বাংলাদেশের ফুটবল
হামজার আগমন, ভারত বধ ও ব্যর্থতার বৃত্ত
বিদায়ী বছরে ফুটবল নিয়ে মানুষের বড় প্রত্যাশা ছিল। আর সেই প্রত্যাশার পারদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন হামজা দেওয়ান চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা থাকা লেস্টার সিটির এই ফুটবলার যখন বাংলাদেশের জার্সি পরার সিদ্ধান্ত নেন, তখন থেকেই ফুটবল ঘিরে শুরু হয় উন্মাদনা। মার্চে যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন, তাঁকে ঘিরে ফুটবলে যে উচ্ছ্বাস–উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল, তা মানুষের মনে বহুদিন গেঁথে থাকবে।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই শুরু হয়েছিল হামজার আগমনের বছর, শেষও ভারতের বিপক্ষেই। ২৫ মার্চ শিলংয়ে ভারতকে গোলশূন্যভাবে রুখে দিয়ে শুরু, আর ১৮ নভেম্বর ঢাকায় ১–০ গোলের জয় দিয়ে শেষ। ২২ বছর পর ভারতকে হারানোর স্বস্তি থাকলেও ব্যর্থতার বৃত্তেই আটকে ছিল দেশের ফুটবল। ৪৫ বছর পর বাংলাদেশকে এশিয়ার মঞ্চে দেখার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের মাঝপথেই নিশ্চিত হয়ে যায় বিদায়। এবারও হলো না বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের জন্য ২০২৫ সাল ছিল ফুটবলময় একটি বছর। নারী–পুরুষের জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দল মিলিয়ে বিদায়ী বছরে অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এসব ম্যাচের বেশিরভাগই ছিল এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের। এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই আসরের টিকিট পাওয়ার লড়াইয়ে বছরজুড়ে মাঠে নেমেছিল লাল–সবুজ জার্সিধারীরা। তবে সেখানে সফল হয়েছে কেবল নারীরাই। শুধু সফলই নয়, নারী ফুটবলে বিদায়ী বছরটি জোড়া ইতিহাসেরও জন্ম দিয়েছে।
১৯৮০ সালের পর পুরুষ ফুটবল দলের সামনে আবার এশিয়ান কাপ খেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল হামজা দেওয়ান চৌধুরী ও শামিত সোমের আগমনে। তবে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সফল হয়েছে কেবল নারী ফুটবলের বাছাই। জাতীয় দল ও অনূর্ধ্ব–২০ দলের নারী ফুটবলাররা বাছাইয়ের বাধা পেরিয়ে উঠেছে চূড়ান্ত পর্বে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে মেয়েরা এর আগে কখনো এশিয়ান কাপে খেলেনি। নতুন বছর ২০২৬ সালে প্রথমবারের মতো সেই মঞ্চে খেলবে বাংলাদেশ। এই জোড়া অর্জন এসেছে বিদায়ী বছরেই। আফঈদা খন্দকারদের হাত ধরে বাংলাদেশের নারী ফুটবল উঠে গেছে নতুন উচ্চতায়। দুই বিভাগেই এশিয়ার সেরা ১২ দলের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
কোনো দেশের ফুটবলের অবস্থান সাধারণত পুরুষ জাতীয় দলের পারফরম্যান্স দিয়েই বিচার করা হয়। নারীদের পারফরম্যান্স বা র্যাংকিং কতজনই বা খোঁজ রাখেন? সেখানেই বাংলাদেশের ব্যর্থতা। যে কারণে নারী ফুটবলের সাফল্য নিয়েই তুলনামূলক বেশি উচ্ছ্বাস দেখাতে হয়। না পাওয়ার ভেতরে কিছু পাওয়ার আনন্দেই সেই উল্লাস। পুরুষ ফুটবলে সাফল্য না থাকাতেই নারী ফুটবল বাংলাদেশে বেশি আলোচিত। বিদায়ী বছর নারী ফুটবল ছিল সাফল্যে ভরপুর, কিন্তু পুরুষ ফুটবলে তেমন কিছুই আসেনি। একমাত্র প্রাপ্তি ২২ বছর পর ভারতের বিপক্ষে জয়। এই একটি ম্যাচ সামনে রেখে কেউ কেউ সাফল্যের গল্প তৈরির চেষ্টা করেন। তবে একটি ম্যাচ জেতার মধ্যে প্রকৃত সাফল্য নেই—তৃপ্তি থাকতে পারে। ২২ বছর পর ভারতকে হারানোর উল্লাসে মেতে ওঠার চেয়ে বরং বিশ্লেষণ হওয়া উচিত, এতদিন দেশটিকে হারানো যায়নি কেন।

সাফল্য না এলেও বিদায়ী বছরজুড়েই ফুটবল নিয়ে ছিল দারুণ উন্মাদনা। এর প্রধান কারণ ছিল বাংলাদেশের ফুটবলে হামজার সংযোজন। হামজা দেওয়ান চৌধুরী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচ থেকেই জাতীয় দলে যুক্ত হন। তাঁর আগমনে দেশের ফুটবলে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। মার্চে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই লাল–সবুজ জার্সিতে অভিষেক হয় লেস্টার সিটির এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের।
হামজার আগমনে উৎসাহিত হয়ে এ বছর আরও চার প্রবাসী ফুটবলার বাংলাদেশের জার্সিতে খেলেছেন—কানাডা প্রবাসী শামিত সোম, ইতালি প্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জায়ান আহমেদ ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী কিউবা মিচেল। এই প্রবাসী সংযোজনেই বাংলাদেশের ফুটবল আবার আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে হামজা ও শামিতের আগমনকে ধরা হয় নতুন এক মাইলফলক হিসেবে। ২০১৩ সালে ডেনমার্ক প্রবাসী জামাল ভূঁইয়াকে দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসী অধ্যায়। জামাল ভূঁইয়া–তারিক কাজীদের সেই মিছিলে সর্বশেষ সংযোজন কিউবা মিচেল। এই প্রবাসীদের লাল–সবুজ জার্সিতে খেলার কারণেই অনেক দিন পর ফুটবল ফিরে পেয়েছে তার জৌলুস।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের গ্রুপে ভারত ছাড়াও ছিল সিঙ্গাপুর ও হংকং। হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে ছয় ম্যাচের এই বাছাইয়ে বাংলাদেশ খেলেছে পাঁচটি ম্যাচ। শেষ ম্যাচটি সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে, আগামী ৩১ মার্চ। পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৫ পয়েন্ট। শিলংয়ে হামজার অভিষেক ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু হয় অভিযান। ঘরের মাঠে সিঙ্গাপুরের কাছে ২–১ এবং হংকংয়ের কাছে রোমাঞ্চকর ম্যাচে ৪–৩ গোলে হারে বাংলাদেশ। এরপর হংকংয়ের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে ১–১ গোলে ড্র করে দ্বিতীয় পয়েন্ট পায় দলটি। সেই ম্যাচের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঢাকায় ভারতকে হারায় বাংলাদেশ। শেষ দুই ম্যাচে ভালো কিছু করে সমর্থকদের হতাশা লাঘবের লক্ষ্য ছিল হামজা–রাকিবদের। ভারতকে হারিয়ে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়। ওই জয় দর্শকদের এতটাই আনন্দ দেয় যে পুরো বাছাই পর্বের ব্যর্থতার গল্প আড়াল হয়ে যায়। এই সাফল্যে সরকার ফুটবল দলকে ২ কোটি টাকা বোনাসও দেয়।
বিদায়ী বছরে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের পাঁচ ম্যাচের পাশাপাশি বাংলাদেশ খেলেছে আরও তিনটি ফিফা প্রীতি ম্যাচ। দুটি নেপালের বিপক্ষে ও একটি ভুটানের বিপক্ষে। জুনে ঢাকায় সিঙ্গাপুর ম্যাচের প্রস্তুতি হিসেবে ভুটানকে আতিথেয়তা দেয় বাংলাদেশ। ৪ জুনের সেই ম্যাচ দিয়ে দীর্ঘ ৫৫ মাস পর ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ফেরে আন্তর্জাতিক ফুটবল। ওই ম্যাচেই হামজা দেন বাংলাদেশের জার্সিতে তাঁর প্রথম গোল। বাংলাদেশ জেতে ২–০ ব্যবধানে। অন্য দুটি প্রীতি ম্যাচে জয় পায়নি দলটি। নেপালে গিয়ে গোলশূন্য ড্র করে এবং ঢাকায় নেপালের বিপক্ষে ২–২ গোলে ড্র করে। এশিয়ান কাপ বাছাই ও প্রীতি মিলিয়ে বিদায়ী বছরে পুরুষ জাতীয় দল খেলেছে ৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। জয় মাত্র দুটি—ভুটান ও ভারতের বিপক্ষে। ড্র চারটি, হার দুটি।
বাংলাদেশের ফুটবলের বড় সমস্যা প্রথাগত স্ট্রাইকারের অভাব। অর্থাৎ ‘নাম্বার নাইন’ ছাড়াই দীর্ঘদিন খেলছে দলটি। তবে বিদায়ী বছরে একটি ইতিবাচক দিক ছিল—গোল খাওয়ার চেয়ে গোল দেওয়ার সংখ্যা বেশি। আট ম্যাচে বাংলাদেশ গোল করেছে ১০টি, খেয়েছে ৯টি। আগের বছরগুলোতে সাধারণত উল্টো চিত্রই দেখা গেছে। এবার সেই প্রবণতা বদলেছে। প্রথাগত স্ট্রাইকার না থাকায় গোল এসেছে বিভিন্ন পজিশনের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। ১০ গোলের মধ্যে চারটিই করেছেন হামজা দেওয়ান চৌধুরী। আরেক প্রবাসী শামিত সোম করেছেন একটি। বাকি পাঁচ গোল করেছেন তিনজন—রাকিব হোসেন ও মোরসালিন দুটি করে, সোহেল রানা একটি। হামজা ও শামিত দুজনেরই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম গোল এসেছে বাংলাদেশের জার্সিতে।
পুরুষ ফুটবলে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। নারী ফুটবলে কোচ পিটার বাটলারের বিপক্ষে বিদ্রোহ হলেও পুরুষ ফুটবলে তেমন কিছু হয়নি। তবে কাবরেরার কৌশল ও দল গঠন নিয়ে সমর্থকদের অসন্তোষ ছিল স্পষ্ট। ইতালি প্রবাসী ফাহামিদুল ইসলামকে প্রথম দফায় দলে না রাখায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন পর্যন্ত হয়। গ্যালারি থেকে কাবরেরার বিরুদ্ধে ধুয়োধ্বনিও শোনা যায়। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী ফুটবলারদের জন্য ট্রায়ালের আয়োজন করে। সেই ট্রায়াল থেকেই জাতীয় দলে সুযোগ পান জায়ান আহমেদ। কয়েকজন ট্রায়ালিস্ট জায়গা পান যুব দলেও। বাংলাদেশের ফুটবলে এটি ছিল নতুন এক ঘটনা।
আরআই/আইএইচএস/