সুরমার ঘাটে ঘাটে, স্কুলগুলোর সামনে ময়লাবাহী গাড়ি-ডাস্টবিন!
সিলেট সিটি করপোরেশনের ময়লার স্তূপ
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ময়লা-আবর্জনাবাহী গাড়িগুলো আগপাছ না ভেবেই রাখা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সামনে। নগরের বুক চিড়ে প্রবাহমান সুরমা নদীতে ফেলা হচ্ছে পচা সবজি ও গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা।
ফলে নদীর ঘাটে ঘাটে ময়লার স্তূপ। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের কারণে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও অস্বস্তি বিরাজ করছে।
মঙ্গলবার দুপুরে নগর ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলগুলোর সামনে যেন নির্মাণ করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন! ফলে স্কুলে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে দুর্গন্ধে নাকাল হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাদের ভোগান্তির পাশাপাশি উৎকট দুর্গন্ধ স্কুলগুলোর শিক্ষার পরিবেশ দূষিত করছে। কিন্তু এসব ডাস্টবিন সরিয়ে নিতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
নগরের বাগবাড়িতে সিলেট সিটি করপোরেশন পরিচালিত বর্ণমালা স্কুলের সামনে তিন রাস্তার মোড়ে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছোট ছোট ময়লা-আবর্জনাবাহী ভ্যানগাড়ি রাখা হয়। এখান থেকে দুপুরে সিটির ময়লাবাহী ট্রাকে ময়লা সরানো হয়। এর পাশেই রয়েছে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রও।
ফলে এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী জনসাধারণ ও স্কুলশিক্ষার্থীরা দুর্গন্ধের কারণে চরম দুরর্ভোগের শিকার হন।
নগরের কালীঘাট লালদিঘিরপাড় এলাকার সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় দেখা গেছে, স্কুলের সামনে ও পেছনে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। প্রধান ফটকের সামনে সিলেটের প্রধান পাইকারি বাজার কালীঘাটের ময়লা-অবর্জনা স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
সকাল-সন্ধ্যা না মেনে সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়ি যখন তখন এখান থেকে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন ভোগান্তির মধ্যে পড়ে, একইভাবে নষ্ট হয় স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ।
স্কুলের পেছনে রয়েছে লালদিঘিরপাড় হকার্স মার্কেট। কালীঘাটে সবসময় ভারী মালবাহী যানবাহন চলাচল করায় দুর্ঘটনা এড়াতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা স্কুলের পেছনের রাস্তাটি ব্যবহার করেন। কিন্তু স্কুলের পেছনের সড়কে লালদিঘিরপাড় হকার মার্কেটের ময়লা-আবর্জনা ফেলে স্তূপ করে রাখায় এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

লালদিঘিরপাড় হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, তারা নিজেরা টাকা দিয়েও সময়মতো ময়লা-আবর্জনা সরাতে পারছেন না।
এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পেছনের গেটটি পাইলট স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ একটি গেট। ওই গেটের সামনে মার্কেটের সব ময়লা ফেলা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তরকারি বিক্রেতাদের ফেলা আবর্জনা। কিন্তু ময়লা-আবর্জনা যথাসময়ে সরিয়ে না নেওয়ায় স্থানটি রীতিমতো ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
শুধু পাইলট স্কুল নয়, নগরের বন্দরবাজার দুর্গাকুমার সরকারি পাঠশালার সামনেও একই অবস্থা। ডাস্টবিনের আবর্জনার গন্ধে স্কুলে পাঠের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এলাকার লোকজন স্কুলের সামনে থেকে ডাস্টবিন সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানালেও এখনও সিটি করপোরেশন তা সরায়নি।
শিক্ষার্থীরা তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যে নাক-মুখে রুমাল চাপা দিয়ে চলাচল করছে। এছাড়া শহরের মীরাবাজার মডেল হাইস্কুল, পুলিশ লাইন্স উচ্চবিদ্যালয়, বেসরকারি কারা প্রাথমিক বিদ্যালয়, রায়নগর জালালাবাদ বিদ্যানিকেতনের সামনেও দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন।
সুরমা নদীর পাড় ঘুরে দেখা গেছে, ঘাটে ঘাটে পচা সবজি ও গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা স্তূপ হয়ে আছে। স্তূপে প্লাস্টিকের খালি বোতল থেকে শুরু করে পলিথিন, কলার কাঁদিসহ পরিত্যক্ত সামগ্রী পড়ে আছে। ময়লার স্তূপের পাশেই ঘাট। সেখানে আবর্জনার দুর্গন্ধের মধ্যেই গোসল করছেন স্থানীয় লোকজন।
নগরের বুকে প্রবহমান সুরমা নদীর মেন্দিবাগ এলাকার মাছিমপুর ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। শুধু মাছিমপুরই নয়, নগরের ৯টি ঘাট ঘুরে একই রকম চিত্র পাওয়া গেছে। সুরমার ঘাটে ঘাটে ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব।
এসব ময়লা–আবর্জনা গিয়ে মিশছে সুরমার পানিতে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে, দূষিত হচ্ছে নদী। এতে ঘাট দিয়ে চলাচল করা মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সিলেট নগরে সুরমার ঘাটগুলো হচ্ছে নগরের মেন্দিবাগ এলাকার মাছিমপুর ঘাট, কালীঘাট, ঝালোপাড়া, কদমতলি, চাঁদনীঘাট, তোপখানাঘাট, কাজীরবাজার, শেখঘাট ও কানিশাইল ঘাট।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, মাছিমপুর, কালীঘাট, শেখঘাট ও কদমতলী এলাকার ঘাটগুলোতে ব্যবসায়ীরা পচা ফল, সবজি, মাছ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট এবং পরিত্যক্ত ময়লা–আবর্জনা নদীর তীরে ফেলে দূষণ সৃষ্টি করছেন। এসব এলাকায় দিনরাত সমানতালে প্রকাশ্যেই ময়লা–আবর্জনা ফেলা হচ্ছে।
কালীঘাট এলাকায় ব্যবসায়ীরা একটি শৌচাগার তৈরি করে সেটি নদীর সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন, যাতে শৌচাগার থেকে সরাসরি মানববর্জ্য নদীতে গিয়ে মিশছে। সিটি করপোরেশন থেকে নজরদারি এবং ডাস্টবিন না থাকায় এমন দূষণ চলছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন।
ঘাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কালীঘাটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, পচা পেঁয়াজ, আলু, প্লাস্টিকের নানা সামগ্রী, হোটেল-রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট ময়লা–আবর্জনার স্তূপ। পাশেই একটি শৌচাগার থেকে ময়লা পানি গড়িয়ে নাদীতে গিয়ে মিশছে। এতে ঘাটে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। সুরমা নদী পার হয়ে কালীঘাটে ভিড়ছে নৌকা। এসব ময়লা–আবর্জনা পেরিয়ে নাক চেপে যাতায়াত করতে দেখা গেছে লোকজনকে।
কদমতলী ঘাটে পচা ফল, প্লাস্টিকের সামগ্রী ও ঝুড়ি ফেলে রাখতে দেখা গেছে। এছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে সুরমা নদের তীরে, চাঁদনীঘাট ও তোপখানা ঘাটে বিভিন্ন দোকানপাটের ময়লা–আবর্জনা, হোটেল-রেস্তোরাঁর আবর্জনা, খাবারের উচ্ছিষ্ট, সুপারির খোসা, কলার কাঁদি, প্লাস্টিকের সামগ্রীর ময়লার স্তূপ।
কাজীরবাজার এবং শেখঘাটে পচা সবজি এবং মাছের উচ্ছিষ্ট ফেলে দেওয়ায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এছাড়া শেখঘাটে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্লাস্টিকের মোড়ক, পচা উচ্ছিষ্ট ঘাটের পাশে ফেলা হচ্ছে। ঘাটসংলগ্ন খোলা স্থানে প্রস্রাব-পায়খানা করায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
কালীঘাট এলাকার ব্যবসায়ী রতন রায় বলেন, বাজারে কোনো ডাস্টবিন নেই। সেজন্য ব্যবসায়ীরা ঘাটেই ময়লা ফেলছেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ডাস্টবিন সরবরাহ কিংবা স্থান নির্ধারণ করে দিলে ব্যবসায়ীরা যত্রতত্র কেউ ময়লা ফেলতেন না।

দক্ষিণ সুরমা এলাকার বাসিন্দা সোহেল আহমদ বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই দুই দফা কালীঘাটে নৌকায় যাতায়াত করি। ময়লা–আবর্জনার কারণে এ পথ দিয়ে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কালীঘাট এলাকাটি ব্যবসায়ীদের প্রসিদ্ধ এলাকা। এ ঘাটের এমন অবস্থা দেখে মনে হয় দেখার মতো কেউ নেই। এতে যেমন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের নজরদারি প্রয়োজন, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা হানিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ক্লাবগুলোর ছোট ছোট ঠেলাভ্যান দিয়ে স্কুলগুলোর সামন থেকে ময়লা-আর্বজনা সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে রাখা হচ্ছে। তবে দিনের বেলা রাখার কথা নয়। তারপরও যদি কেউ রাখে তাহলে আমি ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, দিনের বেলা নগরের ওয়ার্ডভিত্তিক ময়লা-আবর্জনা সিটি করপোরেশনের ৫০-৬০টি গাড়িতে পরিবহন করা হয়। তবে রাত ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ময়লা টানার পিকআওয়ার। ওই সময় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) ও নগরের হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং বাজারগুলো থেকে ময়লা পরিবহন করা হয়।
সুরমা নদীতে ময়লা ফেলা প্রসঙ্গে হানিফুর রহমান বলেন, কালীঘাট ও কাজীরবাজার এলাকায় নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য একাধিকবার আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করেছি; তারপরও ময়লা ফেলা বন্ধ হচ্ছে না।
সিসিকের এই পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা জানান, কিনব্রিজ থেকে নিচে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে আর আমরা পরিষ্কার করছি। কোনোভাবেই ময়লা ফেলা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
তিনি নদীতে ময়লা না ফেলার জন্য নগরবাসীকে বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে বুধবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে মুঠোফোনে কল করে সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা হানিফুর রহমান জানান, আজ সকালে কালীঘাট থেকে কাজীরবাজার এবং শেখঘাট এলাকা থেকে কানিশাইল খেয়াঘাট পর্যন্ত ময়লা-আর্বজনা পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে। শতাধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে সুরমার তীর পরিষ্কার করার কয়েকটি ছবিও পাঠান তিনি। স্কুলগুলোর সামনেও এখন থেকে ময়লাবাহী গাড়ি ও ময়লা রাখা যাবে না বলে জানান সিসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা।
এসএইচএস/জিকেএস