (তারপর বর্তমান স্বামী তোমাকে ইচ্ছা করে তালাক দিলে ইদ্দত পালন শেষে তবেই রিফাআর সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে)। (সহিহ বুখারি: ৬০৮৪, সহিহ মুসলিম: ১৪৩৩)
উম্মে হারাম বিনতে মিলহানের মেহমান নবীজি (সা.)
রাসুল (সা.) যখন কুবায় যেতেন, তখন উম্মে হারাম বিনতে মিলহানের (রা.) মেহমান হতেন। তিনি ছিলেন উবাদা ইবনে সামিতের (রা.) স্ত্রী। একদিন নবীজি সেই ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, হঠাৎ তিনি হাসতে হাসতে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। উম্মে হারাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন হাসছেন? নবীজি (সা.) বললেন, আমি আমার উম্মতের একদল মুজাহিদকে দেখলাম, তারা সিংহাসনে বসা রাজা-বাদশাহর মতো গভীর সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। উম্মে হারাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, দোয়া করুন, আমিও যেন সেই দলে থাকি।
উম্মে হারাম বলেন, তখন নবীজি (সা.) আমার জন্য দোয়া করে আবারও ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আবার হাসতে হাসতে জেগে ওঠেন। এবারও আমি তার হাসির কারণ জানতে চাইলে নবীজি বললেন, আমি আমার উম্মতের একদল মুজাহিদকে দেখলাম তারা রাজকীয় অবস্থায় সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। উম্মে হারাম বলেন, আমি পুনরায় বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, দোয়া করুন, আমিও যেন সেই দলে থাকি। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি প্রথম দলের সঙ্গে থাকবে।
এরপর মুআবিয়ার ( রা.) যুগে এই স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। সে সময় উম্মে হারাম তার স্বামী উবাদার সঙ্গে সেই সমুদ্র-অভিযানে অংশ নেন। কিন্তু ফিরে আসার সময় বাড়ি পৌঁছার আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে শাহাদাত বরণ করেন। (সহিহ বুখারি: ৬২৮৩)
ওএফএফ/এএসএম