এ ভালোবাসার প্রতিদান দেবো কিভাবে?
স্রেফ টুকরো টুকরো কাগজের সমষ্টি। ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্য কিসের এত দরদ? এত মায়া? কেন যে দরদ, কেন যে মায়া তা বোঝানো যাবে না। আদতে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে এইটুকু বলি, এই খণ্ড খণ্ড কাগজে লিপিবদ্ধ আছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য-উপাত্ত। যা অন্যত্র আছে কি না আমার অন্তত জানা নেই।
আর এই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। দিনের পর দিন এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত, খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন কাগজই জমিয়েছি। কত সময়, কত অর্থ ব্যয় করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। সত্যিকার অর্থে আমার জীবনে সঞ্চয় বলতে আছে ক্রীড়া বিষয়ক এই কাগজপত্রগুলো। চাইলেও এর মায়া ছেড়ে দেওয়া কি এত সহজ?
সঙ্গে করে নিয়ে যাব বলে এত এত বছর জমানো আনাচে-কানাচে থাকা কাগজগুলো গোছাতে গিয়ে দেখি, তা হয়ে গেছে কয়েক কার্টন। দেখে আমার টাস্কি খাওয়ার যোগাড়। এই কাগজের পাহাড় নিয়ে আমি কোথায় যাবো? বাসার যা পরিসর, তাতে কোনো কাগজ রাখার স্থান সংকুলান করাই মুশকিল।
অথচ ছেঁড়া কাগজ, ধুলোপড়া নোটবুক, মলিন ডায়েরি, ছিন্ন নথি, লেপ্টে যাওয়া চিঠিপত্রসহ কত কত বিচিত্র কাগজের সমাহার! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের কত অমূল্য মুহূর্ত! হাতে লেখা কিংবা কম্পিউটার কম্পোজ করা তথ্যের পরিমাণ দেখে মাথা খারাপ হওয়ার দশা! এত এত তথ্য-উপাত্ত কবে সঞ্চিত হলো? কখন করলাম?
মনে পড়লো, 'ছোটো ছোটো বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।' কোন মোহে কলম এবং কি-বোর্ডে রাশি রাশি শব্দ ও বাক্য লিখে রেখে দিয়েছি? বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বইপত্র ও পাঠাগার থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত, নানান জনের নেওয়া সাক্ষাৎকারের নোট, ফুটনোট, জীবনবৃত্তান্তের ফটোকপি, দুর্লভ স্মরণিকা, ছবিসহ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের হারিয়ে যাওয়া স্পষ্ট বা অস্পষ্ট অনেক দৃশ্যপটের অগোছালো সংকলন। এ দিয়ে কী হবে?
এই পৃথিবীর সব কিছুর প্রতি কেন যে এত মায়া? জানি, চোখ বন্ধ করলেই সব মিলিয়ে যাবে। তারপরও এক টুকরো কাগজের মোহ ছাড়তে পারি না। যক্ষের ধনের মতো করে বছরের পর বছর তা আগলে রেখেছি। যদিও আমার কাছে এর যতটা গুরুত্ব, অন্যের কাছে ততটা না-ও হতে পারে। প্রশ্ন হতে পারে, পরম যত্মে এত এত দিন তা কেন জমিয়ে রেখেছি?
ভেবেছি, সংগৃহীত এ তথ্য দিয়ে তথ্যময়, গবেষণামূলক কিংবা ইতিহাসভিত্তিক লেখা লিখবো। কিন্তু লেখা আর হলো কোথায়? নানান ব্যস্ততায় লেখালেখিতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা যায়নি। তা ছাড়া এ ধরনের লেখায় পাঠকের যেমন আগ্রহ নেই, তেমনিভাবে প্রকাশকরা তা ছাপতে আগ্রহী নন। তবুও আশায় বুক বেঁধে থেকেছি। সুযোগ ও সময় মতো মনের তাগিদে হয়তো একদিন না একদিন লিখবো। আদৌ কি তা সম্ভব হবে?
কিন্তু বিপুল কাগজের গাদার মধ্যে বছরের পর বছর বসবাস করতে করতে মনে হয়েছে, চিরকাল বুঝি এভাবেই কেটে যাবে। তাই কি যায়? একটা সময় যে সব কিছুর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, অথচ সে ভাবনায় খুব একটা দোলায়িত হইনি। জীবনে কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। জীবন যেখানে ক্ষণস্থায়ী, সেখানে অন্য কিছুর হিসেব করে আর কী হবে?
তারপরও একই কর্মস্থলে দীর্ঘ ২৯ বছর অতিক্রম করার পর তার সঙ্গে যে সংযুক্তি হয়, তা ছিন্ন করা কি এত সহজ? এই কার্যালয়ও হয়ে উঠে আমার এক রকম ঘর-সংসার। দিনের পর দিন একটা কক্ষই ছিল আমার ঠিকানা। এ ঠিকানায় সম্পাদিত হয়েছে কত কর্মকাণ্ড। বরাবরই নানান জনের উপস্থিতিতে মুখরিত থেকেছে। ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কত রকম চিন্তাভাবনায় মশগুল থাকতে হয়েছে। তার প্রতিফলন পাক্ষিক 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকায় পড়েছে।
এই পত্রিকা ক্রীড়াঙ্গনকে যেভাবে বুকে ধারণ করে আছে, তেমন নজির কি খুব একটা দেখা যায়? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কত মানুষের সম্পৃক্ততা। জীবনের দীর্ঘ সময় এই পত্রিকায় কর্মজীবন অতিবাহিত হওয়ায় বিচিত্র সব অনুভব আর গভীরতম অনুভূতি ছেয়ে আছে হৃদয়জুড়ে। স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ, মায়া, স্মৃতি ইত্যকার সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কোনটাকে দূরে সরিয়ে দেব?
এ সব কিছুর সঙ্গে জাগতিক এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাই। তা এত দিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে কতভাবেই না ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। বলতে গেলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরানো ভবনের নিচতলায় আমার শিকড় গজিয়ে যায়। সেই শিকড় ছিঁড়ে ফেলতে রক্তক্ষরণ হতেই পারে। কিন্তু জগতের নিয়ম অনুসারে বন্ধন একসময় ছিন্ন করতেই হয়।
হ্যাঁ, সব কিছু মাড়িয়ে আজ সেই বন্ধন কাটিয়ে এসেছি। যদিও রয়ে গেছে তার আবেশ। আসলে কলেজ জীবন থেকেই কেটেছে কর্মযজ্ঞের মধ্যে। মূলত ঢাকা স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে জীবন। কাজ ছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন, সেটা বুঝতে কিছুটা সময় হয়তো লাগবে।
তবে প্রতিদিন যে মানুষগুলোর সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথা হতো, প্রাণের উত্তাপ ছড়াতো, তাঁদের সান্নিধ্য দারুণভাবে অনুভব করবো। তা ছাড়া বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চয় করেছি যে কাগজের স্তূপ, তার পরতে পরতে সংরক্ষিত আছে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস, অতীতের ঘটনাবলী, স্মৃতি, মায়া, আবেগ, স্বপ্ন আর ভালোবাসা।
যা আমার লেখালেখি এবং কর্মজীবনের অংশ, তা হারিয়ে গেলে আমার আর কী থাকে? কিন্তু জীবন বড্ড কঠিন। তাতে আবেগের কোনো গুরুত্ব নেই। তাই কোনো আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সব কিছুই নির্মমভাবে ছেঁটে দিতে বাধ্য হয়েছি। যা ছিল আবেগ, তা এখন কেবলই কাগজের জঞ্জাল। ইতোমধ্যে তা হয়তো আবর্জনার স্তূপে ঠাঁই করে নিয়েছে। সত্যি বলতে কি, আমার আর পিছুটান রইলো না।
তবে অফিসের মেইন গেট দিয়ে ঢোকার সময় বকুল ফুলের যে সুরভি মনকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিত, সেই অনুভবটুকু কি আর পাওয়া হবে? আর আজ সকালে নির্ধারিত সময় অফিসে ঢোকার পর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মতো সামান্য একজন মানুষের জন্য এত এত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় আমি অভিভূত, মুগ্ধ ও বিস্মিত। এর প্রতিদান আমি কীভাবে দেবো?
লেখক : পাক্ষিক ক্রীড়াজগত থেকে সদ্য অবসর নেওয়া সম্পাদক
আরআই/আইএইচএস/