অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে শতভাগ সংস্কার হয়নি ক্রীড়াঙ্গন
গত বছর ছাত্রজনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ।
এই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। এরই মধ্যে সংস্কার কাজ গুছিয়ে ফেলেছে সরকার। এখন জুলাই সনদ ঘোষণা বাকি। দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এই ১২ মাসে ক্রীড়াঙ্গনের কতটা সংস্কার করতে পেরেছে এবং এ সময়টায় কেমন ছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সেই হিসাবের পালা এবার।
অন্যান্য সেক্টরের সংস্কার করতে সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। ক্রীড়াঙ্গন সংস্কার শুরু হয়েছিল একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে। সেই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ২৪ জুন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ৭ সদস্যের নতুন একটি কমিটি গঠন করে। ক্রীড়াঙ্গনে অধিকতর গতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিতকরণে জাতীয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অধিভুক্ত ফেডারেশন সমূহের গঠনতন্ত্র ও অ্যাফেলিয়েশন প্রাপ্তির বিদ্যমান নীতিমালা যুগোপযোগী করণে সুপারিশ প্রণয়ন করা এই কমিটির দায়িত্ব।
৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটির তাদের কার্যক্রমের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা। এ কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ক্রীড়া-১) কে। গত বছর ১ অক্টোবর পুনর্গঠিত সার্চ কমিটির প্রধান ক্রীড়া সংগঠক জোবায়েদুর রহমান রানা ও প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদারকেও সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে এই কমিটিতে।
গত এক বছরে ক্রীড়াঙ্গনে বেশ কিছু সাফল্য এসেছে। এই এক বছরে নারী ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া, টেস্ট ক্রিকেটে পকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়, নারী ফুটবল দলের প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা, যুব হকি দলের প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা এবং নারী সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ধরে রাখা এই অর্জনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মাঠের পারফরম্যান্সগুলো ছিল ধারাবাহিকতার অংশ। সবার নজর ছিল সাংগঠনিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনে কতটা সংস্কার হয়েছে। তা নিয়ে ভালো-মন্দ দুই দিকেই বিশ্লেষণ আছে। অনেকেরই অভিযোগ আছে ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের নামে অনেক ক্ষেত্রে পতিত সরকারের ঘনিষ্ট অনেককে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার হয়েছে খুবই ধীর গতিতে। যে কারণে লম্বা একটা সময় ক্রীড়াঙ্গন স্থবির ছিল। বিশেষ করে ঘরোয়া আয়োজনগুলো। টানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় বেশিরভাগ ক্রীড়া ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সংস্থাগুলোতে ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রাধান্য। সেই অবস্থা থেকে প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকদের হাতে ক্রীড়া ফেডারেশন ও সংস্থাগুলোর দায়িত্ব দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ক্রীড়া প্রশাসনকে। বিশেষ করে এক সাথে দেশের প্রায় সব ফেডারেশন ও সংস্থাকে দীর্ঘ সময় নেতৃত্বশূন্য রাখা ছিল কৌশলগত ভুল।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার মাস পূরণ হওয়ার আগেই গত বছর ২ সেপ্টেম্বর ক্রীড়া সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছিল। ক্রীড়া উপদেষ্টাও বলেছিলেন, ‘পুরো ব্যবস্থাই ধ্বংস করা হয়েছিল। ক্রীড়াক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন আছে।’
তিনি সংবাদিকদের সাথে মতবিনিসয়ের ৫ দিন আগেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গঠন করেছিল ক্রীড়াঙ্গনের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য একটি সার্চ কমিটি। কমিটির এক সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জন্য তাকে বাদ দিয়ে ১ অক্টোবর ওই কমিটি পুনর্গঠন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
ক্রীড়াঙ্গনে বড় সিদ্ধান্তটি হয়েছিল গত বছর ১২ আগস্ট ও ১০ অক্টোবর। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ১২ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে দেশের সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ভেঙ্গে দেয়। এরপর ১০ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে ওই সময়ে বিদ্যমান ৫৫টি ফেডারেশনের মধ্যে ৪২টির সভাপতি অপসারণ করে।
বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি। সংস্কারের জন্য তাদের অপসারণ জরুরি হলেও বিকল্প না খুঁজেই সবাইকে সরিয়ে দেওয়ায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল ক্রীড়াঙ্গন। এমনিতেই অনেক ফেডারেশনের আওয়ামী সমর্থিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আত্মগোপনে। তারপর সভাপতি অপসারণ। যে কারণে লম্বা একটা সময় ঘরোয়া খেলাধুলার কার্যক্রম স্থবির হয়েছিল।
ফুটবল, ক্রিকেট আর হকির আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোয় অংশ নেওয়া ছাড়া ক্রীড়াঙ্গনে কার্যক্রম চলছিল না সেভাবে। তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থাগুলো পুনর্গঠন। বিভিন্ন সময়ে হওয়া নির্বাচন ও অ্যাডহক কমিটিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ১১ জন কর্মকর্তাকে বসানো হয়েছিল কয়েকটি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে।
১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাদের কর্মকর্তাদের অপসারণ করে সেসব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন থেকে যারা সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠ ছিলেন। পরের দিনই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাদের বিভিন্ন স্থাপনায় লিজ দেওয়া দোকানসহ অন্যান্য জায়গার ভাড়া হালনাগাদের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠণ করে।
যদিও এ বিষয়ে কোনো অগ্রতির নজির নেই। ওইদিন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘মনে হয় আমাকে এনে কেউ দুর্নীতির মহাসাগরে ছেড়ে দিয়েছে।’ যদিও লম্বা এই সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতির কোনো বিষয়ে বড় ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে মাত্র।
ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো সরকারী বরাদ্দ পেলেও সেই টাকার যথাযথ হিসেব দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে। এখানে বাঁশের চেয়ে ছিল কঞ্চি বড়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। আর বেশ কয়েটি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রী।
স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোনো নির্দেশনা আমলে নিতো না ফেডারেশন। তাই তো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আয়-ব্যয়ের অডিট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বছরের পর বছর দিতো না বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন। বর্তমান ক্রীড়া উপদেষ্টার নির্দেশে গত বছর ১১ নভেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২৭টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের বরাদ্দ স্থগতি করেছিল।
ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের বেশি আগ্রহ ছিল ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর পুনর্গঠন নিয়ে। এই জায়গাটায় বেশ গতিহীন ছিল ক্রীড়া প্রশাসন। ৪২ ফেডারেশনের সভাপতি অপসারণের পর নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন পুনর্গঠন শুরু করে।
১৪ নভেম্বর প্রথম ধাপে ৯ ফেডারেশনের বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করে। ১৬ জুলাই পঞ্চাশতম ফেডারেশন হিসেবে শ্যুটিংয়ের কমিটি ঘোষণা করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এরমধ্যে তিনটি অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি বিলুপ্ত করে অন্য ফেডারেশন অ্যাসোসিশেনের সাথে একীভূত করা হয়েছে।
এরআগে এমনটি কখনো হয়নি। ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশন জন্ম দিতেই বেশি ব্যস্ত ছিল এনএসসি। কমানোর চিন্তাও ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া প্রশাসন সে কাজটি করেছে। গত ১৭ জুন ঘুড়ি অ্যাসোসিয়েশনকে কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশনের সাথে, প্যারা আরচারি অ্যাসোসিয়েশনকে বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনের সাথে এবং খিউকুশিন কারাতে অ্যাসোসিয়েশনকে বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সাথে একীভূত করেছে এনএসসি।
এই এক বছরে ক্রীড়াঙ্গনের কতটা সংস্কার হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) মোহাম্মদ আমিনুল এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিনটি অ্যাসোসিয়েশন অন্য ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশনে একীভূত করার পর এখন সংখ্যা আছে ৫৩টি। এর মধ্যে ৫০ টির নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো অ্যাসোসিয়েশন। আর ৫ বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকি আছে বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর। ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৯টির কমিটি দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে গাজীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রংপুর ও বরিশাল। যেগুলো বাকি আছে সেগুলোর কমিটি সহসা হয়ে যাবে।’
এই পরিসংখ্যান বলছে এক বছরে ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার শতভাগ হয়নি। গত বছর অক্টোবরে বাফুফের নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কমিটি ভাঙার সুযোগ নেই। তবে দুইবার সভাপতি পরিবর্তন ও কয়েকজন পরিচালক পরিবর্তনের মাধ্যমে বড় ধরনের সংস্কার হয়েছে।
ফুটবল, ক্রিকেটের মতো বিওএ’র কমিটি ভাঙার এখতিয়ার নেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। এখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার বিধিনিষেধ মানতে হয়। ক্রিকেট বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা অক্টোবরে, বিওএর ডিসেম্বরে। তবে বিওএ কয়েকদিন আগে এজিএম করে নির্বাচন এক মাস এগিয়ে এনে নভেম্বরে করার ঘোষণা দিয়েছে।
আরআই/আইএইচএস/জিকেএস