জ্ঞানসাধক সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)
জ্ঞানসাধক সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ছবি: ক্যানভা
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) আল্লাহর রাসুলের (সা.) চাচা আব্বাসের (রা.) সন্তান অর্থাৎ সম্পর্কে তিনি ছিলেন রাসুলের (সা.) চাচাতো ভাই; যদিও বয়সে ছিলেন নবীজির (সা.) অনেক ছোট। তার বাবা আব্বাস (রা.) নবীজির (সা.) চাচা হলেও প্রায় সমবয়সী ছিলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের জন্ম হয়েছিল নবীজির (সা.) নবুয়্যত লাভ করারও দশ বছর পরে। নবীজির (সা.) সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর।
জন্ম, পরিবার ও ইসলাম
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস জন্মগ্রহণ করেন আবু তালিব উপত্যকায়, নবীজির (স.) হিজরতের তিন বছর আগে। মক্কার মুশরিকরা তখন বনু হাশিম গোত্রকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করেছিল। নবীজি (সা.), তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সবারই দিন কাটছিল অনাহারে অর্ধাহারে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে গাছের পাতা ও পশুর চামড়াও খেতে হচ্ছিল তাদেরকে। এই কঠিন সময়ে আব্বসের (রা.) ঔরসে, উম্মুল ফজল লুবাবা বিনতে হারেসের গর্ভে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস জন্মগ্রহণ করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বাবা নবীজির (সা.) চাচা আব্বাস (রা.) তার জন্মের সময় প্রকাশ্যে মুসলমান না হলেও তিনি ছিলেন নবীজির (সা.) প্রধান সহযোগীদের অন্যতম। হিজরতের আগে মক্কায় যে কোনো বিপদে, প্রয়োজনে তিনি নবীজির (সা.) পাশে থাকতেন। হিজরতের পরও মক্কার মুশরিকদের গতিবিধি ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের সংবাদ নবীজি (সা.) তার থেকেই পেতেন। মক্কা বিজয়ের আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) মা উম্মুল ফজল (রা.) নবীজির (সা.) নবুয়্যত লাভের পরপরই ইমান আনেন। তিনি প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী নারীদের অন্যতম। ঐতিহাসিক ইবনে সা’দের বর্ণনা অনুযায়ী হজরত খাদিজার (রা.) পর উম্মুল ফজলই নারীদের মধ্যে প্রথম ইমান আনেন।
তাই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের জন্মই হয়েছিল ইসলাম ও তাওহিদের ওপর, জন্মগতভাবেই তিনি ছিলেন মুসলমান।
নবীজির (সা.) সান্নিধ্য ও দোয়া
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নবীজির (সা.) জীবনের শেষ দিকে তার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তখন তিনি যত বেশি সময় সম্ভব নবীজির (সা.) সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। নবীজির (সা.) প্রত্যেকটা কথা তিনি শুনতেন ও মনে রাখতেন। নবীজিকে (সা.) বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। অল্প কিছু দিনের সান্নিধ্যে দ্বীনি জ্ঞানে নবীজির (সা.) দীর্ঘ সান্নিধ্যপ্রাপ্ত অনেক সাহাবিকে তিনি ছাড়িয়ে যান।
নবীজি (সা.) তার জন্য দোয়া করেছিলেন আল্লাহ তাআলা যেন তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদিন নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করতে গেলেন, তখন আমি তার জন্য অজুর পানি রাখলাম। তিনি ফিরে এসে অজুর পানি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে রেখেছে? নবীজিকে (সা.) জানানো হলো, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এই অজুর পানি রেখেছে। নবীজি (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করুন! (সহিহ বুখারি)
হিবরুল উম্মাহ ইবনে আব্বাস (রা.)
নবীজির (সা.) ওফাতের পরও তিনি অধ্যাবসায়ের সঙ্গে জ্ঞান অর্জন ও চর্চা অব্যাহত রাখেন। এক পর্যায়ে তিনি সাহাবিদের মধ্যে প্রাজ্ঞ আলেমদের অন্যতম হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। বড় বড় সাহাবিরাও বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন, তার মতামত জানতে চাইতেন।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রা.) খেলাফতকালে তিনি তার পরামর্শসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। অনেক সময় প্রবীণ সাহাবীদের মতের ওপরও তিনি তার মতামতকে অগ্রাধিকার দিতেন। প্রবীণ কয়েকজন সাহাবি একদিন বললেন, আপনি আমাদের সন্তানদের কেন ডাকেন না, যেমন ইবনে আব্বাসকে ডাকেন? তখন ওমর (রা.) উত্তর দিলেন, সে হলো তরুণদের মধ্যে প্রবীণ, তার জিজ্ঞাসু জিহ্বা আছে এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ হৃদয় আছে। তারপর তিনি প্রবীণদের প্রশ্ন করলেন এবং ইবনে আব্বাসকেও প্রশ্ন করলেন। ইবনে আব্বাস তাদের চেয়ে ভালো উত্তর দিলেন। তখন ওমর (রা.) তাদের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা কেন আমাকে এমন উত্তর দিতে পারছেন না যেমন এই তরুণ দিচ্ছে—যার মাথার চুলও এখনও পুরোপুরি গজায়নি?
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার সম্পর্কে বলেছেন, ইবনে আব্বাস হিবরুল উম্মাহ অর্থাৎ উম্মতের বিদগ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তি।
রঈসুল মুফাসসিরীন ইবনে আব্বাস (রা.)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কোরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অতুলনীয় জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য রাখতেন। নবীজির (সা.) কোরআনের তাফসির সংক্রান্ত বক্তব্য পরবর্তী মুফাসসিররা তার সূত্রে সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন। এ ছাড়া তিনি কোরআনের বক্তব্যের গভীর অর্থ ও মর্ম অনুধাবনও করতে পারতেন। এ কারণে তাকে ‘রঈসুল মুফাসসিরীন’ অর্থাৎ কোরআনের ব্যাখ্যাকারদের সর্দার এবং ‘তরজুমানুল কুরআন’ অর্থাৎ কোরআনের ব্যাখ্যাকার উপধিতে স্মরণ করা হয়।
হাদিস বর্ণনাকারী ইবনে আব্বাস (রা.)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবীদের অন্যতম। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনির (রহ.) মতে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ১৬৬০টি, অনেকের মতে ২৬৬০টি। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে যৌথভাবে তার বর্ণিত ৯৫ টি হাদিস সংকলিত হয়েছে, এককভাবে সহিহ বুখারিতে ১২০টি এবং সহিহ মুসলিমে ৪৯টি হাদিস সংকলিত হয়েছে।
ইন্তেকাল
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন । আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের শাসনামলে ৬৮ হিজরি, ৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তায়েফে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়্যা তার জানাজায় ইমামতি করেন। তায়েফেই তিনি সমাহিত হন।
ওএফএফ