ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ডিজিটাল দুনিয়ায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ বিচরণ

ইসমাইল হোসাইন রাসেল | প্রকাশিত: ০৬:২৮ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২

সামিউল ইসলাম (ছদ্মনাম), বয়স বড়জোর ছয় বছর। ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রামে পরিবারের সঙ্গে তার বসবাস। সবে ভর্তি হয়েছে স্কুলে। হঠাৎ তার কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। ভিডিওতে শিশু সামিউলের মুখে প্রেমের উক্তি ও অযাচিত সব মন্তব্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ করে উপস্থাপিত হচ্ছে শিশু সামিউল। চলছে সাইবার বুলিং। ভালোমতো পড়তে না জানা সামিউল নিজেই বোঝে না, ভিডিওতে সে কী ধরনের সংলাপ বলছে। মূলত তাকে দিয়ে এসব ভিডিও বানাতো তার বড় ভাই। সে নিজেও একজন কিশোর। অর্থাৎ নিজেদের অজান্তেই শিশু-কিশোর বয়সী এ দুই ভাইয়ের ডিজিটাল দুনিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বিচরণ।

সামিউলের মামা মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামিউলকে নিয়ে তার বড় ভাই ভিডিওগুলো বানাতো এবং ফেসবুকে শেয়ার করতো। সেখান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এনিয়ে তার বাবা-মা ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা নিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে তাদের কটু কথা শুনতে হয়েছে। এখন ভিডিও বানানো বন্ধ। ওর পরিবার এখন ভিডিও বানাতে দেয় না।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষ শিশুটাকে দেখতে চলে আসতো। ওর বয়স খুব কম, ছয় বছর হবে। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ওর বড় ভাই, যে ভিডিওগুলো বানিয়েছে সে নবম শ্রেণির ছাত্র। করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দুই ভাই মিলে ভিডিওগুলো বানিয়েছে। সামিউল তো আর বোঝে না, মূলত স্মার্টফোন হাতে পেয়ে ওর বড় ভাই না বুঝেই ভিডিগুলো বানায়।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, শিশুরা কখনো প্রেমের সংলাপ বলে প্রেমিক-প্রেমিকা, কখনো পাড়ার মাস্তানসহ নানা চরিত্রে অভিনয়ের চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার খেলনা অস্ত্র হাতে ভিডিওতে সত্যিকার খলনায়ক সাজার চেষ্টা করছে। শিশুদের দিয়ে বানানো এসব ভিডিও-অডিও কনটেন্টকে মজারছলে লাইক-শেয়ার করছেন অনেকে। ফলে ভিউয়ার (দর্শক) পাওয়ার নেশায় আরও বেশি ভিডিও তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিশুরা। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও শিশুদের এসব কনটেন্ট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করছেন। শিখিয়ে দিচ্ছেন সংলাপ, যা অধিকাংশই নেতিবাচক। এসব সংলাপ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই শিশুর। এতে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে অনেককে।

জানতে চাইলে অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘কে ট্রল করছে বা না করছে, সেটা কিন্তু মূল বিষয় নয়। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানে শিশুদের নিয়ে নানা ধরনের অডিও-ভিডিও তৈরি হচ্ছে। সেগুলো যিনি করছেন, তাকে মাথায় রাখতে হবে এগুলো শিশুবান্ধব হচ্ছে কি না। নিজেদের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য এমন কিছু করা যাবে না, যা দিন শেষে শিশুকে ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের নিয়ে কোনো কাজ করা হলে, সেটা শিশুবান্ধব হতে হবে। শিশুর বয়স অনুযায়ী তার মুখ থেকে সে ধরনের কথা বা বক্তব্য প্রত্যাশা করি। যারা শিশুদের দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন, তারা সেটুকু সচেতন হয়ে কাজটি করবেন। শিশুর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা রেখেই এটি করতে হবে।’

jagonews24

ঘরের কোণে বসেও বিশ্ব দেখছে শিশুরা

তিনি বলেন, ‘যারা শিশুদের নিয়ে ট্রল করছেন, অশ্লীল কমেন্ট করছেন, তাদের সচেতন হতে হবে। মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলতে বলবো না। কে আজেবাজে মন্তব্য করবে, সেজন্য তো মাটির তলায় ঢুকে থাকতে পারি না। যারা অসামাজিক কাজে ব্যস্ত, তাদের নিজেদের সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কে, কী ধরনের কমেন্ট করছেন, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। তাহলে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে।’

শিশুর সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের কনটেন্ট ভাইরাল হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকে না। ফলে নিজের অজান্তেই ব্যঙ্গভাবে উপস্থাপিত হয় শিশুরা।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুর অজান্তেই তার অভিভাবক যেসব কনটেন্টে তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপন করছেন, সেটি সবসময় ইতিবাচক নাও হতে পারে। কখনো কখনো সেটি অতিমাত্রায় নেতিবাচক হতে পারে। ফলে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয় শিশুরা, যা শিশুর সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশুদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দীন আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের একটি আদব-কায়দা থাকতে হবে, যা শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্করাও মেনে চলবে। শিশুদের কোনো কনটেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হতে হবে। যাতে শিশুকে নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য বা সমালোচনা না হয়। বিষয়টি শিশুর মানসিক বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিরূপ মন্তব্য বা ট্রলের কারণে শিশুর সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে, তা দীর্ঘমেয়াদি হবে। তার ব্যক্তিত্বের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুর যেকোনো বিষয় তুলে ধরতে অধিকতর সতর্ক ও সংবেদনশীল হতে হবে।’

baby-on-sm_3.jpg

ডিজিটাল দুনিয়ায় মিলছে শিশুদের নানান ভিডিও

তিনি বলেন, ‘শিশুদের হাতে আমাদের ফোন তুলে দিতেই হবে। ফোন তুলে না দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ তাদের প্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করতে হবে। কিন্তু তার উপযুক্ত ও নিরাপদ ব্যবহারে প্রশিক্ষিত করতে হবে। এ দায়িত্বটা তার পরিবারের। ইন্টারনেটে কনটেন্ট তৈরির জন্য কোনো পলিসি তৈরির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। অভিভাবকরা পারিবারিকভাবে নিজেদের মতো পলিসি তৈরি করবে। এখানে সরকার বা রাষ্ট্রের গুরুত্ব কম। আমি বলবো, প্রত্যেক পরিবারে নিজস্ব যে সংস্কৃতি রয়েছে, সে অনুযায়ী একটি পলিসি তৈরি করতে হবে।’

শিশুদের দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কনটেন্ট

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরেন পথশিশু রানা। তার হিপ হপ গান ‘গলি বয় রানা’ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে, তা সবার নজর কাড়ে। এ গানে রানা তারা নিজের জীবন সংগ্রাম, স্বপ্ন এবং তার প্রতি সমাজের আচরণের কথা তুলে ধরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী তাবিব মাহমুদের হাত ধরে রানা এখন গানের তালে তালে পথশিশুদের জীবনকথা, সমাজের ব্যত্যয় আর সংস্কারের কথা তুলে ধরছেন, যা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

জানতে চাইলে তাবিব মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো শিশুকে নিয়ে নেতিবাচক কনটেন্ট তৈরি করলে পরে তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। হয়তো এখন সে ভালো-মন্দ বিচার করতে পারছে না। বুলিংয়ের শিকার হলে তো সবারই খারাপ লাগে। সেটা যে বয়সেই হোক না কেন। এটা পরে শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সে যখন বুঝতে শিখবে, সে কী ধরনের নেতিবাচক কথা বলেছে তখন খারাপ লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল সাইকোলজি বিষয়ক একটি সাবজেক্ট রয়েছে। সেখানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা শিশুদের এসব কার্যক্রম বিষয়ে অভিজ্ঞ। আমি যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা খুবই চমকপ্রদ বিষয় নিয়ে কাজ করছে।’

তাবিব আরও বলেন, ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটররা মোহে পড়ে যায়। তারা বোঝে শুধু ভিডিও দিতেই হবে। ফলে শিশুর ওপর যে মানসিক প্রভাব পড়ে, সেটি তারা বোঝেন না। আমি রানাকে নিয়ে যেসব ভিডিও করেছি, সেখানে এসব বিষয় লক্ষ্য রেখেই করেছি। ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। রানার মাধ্যমে কোনো ধরনের নেতিবাচক বার্তা যাতে সমাজে না যায়, সেদিকে সব সময় লক্ষ্য রেখেছি।’

শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করেন বিজ্ঞাপননির্মাতা শাহাদাত আলম খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে টেলিভিশন মিডিয়ার ক্ষেত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানে সেন্সরের বিষয় থাকে। এখানে যারা কনটেন্ট ক্রিয়েটর থাকেন, তারা সচেতনভাবে কাজটা করেন। শিশুদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা যে কনটেন্টের ওপর কাজ করে, সেই স্ক্রিপ্ট খুব গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করি। তাদের বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। পাশাপাশি নেতিবাচক বিষয় যেন না থাকে, সেদিকে সবসময় খেয়াল রাখি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটর থাকেন, তারা যেকোনো জায়গা থেকে কনটেন্ট তৈরি করেন। এটা যেহেতু ওপেন মিডিয়া, ফলে এখানে সেন্সর নেই। অথচ একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে কনটেন্ট তৈরির পরও গেটকিপার তার ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখেন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে কোনো গেটকিপার নেই। তারা ভিউয়ের জন্য ইন্টারেস্টিং কনটেন্ট বানাতে গিয়ে নেতিবাচকভাবে শিশুদের উপস্থাপন করে ফেলেন। এসব কনটেন্ট দেখতে ইন্টারেস্টিং হতে পারে। তবে শিশুদের নেতিবাচক উপস্থাপনের কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’

‘সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে কিছু সেন্সর থাকা দরকার। ফেসবুক যেমন কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে। শিশুদের কনটেন্টের ক্ষেত্রেও এটি করা উচিত। উপমহাদেশের দেশগুলোতে এ বিষয়গুলো দেখি, অন্য কোথাও সেটি নেই। উন্নত বিশ্বে শিশুরা অনেক ভালো সৃজনশীল কনটেন্ট তৈরি করে। সেখানে শিশুরা ইনফরমেশন ভিডিও ব্লগ, ট্রাভেল ব্লগ, খেলনার ভিডিও তৈরি করে। অথচ আমাদের দেশে অভিভাবকরাই বাচ্চাদের দিয়ে নেতিবাচক কনটেন্ট তৈরি করছে। এগুলো শিশুদের বয়সের সঙ্গে যায় না’ যোগ করেন তিনি।

baby-on-sm_3.jpg

তাবিবের হাত ধরে রানা এখন গানের তালে সমাজ সংস্কারের কথা বলছে

বিজ্ঞাপননির্মাতা শাহাদাত আলম খান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সরকারের সচেতন হওয়া উচিত। কারণ ফেসবুক বাংলাদেশের এ সমস্যা হুট করেই ধরতে পারবে বলে মনে করি না। তারা বিভিন্ন দেশের কালচারে এ সমস্যা দেখছে না। কিন্তু বাংলাদেশের এমন সমস্যা সমাধানে কিছু ভয়েজ রেইজ করা উচিত। তাহলে হয়তো বিষয়টি ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সার্ভিসের অথরিটির নজরে আসবে।

অন্য দেশের শিশুরা তৈরি করছে যেসব কনটেন্ট

শিশুরা একই রকম কাজ বারবার না করে নতুন নতুন কাজ করতে চায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুরা সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জোরালো করছে। অনেকক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড তাক লাগিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বে।

প্রবাসে বসবাসরতরা বলছেন, আমেরিকা-ইউরোপের মতো দেশে শিশুরা সৃজনশীল অনেক কনটেন্ট তৈরি করে। সেখানে সেভাবে পলিসি তৈরি করা না থাকলেও শিশুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় জোর দেওয়া হয়। ফলে হুট করেই নেতিবাচক হয় এমন কনটেন্ট তৈরি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ শিশুর হাতে ভালো মানের স্মার্টফোন রয়েছে। তবে তারা নেতিবাচক কিছু তৈরি করছে না। অল্প বয়সের অনেকে হয়ে উঠছেন প্রযুক্তি দুনিয়ার বিশেষজ্ঞ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় বসবাসরত সাফিন জাহিদ নিয়মিত তার আড়াই বছর বয়সী সন্তান ইখলাসের ভিডিও প্রকাশ করেন। ভিডিওতে ইখলাসের নিয়মিত মজার সব কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন তিনি। প্রবাসে থাকায় দেশে বসবাসরত পরিবারের মানুষ ও পরিচিতজনরা সেখানেই ইখলাসের দৈনন্দিন মজার কার্যকলাপ দেখেন।

জানতে চাইলে সাফিন জাহিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার সন্তান জন্মের পর করোনাসহ নানা কারণে এখনও দেশে আসতে পারিনি। সন্তানের কর্মকাণ্ডগুলো পরিবারের লোকজন দেখতে চায়। সেজন্য আমি সবসময় ওর ভিডিও করি। প্রতিদিন ইখলাসের ১০-১২টি ভিডিও করি, যার মধ্যে ১০-১১টি ভিডিও পরিবারের লোকজনের ম্যাসেঞ্জারে পাঠাই। বাকি একটি ভিডিও যদি একটু মজার হয়, সেটা ফেসবুকে আপলোড করি। আমারও তো দেশে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তারা ইখলাসের বেড়ে ওঠা দেখতে চান। তাই কিছু ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করি।’

তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান নিজের ইচ্ছায়ই যখন মজার কিছু করে, আমি সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা করি। কখনো আমিও মজা করে ওর সাথে কিছু ক্রিয়েট করছি। কিন্তু সেখানে নেতিবাচক কোনো মেসেজ থাকে না। সন্তানের সঙ্গে প্রত্যেক বাবা-মা এ খুনসুঁটি করে। শিশুদের সিকিউরিটি আগে থেকেই মাথায় রাখা উচিত। যে কোনো সময়, যে কোনো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে পারে। এটুকু মাথায় রাখা উচিত যে, সন্তানের ভিডিও করার পর সেটিতে যাতে নেতিবাচক কোনো বার্তা না থাকে। আমি সেটা মাথায় রেখেই ভিডিও করার চেষ্টা করি।’

নিউইয়র্কে বসবাসরত লেখক ও সাংবাদিক পারমিতা হিম। তিনি নিজেও একজন জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর। শিশুদের নিয়ে কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কনটেন্ট যেমনই হোক এর ইমপ্যাক্ট যেন শিশুদের জন্য ইতিবাচক হয়, এটা সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কনটেন্ট যেমনই হোক সেটা শিশু উপযোগী কি না এটা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা বড়দের অভিনয় করতে ভালোবাসে। বড়রাও শিশুদের করা এসব অভিনয় দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু বড়দের সব ভূমিকা কোনো শিশুর উপযোগী নয়। এগুলো শিশুদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। কোনো কনটেন্ট তৈরির আগে সেটি কোন বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য সেটা মাথায় রাখা দরকার। বিতর্কিত বিষয়, সহিংসতা, নির্যাতনের মতো ইস্যুগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত সতর্কতা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের প্রাইভেসির ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে ওই শিশু বুলিং/হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে পারে। যে কোনো ফর্মেই। কোনো কনটেন্টে শিশুদের ব্যবহারের আগে মাথায় রাখতে হবে ভবিষ্যতে এ কনটেন্টের কারণে শিশুটি কোনো ধরনের হেনস্তার শিকার হতে পারে কি না।’

শিশুদের কনটেন্টে কতটা সতর্ক ফেসবুক-ইউটিউব

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে প্রযুক্তিতে। বাংলাদেশেও ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে বহুগুণ। ফলে হাতের নাগালেই মোবাইল-ট্যাবের মতো ডিভাইস পাচ্ছে শিশুরা। সময় কাটানোর উপায় হিসেবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের ওপর, বানাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো শিশুদের এসব কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারের ক্ষেত্রে কতটা সতর্ক ঘুরে ফিরে বারবার সেই প্রশ্ন উঠছে। তবে শিশুর জন্য অনুপযোগী কনটেন্ট প্রচারে নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও শিশুর অজান্তে তাকে নিয়ে যেসব নেতিবাচক কনটেন্ট প্রকাশ করা হয়, সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই ফেসবুক-ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের।

জানতে চাইলে ফেসবুকের (মেটা) এশিয়া প্যাসিফিক হেড অব সেফটি শিরীন ভাকিল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে হলে প্রত্যেকের কমপক্ষে ১৩ বছর বয়স হতে হবে। আমরা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অ্যাকাউন্টগুলো খুঁজে বের করে তা বন্ধ করতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছি। এছাড়া ব্যবহারকারীদের বয়স যাচাই করতে নতুন সমাধান খুঁজছি। আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে অন্যতম হলো- তরুণদের নিরাপদ রাখা। নীতির মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কোনো ধরনের হুমকি ও হয়রানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং তাদের ছবির গোপনীয়তা নিশ্চিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আমরা শিশুদের জন্য যৌননিগ্রহমূলক বা বিপজ্জনক এমন কনটেন্ট প্রকাশের অনুমতি দেই না।’

baby-on-sm_3.jpg

বাচ্চাদের বয়সের সঙ্গে যায় না এমন নেতিবাচক কনটেন্টও তৈরি হচ্ছে

তিনি বলেন, ‘যখন আমরা যৌননিগ্রহমূলক কোনো বিষয় জানতে পারি, সেটি ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেনের (এনসিএমইসি) কাছে রিপোর্ট করি। তাদের প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে বলি। এ প্ল্যাটফর্মে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন হয়েছে; এমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে দ্রুত আমাদের কাছে রিপোর্ট করা উচিত।’

এদিকে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা রক্ষায় অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইউটিউব। শিশুদের যৌন হয়রানিমূলক ও সাইবার বুলিংয়ের মতো বিষয়ে কঠোর অবস্থানে এ মাধ্যমটি। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে শিশুর জন্য অনুপযোগী ১১ লাখ ৮২ হাজার ৪০৩টি ভিডিও সরিয়ে মুছে দিয়েছে ইউটিউব।

ইউটিউব কর্তৃপক্ষ বলছে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক এবং তাদের সম্পর্কিত যৌন আবেদনমূলক ভিডিও প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয় না। শিশুদের যৌন হয়রানিমূলক কনটেন্টগুলো মুছে ফেলার পর সেগুলো আবার রিপোর্ট করা হয়। এছাড়া অনলাইন হয়রানি এবং সাইবার বুলিং বিষয়ে তাদের কঠোর নীতি রয়েছে। পর্নোগ্রাফির মতো অন্যান্য যৌনতাপূর্ণ বিষয়বস্তু প্রচার করতে দেওয়া হয় না।

শিশুর মানসিক সমস্যা সমাধানে ‘স্কুল সাইকোলজি’

শিশুরা বর্তমানে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠছে। একসময় শিশুদের জন্য মুঠোফোন ছিল অনেকটা দুর্লভ। তবে এখন সবচেয়ে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এ ডিভাইসটি। মুহূর্তেই দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে শিশুরা। ফলে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের জটিলতার মুখেও পড়ে তারা। শিশুর এ ধরনের মানসিক, সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করছে স্কুল সাইকোলজি। এর প্রধান লক্ষ্য শিশুদের সুস্থ পরিবেশে উন্নীত করার জন্য বাবা-মা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা এবং শিশুদের চাহিদার ওপর আলোকপাত করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে যে সমস্যা হবে, তা হবে স্কুলগামী শিশুদের মানসিক সমস্যা। এটার অনেক কারণ রয়েছে। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কাছে অভিভাবকরা সর্বোচ্চ জিপিএ প্রত্যাশা করছেন। তাদের ইমোশনাল, সোশ্যাল সমস্যা আমরা অ্যাড্রেস করছি না। স্কুল সাইকোলজিস্ট যারা হবে, তাদের কাজই হবে এ বিষয়টি অ্যাড্রেস করা। একটা ছেলে বা মেয়ের মানসিক সমস্যার উৎস কী, সে নিজে নাকি তার শিক্ষক, পরিবার নাকি তার কমিউনিটি; সেটা খুঁজে বের করতে হবে। এসব বিষয় অ্যাড্রেস করাই হবে স্কুল সাইকোলজিস্টের কাজ।’

নিজের অজান্তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশুর নেতিবাচক প্রচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমে দেখতে হবে সেই শিশুর পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক কাঠামো কী? কার সঙ্গে সে থাকছে? সে কী শিখছে এবং সেগুলো কীভাবে রিফ্লেক্ট করছে। ইমোশনাল ডিস্টার্ব্যান্স আছে কি না? মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষা রিফ্লেকশনের জন্য সে সুযোগ খোঁজে, সোশ্যাল মিডিয়া হয়তো তেমনই একটি সুযোগ।’

ঢাবিতে স্কুল সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আমিনুল ইসলাম। সম্প্রতি তিনি মনোবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কি না। শিশুরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় থাকে, সেটি যদি শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলে তখন তা নিয়ে আমরা কাজ করি।’

তিনি বলেন, ‘তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের নিয়ে নেতিবাচক কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, যেটা নিয়ে সে নিজেই অবগত নয়। যখন তার বিবেক-বুদ্ধি হবে, তখন তার ওপর সেটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে তাদের পরিবারের ভূমিকা অনেক বেশি। স্কুলে গেলেও সে বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। পোস্টের ওপর রিয়্যাক্টের দিকে নজর রাখেন অনেকে। বাংলাদেশের শিক্ষকরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের কীভাবে একাডেমিক শিক্ষা দেওয়া যায়। কিন্তু কাউন্সিলিং বা তাদের মানসিক স্ট্রাকচারে কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে শিক্ষাজীবনে প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে তারাও অবগত নন।’

শিশুদের দিয়ে কনটেন্ট তৈরিতে আইনি পদক্ষেপ

ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেন (এনসিএমইসি) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। তারা শিশু যৌন নির্যাতন বন্ধ, শিশু পর্নোগ্রাফি নির্মূলসহ শিশুদের অধিকারসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধন করা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান যেমন- ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট তাদের নেটওয়ার্কে শিশুদের যৌনকাজে ব্যবহার, যৌন নিপীড়নসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এনসিএমইসিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জানায়। গত বছর ডিসেম্বর থেকে এনসিএমইসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর থেকেই অভিযান চালাচ্ছে সংস্থাটি।

শিশুদের অজান্তে তাদের দিয়ে তৈরি নেতিবাচক কনটেন্ট প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ক্রাইম) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুকসহ অনলাইন মাধ্যমে অপরাধের ক্ষেত্রে আমরা শিশুদের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেই। ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে শিশুদের নিয়ে কোনো অপমান বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হয়, সেটি তারা মনিটর করে আমাদের অবগত করে।’

তিনি বলেন, ‘শুধু শিশুদের নিরাপদ রাখতে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। সেখানে যত ধরনের ডিজিটাল মাধ্যম আছে, তারা রিপোর্ট করতে বাধ্য। ফেসবুক, গুগল, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারেও এ ধরনের কোনো জিনিস এলে তারা রিপোর্ট করে। এ প্ল্যাটফর্মে কোনো শিশুকে অ্যাবিউজ, মিসইউজ বা অন্যান্য নেতিবাচক কনটেন্ট পেলে প্রতিষ্ঠানগুলো এনসিএমইসির কাছে রিপোর্ট দেয়। এনসিএমইসি যে দেশের কনটেন্ট সেই দেশের সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে থাকে। আমাদের দেশের জন্য সিআইডি হলো এ কাজের জন্য অথরাইজড প্রতিষ্ঠান। তারা এ ধরনের কনটেন্ট পেলে আমাদের কাছেই পাঠায়। সেগুলো নিয়ে গত বছরও আমরা কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, শিশুদের মনোবৃত্তি বিকাশে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপিয়ান কান্ট্রি শিশুদের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে। শিশু খেলারছলে আহত হলেও বাবা-মাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সিআইডির পক্ষ থেকে শিশুদের নিয়ে এসব কনটেন্ট খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখি। অভিভাবকদের অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। একজন শিশু তার বয়স অনুপাতে ভার্চুয়াল জগতে তার যে অ্যাক্টিভিটি সেটি অবশ্যই বাবা-মায়ের দেখতে হবে। কোনো বিচ্যুতি ঘটলে সন্তানকে বোঝাতে হবে।’

শিশুদের দিয়ে কনটেন্ট তৈরি নিয়ে যা ভাবছে সরকার

শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ রাখতে নজরদারি বাড়াতে বলছেন বিশ্লেষকরা। যেমন- শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো ধরনের বিপদে পড়ছে কি না, আসক্ত হয়ে পড়ছে কি না ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় বাবা-মা মনে করতেন, সন্তানরা সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলেই নিরাপদ। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে তারা যে বিশ্বের কোন অন্ধকার অলিগলিতে ঢুকে পড়ছে, সেটা বাবা-মা ডিজিটালি সচেতন না হলে ধরতেই পারবে না। ঘরে বসে সন্তান ডিজিটাল মাধ্যমে পৃথিবীর অন্ধকার গলি ঘুরে আসতে পারে। এক্ষেত্রে বাবা-মার সচেতনতা খুব জরুরি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় উইং) মো. মুহিবুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে শিশুদের কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই গাইডলাইন প্রয়োজন। এটি মূলত করবে আইসিটি বিভাগ। বিভিন্ন ফোরামে সেমিনারে বিষয়টি বলেছি। এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে আছে এবং যিনি ইউজার তার সতর্কতারও বিষয় রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক জায়গায় পারিবারিকভাবে শিশুরা পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই ভুল পথে যাচ্ছে। এটি অবশ্যই একটি সামাজিক অপরাধ। সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই এটি রোধ করতে হবে। এরপরও যদি এ ধরনের অপরাধ হয়, তাহলে অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিতে হবে। মন্ত্রণালয় থেকে আইসিটি মিনিস্ট্রি এবং জননিরাপত্তা বিভাগকে বিভিন্ন ফোরামে অনুরোধ করেছি এ বিষয়টি অ্যাড্রেস করার জন্য। আমরা সচেতনতামূলক কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি।’

এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছি। সেটা এখন অনলাইনে হচ্ছে। ৩৩৩-এ কল করলে অভিযোগগুলো যেন যাচাই-বাছাই করা যায়, কারণ শুধু আইনগত ব্যবস্থা নয়, সচেতনতা তৈরি এবং কিছু জায়গায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে চাই। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল লিটারেসি, সাইবার সিকিউরিটি, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট- এ তিনটি এরিয়ায় ম্যাসিভ আকারে ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম শুরু করছি।’

তিনি বলেন, ‘এতে প্রতিটা শিশু, কিশোর-কিশোরী এসব বিষয়ে সচেতন হতে পারে। বাবা-মা তাদের সন্তানদের একটু সঠিকভাবে দেখভাল করতে পারেন। শিক্ষকরাও তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের যেন গাইড করতে পারেন। এর সঙ্গে আমরা ফেসবুক এবং টিকটকের সঙ্গে বসেছিলাম। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিশু বা নারীদের প্রতি কোনো সহিংসতা বৃদ্ধি করে কিংবা অপমানজনক কোনো কনটেন্ট যাতে না থাকে সেজন্য আমরা একটা ডাটা অ্যানালিটিকাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে আলোচনা করেছি। অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।’

শিশুদের অজান্তেই তাদের নিয়ে তৈরি কনটেন্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিভাবকরা হয়তো মনে করছেন তাদের লাইক, শেয়ার বাড়ছে। হয়তো ভিডিওতে ক্লিকের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন থেকে কিছু টাকা পাবে বলে মনে করছেন। এ কারণে কোন কনটেন্ট নৈতিকভাবে সঠিক এবং কোনটা নৈতিকতাবিরোধী সেটা হয়তো ভুলে যান, এটা শিশুদের দোষ নয়। আমরা মনে করি, ব্যক্তি পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সচেতনতা দরকার।’

জুনাইদ আহমেদ পলক আরও বলেন, ‘একজন শিশু বা নারীর নৈতিকতাবিরোধী কনটেন্ট বা তার অসম্মতিতে অথবা তার অজান্তে তৈরি করা কনটেন্ট মিডিয়ায় আসাটা অপরাধ। একটা অল্পবয়স্ক শিশুকে দিয়ে যদি তার আত্মীয়, পরিবারের কেউ বা অন্য কেউ এমন কোনো কনটেন্ট তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে কিন্তু বয়সের কারণে হয়তো সে বুঝতে পারে না, এটা পরে তার জন্য কতটা মর্যাদাহানিকর হতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবার বা শিক্ষকদের সচেতনতা খুব দরকার।’

আইএইচআর/এএএইচ/এসএইচএস/এমএস