ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের শৈশবের স্মৃতি

সাজেদুর আবেদীন শান্ত | প্রকাশিত: ০৪:০৩ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তাপও বাড়ছে। যশোর শহর ছাড়িয়ে কেশবপুরের দিকে আমাদের যাত্রা। আমি আর গল্পকার সাকি সোহাগ। সাকি সোহাগ যশোরেই থাকেন। চাকরি করেন একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে। কেশবপুর নামার পরই দেখলাম একটি বিশাল গেট আর সেখানে মধুদার ছবি। মধু মানে বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আমাদের গন্তব্যও কবির পৈতৃক ভিটায়।

একটি ভ্যান রিজার্ভ করলাম। তিনশ টাকা। যদিও রাস্তার তুলনায় ভাড়া অনেক বেশি। তবে একটু দূর যাওয়ার পরে আর ভাড়া বেশি মনে হলো না। কারণ চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একদম মুগ্ধ করলো আমাদের। মনে হয় যেন ছবির মতো গ্রামীণ রাস্তা। রাস্তার দুধার যেন সবুজ ঢেউয়ের মতো।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক ভিটায়

হঠাৎ সাকি সোহাগকে বলে উঠলাম, ‘ভাই মধুদার বাড়িতে যাওয়ার আগে এমন একটি জায়গায় যাই, যেখানে কবি ফার্সি ভাষা শিখতেন?’ সাথে সাথে তার যেন এক অন্যরকম উন্মাদনা। আমি নেভিগেশন দেখে বললাম, ‘সামনেই মধু সড়ক। এ পথে একদিন হাঁটতেন বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র।’ যদিও তথ্যগুলো আগেই জেনে নিয়েছিলাম।

সাগরদাঁড়ির আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে যখন আমরা শেখপুরা গ্রামের দিকে ঢুকলাম; তখন হঠাৎ করেই বদলে গেল দৃশ্যপট। কাঁচা রাস্তা, দুধারে শালিক-ফিরিঙ্গি ডাকছে। বাতাসে ধানের গন্ধ আর পুরোনো মাটির ঘরের এক রকম সোঁদা গন্ধ। একটি পায়ে টানা ভ্যানে করে পথ এগোচ্ছি। মনের মধ্যে কবিতা খেলা করছে—যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু ছন্দ আছে।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক ভিটায়

হঠাৎ রাস্তার শেষে সবুজ গালিচার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তিন গম্বুজ দেখতে পাই। ভ্যানচালককে দাঁড়াতে বলে আমরা নেমে গেলাম। এরপর মসজিদের আঙিনায় প্রবেশ। সাকি ভাইকে বললাম, ‘এটাই সেই মসজিদ; যেখানে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফার্সি ভাষা শিখতেন।’ সাকি সোহাগ সাথে সাথেই নামফলকে আমার তথ্যের সত্যতা যাচাই করলেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

মসজিদের চারপাশ সবুজে ঢাকা। পাশেই পুকুর, পানিতে কমলা রঙের সূর্য পড়ছে। সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, যেন সময় থেমে আছে। তিনটি গম্বুজ, প্রতিটিই নিখুঁতভাবে অলঙ্কৃত। দেওয়ালের গায়ে ফাটল ধরেছে বয়সের ছোঁয়ায়। সেই ফাটলই যেন পুরোনো শিল্পের সম্মানসূচক দাগ। দেওয়ালে এখনো ঝুলে আছে খোদাই করা আয়াত। মেহরাব ঘেঁষে দাঁড়ালে মনে হয় কেউ ফিসফিস করে ফারসি কবিতা বলছেন। সাকি ভাই বললেন, ‘এই যে বারান্দা—এখানেই কি পাঠ হতো! এই দেওয়ালে ভর দিয়ে হয়তো একদিন কবি বসেছিলেন। আর বলেছিলেন—‘ইশকে খোদা’র মানে কী?’

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক ভিটায়

স্থানীয়রা জানান, মসজিদের নাম ‘শেখপুর শাহী জামে মসজিদ’। এটি শুধু নামাজের স্থান নয়, এক সময়ের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ১৭০০ শতকের শেষভাগে মুঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এ মসজিদে আরবি ও ফারসির পাঠদান হতো। এখানেই ছোট্ট মধুসূদন আসতেন নিয়ম করে। মসজিদের দৈর্ঘ ২১.৫ মিটার, প্রস্থ ১৬.৬ মিটার, উচ্চতা প্রায় ১২ মিটার। চত্বর এক মিটার পুরু দেওয়ালে ঘেরা। পূর্বদিকে ছোট একটি বারান্দা, যা এখন সময়ের ভারে কিছুটা ভেঙে পড়েছে।

মসজিদের বাইরে একটি ছোট চায়ের দোকান। সেই দোকানে বসে সাকি ভাই একটি ফিকশনাল প্লট বলে ফেললেন—‘শান্ত! ধরো, একজন লেখক স্বপ্নে শেখপুরার এই মসজিদে যান, সেখানে তাকে এক বৃদ্ধ ফারসি শিক্ষক কিছু অদ্ভুত শব্দ শেখায়... ঘুম থেকে উঠে তিনি সেই শব্দ দিয়ে কবিতা লিখে খ্যাতি পান।’ আমি হেসে ফেললাম। মনে মনে ভাবলাম, তা আবার হয় নাকি! এরপর চায়ের বিল দিয়ে ভ্যানে উঠে পড়লাম। কারণ আমাদের মূল গন্তব্যে এখনো পৌঁছাইনি।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক ভিটায়

কবির স্মৃতিধন্য এই জায়গায় আসতে পারেন আপনিও। তাহলে যে কোনো জায়গা থেকে যশোর আসতে হবে। যশোর থেকে সরাসরি সিএনজি নিয়ে এখানে আসা যায়। অথবা যশোর থেকে কেশবপুরের বাস চলাচল করে। কেশবপুর নেমে স্থানীয় যানবাহনে শেখপাড়া শাহী মসজিদে আসা যায়।

কেশবপুরে থাকার মতো ভালো কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তাই থাকতে হলে যশোর শহরে আসতে হবে। যশোরে থাকার জন্য পাঁচ তারকা মানের ভালো কোনো হোটেল না থাকলেও উন্নতমানের কিছু হোটেল রয়েছে। এগুলোতে ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে রাত কাটানো যায়। আর হ্যাঁ, যশোরের খেজুর গুড় বিখ্যাত। তাই খেজুর গুড়ের প্যারা সন্দেশ ও ভিজা পিঠা খেতে ভুলবেন না। হাতে সময় থাকলে খেতে পারেন জামতলার মিষ্টি, ধর্মতলার চা ও চুকনগরের বিখ্যাত চুইঝাল।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন