ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

তারাবির আলোচনা

কোরআনের হেদায়েত পাবেন যারা

ইসলাম ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:০৩ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২৩

১৪৪৪ হিজরির রমজান মাসের প্রথম তারাবিহ আজ। আজকের তারাবিতে সুরা ফাতিহা থেকে সুরা বাকারার ২০৩ আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে। হাফেজে কোরআনদের তেলাওয়াতে কোরআনের হেদায়াত পাবেন যারা, তাদের কথা ওঠে আসবে। হেদায়েত প্রাপ্ত লোকদের এ গুণগুলো কী?

আজকের তারাবির শুরুতেই ৬টি গুণ উল্লেখ করা হবে। যে গুণগুলোর কারণেই কোরআন থেকে হেদায়াত পাবেন মুমিন মুসলমান। সুরা বাকারার শুরুতেই মুমিনের সে গুণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

الم - ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ - والَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ  - أُوْلَـئِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘আলিফ লাম মিম; এটি সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি পরহেজগারদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী। যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রিজিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার আগের (নবিদের) প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত আর তারাই যথার্থ সফলকাম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২-৫)

আজ ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার প্রথম তারাবিহ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে শুক্রবার থেকে রহমতের মাস রমজান শুরু হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলসহ বিশ্বের অনেক দেশে আজ রমজানের প্রথম রোজা পালিত হয়েছে।

আজ এশার নামাজের পর থেকেই দেশের সব মসজিদে শুরু হবে রমজান মাসের প্রথম তারাবিহ। আজকের তারাবিহ নামাজের শুরুতেই সেসব গুণের বিবরণ পড়া হবে; যেসব গুণ অর্জন করতে পারলেই কোরআনে হেদায়েতে আলোকিত হবে মুমিন।

তারাবিহ নামাজের প্রথম রাকাআতে হাফেজে কোরআনগণ ঘোষণা করবেন-

الم - ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

‘আলিফ লাম মিম; এটি সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি পরহেজগারদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী।

নিঃসন্দেহে কোরআনুল কারিম মহান আল্লাহর কিতাব। যেটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্ভুল সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এ কিতাবই মানুষের সঠিক পথ প্রাপ্তির একমাত্র উপায়।

কোরআন থেকে হেদায়েত পাওয়ার শর্ত

মহাগ্রন্থ আল-কোরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে কয়েকটি মৌলিক গুণ শর্ত মানতে হবে। যা শুরুতেই বলা হয়েছে। আর তাহলো-

. আল্লাহকে ভয়কারী ‘মুত্তাকি’

প্রথম গুণটি হলো- মুত্তাকি তথা আল্লাহকে ভয় করা। ‘মুত্তাকিন’ শব্দটি ‘মুত্তাকি’-এর বহুবচন। মুত্তাকি শব্দের মূল ধাতু তাকওয়া। তাকওয়া হলো, নিরাপদ থাকা, নিরাপত্তা বিধান করা। শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, বান্দা যেন আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, আর তা করতে হলে যা করতে হবে তা হলো, তাঁর নির্দেশকে পুরোপুরি মেনে নেওয়া, এবং তাঁর নিষেধকৃত বস্তুকে পুরোপুরি ত্যাগ করা। আর মুত্তাকি হলেন তিনি, যিনি আল্লাহর আদেশকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে এবং তার নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। (ইবনে কাসির)

বর্ণিত আছে যে, হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। উবাই বললেন, কীভাবে চলেছেন? উমর বললেন, কাপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। উবাই বললেন, এটাই হলো, তাকওয়া।’ (ইবনে কাসির)

তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাকিগণকে কেন হেদায়েত প্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলত মুত্তাকিরাই আল্লাহর কোরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারেন, অন্যান্য যারা মুত্তাকি নন তারা হেদায়াত লাভ করতে পারেন না। যদিও কোরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন। আর পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ। আল্লাহ বলেন-

اِنَّ هٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَهۡدِیۡ لِلَّتِیۡ هِیَ اَقۡوَمُ وَ یُبَشِّرُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ اَجۡرًا کَبِیۡرًا

‘নিশ্চয়ই এ কোরআন হেদায়েত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: আয়াত ৯)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ কোরআন তাদের জন্য হেদায়েত যারা হেদায়েত চেনার পর তা গ্রহণ না করার শাস্তির ভয়ে সদা কম্পমান। আর তারা তাঁর কাছ থেকে যা এসেছে তার সত্যায়নের মাধ্যমে রহমতের আশাবাদী। (তাফসিরে ইবনে কাসির ও আত-তাফসিরুস সহীহ)

তাছাড়া হেদায়েতের কোনো শেষ নেই, মুত্তাকিরা সর্বদা আল্লাহর নাজিল করা হেদায়েতের মুখাপেক্ষী বিধায় হেদায়েতকে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে অন্যান্য আয়াতে কোরআনকে সমস্ত মানবজাতির জন্য হেদায়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে এর অর্থ হলো, হেদায়েতের পথ তাদের দেখাতে পারে যদি তারা তা থেকে হেদায়েত নিতে চায়।

সুতরাং কোরআনের বিধান অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনা করা। এই ঐশী গ্রন্থ আসলে সমস্ত মানুষের হেদায়াত এবং পথ প্রদর্শনের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এই নির্ঝরের পানি দ্বারা কেবল তারাই সিক্ত হবে, যারা ‘আবে হায়াত’ (সঞ্জীবনী পানি)-এর সন্ধানী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। আর যাদের অন্তরে মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার অনুভূতি এবং চিন্তা নেই, যাদের মধ্যে সুপথ সন্ধানের অথবা ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার কোনোই উৎসাহ ও আগ্রহ নেই, তারা সুপথ কোথা থেকে এবং কেনই বা পাবে?

২. অদৃশ্যে  বিশ্বাসী

কোরআন থেকে উপকার পাওয়ার জন্য দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে অদৃশ্যে বিশ্বাস করা। ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বলতে এমন গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে; যা মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত এবং কখনও সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। যেমন-

‘মহান আল্লাহর সত্তা, তাঁর অহি (প্রত্যাদেশ), জান্নাত ও জাহান্নাম, ফেরেশতা, কবরের আজাব এবং মৃত দেহের পুনরুত্থান ইত্যাদি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত এমন কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের অংশ; যা জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। আর তা অস্বীকার করা কুফরী ও ভ্রষ্টতা।

এ সত্যগুলো না দেখে মেনে নেওয়া এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলোর খবর দিয়েছেন বলে তাঁর খবরের সত্যতার প্রতি আস্থা রেখে এগুলোকে মেনে নেওয়াই হচ্ছে ‘ইমান বিল গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস।

এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থ হচ্ছে- অদৃশ্য বিষয়গুলো অনুভব করা যায় না- এমন বিষয়গুলো সত্য বলে যে ব্যক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত হবে; একমাত্র সেই কোরআনের হেদায়েত ও পথনির্দেশনা থেকে উপকৃত হতে পারবে।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অদৃশ্য বিষয়গুলো মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখার বা ঘ্রাণ নেওয়ার কিংবা স্বাদ আস্বাদন করার শর্ত আরোপ করবে এবং যে ব্যক্তি বলে, আমি এমন কোনো জিনিস মেনে নিতে পারি না যা পরিমাণ করা ও ওজন করা যায় না; এমন ব্যক্তিও কোরআন থেকে হেদায়াত ও পথনির্দেশনা পাবে না।

. নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী

কোরআনের হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। এর অর্থ হলো- যারা কোরআনের নির্দেশ মেনে নিয়ে বসে থাকবে তারা কোরআন থেকে উপকৃত হবে না। বরং মেনে নেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে সে নির্দেশনার আনুগত্য করা এবং তা কার্যকর করাই হচ্ছে কোরআন থেকে উপকৃত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

সালাত বা নামাজ-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা বা দোয়া। শরিয়তের পরিভাষায় সে বিশেষ ইবাদাত, যা মানুষের কাছে ‘নামাজ’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। কোরআনুল কারিমে যতবার নামাজের তাগিদ দেওয়া হয়েছে - সাধারণতঃ ‘ইকামত’ শব্দের দ্বারাই দেওয়া হয়েছে। নামাজ আদায়ের কথা শুধু দু'এক জায়গায় বলা হয়েছে। এ জন্য ইকামাতুস সালাত (নামাজ প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। ‘ইকামত’ এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণত যেসব খুঁটি, দেওয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকে। এজন্য ‘ইকামত’ স্থায়ী ও স্থিতিশীল অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

কোরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় ইকামাতুস সালাত অর্থ, নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্তাদি ও নিয়মাবলী রক্ষা করে নামাজ আদায় করা। শুধু নামাজ আদায় করাকে ‘ইকামাতুস সালাত বলা হয় না। নামাজের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কোরআন হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই ‘ইকামাতুস সালাত’ (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন- কোরআনুল কারিমে আছে-

اُتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَذِکۡرُ اللّٰهِ اَکۡبَرُ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ

‘তোমার প্রতি যে কিতাব ওহি করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর এবং নামাজ কায়েম কর। নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৪৫)

বস্তুত: নামাজের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন নামাজ উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অনেক নামাজ আদায়কারীকে অশ্লীল ও নক্ক্যারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মৰ্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা নামাজ আদায় করেছে বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি।

সুতরাং নামাজকে সবদিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হবে। ইকামত অর্থে নামাজে সকল ফরজ-ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়।

তাছাড়া নামাজ সময়মত আদায় করা। নামাজের রুকু, সেজদা, তেলাওয়াত, খুশু, খুযু ঠিক রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত। (ইবনে কাসির)

ফরজ-ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল প্রভৃতি সকল নামাজের জন্য একই শর্ত। এক কথায় নামাজে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরিয়তের নিয়মানুযায়ী আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইকামতে সালাত বা নামাজ প্রতিষ্ঠা। তন্মধ্যে রয়েছে - জামাতের মাধ্যমে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা। আর তা বাস্তাবায়নের জন্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকির ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তাআলা ইসলামী কল্যাণ-রাষ্ট্রের যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তার মধ্যে নামাজ কায়েম করাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের অন্যতম কর্ম বলে ঘোষণা করে বলেন-

اَلَّذِیۡنَ اِنۡ مَّکَّنّٰهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَ اَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ نَهَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لِلّٰهِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ

‘(এরা হল) যাদেরকে আমি জমিনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে নিষেধ করে, সকল কাজের শেষ পরিণাম (ও সিদ্ধান্ত) আল্লাহর ইখতিয়ারে।’ (সুরা হজ: আয়াত ৪১)

পরিশেষে, বাস্তবে আনুগ্ত্য দেখানোর অন্যতম ও স্থায়ী নিদর্শন হচ্ছে নামাজ। ঈমান আনার পর সময় অতিবাহিত হতে না হতেই মুয়াজ্জিন নামাজের জন্য আজানের মাধ্যমে আহ্বান জানালে, ঈমানের দাবিদার ব্যক্তি আনুগত্য  করতে প্রস্তুত কিনা তার ফয়সালা তখনই হয়ে যায়।

শুধু নিজে নিজে নামাজ পড়া নয়; সামষ্টিগতভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠা করাই আয়াতের অর্থের অন্তর্ভূক্ত। যখন মানুষ নামাজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হবে তখনই মানুষ কোরআন থেকে পাবে হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা।

. আল্লাহর পথে ব্যয়কারী

কোরআনের হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, আল্লাহর দেওয়া জীবিকা থেকে তারই পথে  খরচ করা। সংকীর্ণমনা বা অর্থলোলুপ না হয়ে মানুষকে হতে হবে আল্লাহ ও তার বান্দার অধিকার আদায়কারী। আল্লাহ যে সম্পদ দিয়েছেন তা অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া।

তার সম্পদে আল্লাহ এবং বান্দার যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে তাকে তা আদায় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে বিষয়ের ওপর ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তার ওপর ঈমান আনাও অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করা। আর তাতে কোরআন থেকে উপকৃত হবে বিশ্বাস স্থাপনকারী।

আল্লাহর পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফরজ জাকাত, ওয়াজিব সদকা এবং নফল দানসদকা প্রভৃতি যা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসির তাবারি) কোরআনে সাধারণত ইনফাক নফল দান-সদকার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফরজ জাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে 'জাকাত' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুত্তাকিদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে গায়েবের উপর ঈমান, এরপর নামাজ প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

. আসমানি কিতাবে বিশ্বাসী

কোরআন হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা পেয়ে উপকৃত হওয়ার পঞ্চম শর্ত হচ্ছে কোরআনসহ সব আসমানি কিতাবের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং কোরআনের বিধানগুলো মেনে চলা। এ শর্তটি মেনে চলার কারণে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায়- যারা আল্লারহ পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিধান আসার প্রয়োজনীয়তাকে আদতে স্বীকারই করে না কিংবা প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করলেও এজন্য ওহি বা নবুয়তের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না; তারা বের হয়ে যায়। এ প্রকৃতির লোকেরা কোরআন থেকে হেদায়াত পাবে না।

এখানে মুত্তাকিদের এমন আরও কতিপয় গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল গায়েব এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরও একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে মুমিন ও মুত্তাকি দুই শ্রেণির লোক বিদ্যমান ছিলেন। এক শ্রেণি তারা যারা প্রথমে মুশরিক ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অন্য শ্রেণি হলেন যারা প্রথমে আহলে-কিতাব ইহুদি-নাসারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। পূর্ববতী আয়াতে প্রথম শ্রেণির বর্ণনা ছিল। এ আয়াতে দ্বিতীয় শ্রেণির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাই এ আয়াতে কোরআনের প্রতি ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাস করার কথাও বলা হয়েছে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী এ দ্বিতীয় শ্রেণির লোকেরা যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোনো না কোনো আসমানি কিতাবের অনুসারী ছিলেন, তারা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হবেন।’ (বুখারি ৩০১১, মুসলিম ১৫৪)

প্রথমত: কোরআনের প্রতি ঈমান এবং আমলের জন্য, দ্বিতীয়ত: পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে ঈমান আনার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, সেগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসের বিষয় হবে, কোরআনের আগে আল্লাহ তাআলা যেসব কিতাব নাজিল করেছেন, সেগুলো সত্য ও হক এবং সে যুগে এর উপর আমল করা ওয়াজিব ছিল। আর এ যুগে কোরআন নাজিল হবার পর যেহেতু অন্যান্য আসমানি কিতাবের হুকুম-আহকাম এবং পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহ মনসুখ হয়ে গেছে, তাই এখন আমল একমাত্র কোরআনের আদেশানুযায়ীই করতে হবে। (ইবনে কাসির)

. পরকালে বিশ্বাসী

কোরআন থেকে হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার সব শেষ শর্তটি হচ্ছে পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। শুধু মৌখিকভাবে পরকালে বিশ্বাসী হলে চলবে না। পরকালে বিশ্বাসীদের আবার এ বিষয়গুলোও মেনে নিতে হবে-

- এ দুনিয়ায় কোনো মানুষই দায়িত্বহীন জীব নয়। বরং নিজের সব কাজের জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।

- দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা চিরন্তন নয়। এক সময় এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সে সময়টা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

- এ দুনিয়া শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা আর একটি দুনিয়া তৈরি করবেন। সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষের জন্ম হয়েছে সবাইকে সেখানে একই সঙ্গে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। সবাইকে একত্র করে তাদের কর্মকাণ্ডের হিসাব নেবেন। সবাইকে তার কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন।

- আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে এবং অসৎলোকেরা নিক্ষেপিত হবে জাহান্নামে।

মনে রাখতে হবে

বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রকৃত মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহ তাআলা শেষ বিচারের দিন যে ব্যক্তির মুক্তি পাবে সেই হচ্ছে সফলকাম। আর সেখানে যে মুক্তি পাবে না সে ব্যর্থ।

আজকের তেলাওয়াতকৃত অংশের বিষয়গুলোকে ১০টি পর্বে ভাগ করে আয়াতের বিষয়বস্তুগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তাহলো-

প্রথম পর্ব : (আয়াত ১-২৯)

>> মুত্তাকিদের পথনির্দেশিকা, সফলতা পাওয়ার শর্ত ও পরিচয়; >> কাফেরদের পরিচয় এবং >> মুনাফিকের পরিচয়। (১-২০)

>> সমগ্র মানবজাতির প্রতি ইবাদাতের আহ্বান; >> কোরআনের সন্দেহপোষণকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ; >> মুমিনদের জন্য জান্নাতের বর্ণনা; >> আল্লাহর অবাধ্যকারী কাফের-ফাসেকদের ক্ষতিগ্রস্তের বিবরণ  (২১-২৯)।

দ্বিতীয় পর্ব (আয়াত ৩০-৩৯)

>> মানুষের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা ও হজরত আদম আলাইহিস সালামের খিলাফাত (৩০-৩৩);

>> হজরত আদম আলাইহিস সালামের মর্যাদা ও সম্মান; >> হজরত আদম আলাইহিস সালামকে দুনিয়া প্রেরণ; >> আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান; >> গোনাহ থেকে তাওবার শিক্ষা এবং >> ইবলিসের (শয়তানের) পতন (৩৪-৩৯)।

তৃতীয় পর্ব : (আয়াত ৪০-৭৪)

>> ইয়াহুদিদের ইতিহাস; >> মুসলমানদের দুর্দশা ও তার কারণ; >> আল্লাহর দ্বীন জমিনে বাস্তবায়নের প্রস্তুতি (৪০-৪৬)

>> অকৃতজ্ঞ ইয়াহুদি জাতির বর্ণনা (৪৭-৬৪); >> ইয়াহুদিদের হঠকারিতা (৬৫-৬৬)

>> কোরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক গরু (গাভী) যবেহের বর্ণনা (৬৭-৭৪)

চতুর্থ পর্ব : (আয়াত ৭৫-১০৩)

>> ইয়াহুদিদের হিদায়াতে তৎকালীন মুমিনদের অবস্থার বর্ণনা (৭৫-৭৭)

>> ইয়াহুদি প্রসঙ্গ : বনি ইসরাঈলের ইতিবৃত্ত (৭৮-৮০)

>> মানুষের পাপ-পূণ্যের বিচার (৮১-৮২)

>> ইয়াহুদিদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ (৮৩-৮৭)

>> বিশ্বনবির সঙ্গে ইয়াহুদিদের প্রতারণা (৮৮-৯৩)

>> পরকালের সফলতা লাভে ইয়াহুদিদের গলাবাজি (৯৪-৯৬)

>> জিব্রিল আলাইহিস ও বিশ্বনবির সঙ্গে ইয়াহুদিদের শত্রুতা পোষণ (৯৭-৯৮)

>> বিশ্বনবির প্রতি কুরাআন নাজিল ও তাঁর সত্যয়ন (৯৯-১০১)

>> ইয়াহুদিদের জাদু বিদ্যা বা জাদু প্রীতি (১০২-১০৩)

পঞ্চম পর্ব : (আয়াত ১০৪-১২৩)

>> ইয়াহুদিদের শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণ (১০৪-১০৫)

>> কোরআনের আয়াত রহিত সম্পর্কিত ব্যাখ্যা (১০৬-১০৮)

>> ইয়াহুদিদের ষড়যন্ত্র (১০৯)

>> মুসলমানের চেতনাকবোধ জাগ্রত (১১০)

>> ইয়াহুদিদের প্রতিপক্ষ নাসারাদের গলাবাজি (১১১-১১২)

>> ইয়াহুদি-খ্রিস্টান পরস্পরের ঝগড়া (১১৩)

>> কিবলা পরিবর্তনে ইয়াহুদিদের অপপ্রচার (১১৪-১১৫)

>> ইয়াহুদি-খ্রিস্টান-মুশরিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাস (১১৬-১১৮, ১২০-১২১)

>> নির্ভেজাল তাওহিদের ঘোষণা (১১৯)

>> অন্যদের সঙ্গে ঈমান সবচেয়ে বড় আদর্শিক সংঘাত (১২২-১২৩);

ষষ্ঠ পর্ব : (আয়াত ১২৪-১৪১)

>> হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম মুসলিম মিল্লাতের ইমাম বা নেতা; >> বাইতুল্লাহ বা কাবা ঘর নির্মাণ; >> বাইতুল্লাহ নির্মাণকাল হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া (১২৬-১২৮)

>> রাসুল প্রেরণে দোয়া (১২৯)

>> হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বংশধরদের আলোচনা (১৩০-১৪১)।

সপ্তম পর্ব : (আয়াত ১৪২-১৫৭)

>> জাতীয় ঐক্যের প্রতীক কিবলা পরিবর্তনের রহস্য আলোচনা; >> মুসলিম জাতির গুণ ও পরিচয় এবং অমুসলিমদের কার্যাবলী; >> বিশ্বনবির নবুয়ত; >> আল্লাহর শুকরিয়ার সঠিক ধারণা ও প্রাসঙ্গিকতা; >> ধৈর্য ও নামাজ দ্বারা আল্লাহর সাহায্য লাভ; >> ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা ও শহিদের মর্যাদা;

অষ্টম পর্ব : (আয়াত ১৫৮-১৭৭)

>> সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নির্দশন; >> সত্য গোপনকারী অবিশ্বাসী নেতাদের ভয়াবহ পরিণতি ও হুশিয়ারি; >> তাওহীদের মূলনীতি, ঈমানি চিন্তাধারা, হালাল-হারাম সম্পর্কিত কোরআনি নীতিমালা; >> পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণের কুপ্রভাব; >> ইবাদাত-বন্দেগিতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

নবম পর্ব : আয়াত ১৭৮-১৮৮

>> ইসলামে কিসাস বা হত্যাকারীর শাস্তির বিধান; >> মুক্তিপণের সময়সীমা; >> অসিয়তের বিধান; >> রোজা বিধান, শিক্ষা ও তাৎপর্য; >> সেহরি খাওয়ার বিধান; >> ই’তিকাফের বিধান; >> আল্লাহর কাছে বান্দার সাহায্য কামনার আদেশ; >> অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ ও তার বিধান;

দশম পর্ব : আয়াত : ১৮৯-২০৩

>> চাঁদের আবির্ভাব, ক্রমবৃদ্ধি ও ক্রমহ্রাসের বিবরণ; >> কুসংস্কারের মুলোৎপাটন; >> পবিত্র মাসসমূহে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ; >> জিহাদে লক্ষ্য উদ্দেশ্য, বিধান; >> আল্লাহ পতে ব্যয়; >> হজ ও ওমরা বিধি-বিধান; >> হজের সমাপ্ত পর্বের আলোচনা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন কারিম বুঝে পড়ার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জিকেএস

আরও পড়ুন