আফ্রিকার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া দিন, অবশেষে মায়াময় বিদায়
এই ভ্রমণ শুধু সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছবি: লেখকের সৌজন্যে
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল এক বিশেষ উত্তেজনা নিয়ে। আফ্রিকা মহাদেশের হৃদয়ে, সেই চির পরিচিত অথচ অচেনা দেশ কেনিয়া নামটি কতবার যে শুনেছি জীবনে! কখনো মাসাই মারার সাফারির গল্পে, কখনো আবার ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে। কিন্তু নাম শোনা আর বাস্তবে ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আমরা যখন নাইরোবির মাটিতে পা রাখলাম; তখন মনে হলো আমরা কোনো নতুন জগতে এসে পড়েছি। প্রশস্ত মহাসড়ক, শৃঙ্খলাবদ্ধ যানবাহন, সুউচ্চ অট্টালিকা আর আধুনিক নগরীর ছন্দ সব মিলিয়ে যেন ইউরোপের কোনো প্রাণবন্ত শহরে এসে দাঁড়িয়েছি। একদিকে আফ্রিকার ইতিহাস, অন্যদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া; এই দ্বৈত সৌন্দর্যে ভ্রমণের শুরুটিই হয়ে উঠলো বিস্ময়কর।
নাইরোবিতে এসে আমরা প্রথমেই ইতিহাসের দুই অমর মানুষকে স্মরণ করলাম। একজন জিম করবেট, ভারতবর্ষের সেই কিংবদন্তি লেখক এবং শিকারি; যিনি শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠেছিলেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আরেকজন লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল, স্কাউট আন্দোলনের জনক। যিনি লাখো তরুণকে মানবসেবায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, সময়ের বালুকণার নিচে চাপা পড়েও কতগুলো নাম চিরন্তন হয়ে যায়। প্রকৃতি আর মানবতার প্রতি এই দুই মহান ব্যক্তির অবদান যেন আজও জীবন্ত হয়ে আছে আফ্রিকার বাতাসে। আমাদের ভ্রমণ তাই ইতিহাসের মায়াময় ছায়ায় শুরু হলো।

নাইরোবি ছেড়ে আমরা এগোলাম উত্তরের পথে। প্রথম থামলাম রিফট ভ্যালি ভিউপয়েন্টে, মাই মাহিউ এলাকায়। আফ্রিকার রিফট ভ্যালি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়। পাহাড় কেটে, ভূমি ফুঁড়ে তৈরি হয়েছে এই বিস্তীর্ণ উপত্যকা। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম দিগন্তজোড়া ফাঁকা জায়গার সামনে। চারদিকে সবুজ আর বাদামি জমির মিশ্রণ। আকাশ যেন নীল চাদর মেলে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল পৃথিবীকে কেউ খণ্ড খণ্ড করে এখানে সাজিয়ে রেখেছে আর আমরা সেই ভাঙা টুকরোর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। ইতিহাস বলে, এখানেই মানুষ জাতির প্রাচীনতম অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষরা কোনোদিন এই মাটিতেই হেঁটেছিলেন, তাদের ছায়া এখনো বাতাসে মিশে আছে। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো আমরা শুধু ভ্রমণ করছি না বরং মানুষের জন্মকথার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি।
সেখান থেকে যাত্রা চলল নাকারুর দিকে। নাকারু শহর ব্যস্ত ও প্রাণবন্ত কিন্তু তার প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে নাকারু লেকে। আমাদের সময় ছিল সীমিত, তাই লেকের ধারে বেশি সময় কাটাতে পারিনি। তবে গাড়ি থেকে দূরে যখন ঝলমলে জলরাশি চোখে পড়লো, তখন মনে হলো এ যেন মরুভূমির বুকে হঠাৎ ফুটে ওঠা নীলকান্তমণি। বিশাল লেকের গাঢ় নীল জল, তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ আর সাদা পাখির ঝাঁক, এই দৃশ্য যেন স্বপ্নে দেখা কোনো চিত্রকর্ম। আফ্রিকার প্রকৃতি তার সৌন্দর্যকে বারবার নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে আর আমরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
প্রথমদিনের ভ্রমণ শেষ হলো মারিঘাটে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা পৌঁছালাম, তখন শরীরে ক্লান্তি জমে উঠেছিল। কিন্তু রাতের অভিজ্ঞতা সমস্ত ক্লান্তিকে মুছে দিলো। আফ্রিকার ছোট শহরের রাত ভিন্নরকম। আকাশজোড়া তারার মেলা, নিস্তব্ধতার গভীরতা আর দূরে কোথাও উপজাতিদের ঢাকের মতো বেজে ওঠা তাল সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমরা যেন স্বপ্নরাজ্যে এসে পড়েছি। কোনো বিলাসবহুল হোটেল নয়, সাধারণ আবাসন আর আন্তরিক মানুষের আতিথেয়তাই আমাদের রাতটিকে পূর্ণতা দিলো।

আরও পড়ুন
উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
উগান্ডার ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণীর অন্যরকম দৃশ্য
পরদিন সকাল থেকে আবার নতুন পথ। মারিঘাট থেকে টট, তারপর কাইন্যুক, তারপর লকিচার, প্রতিটি জায়গার রাস্তা যেন নতুন রূপে সাজানো। আফ্রিকার রাস্তা সহজ নয়, কখনো পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ, কখনো মরুভূমির মতো ধুলোয় ভরা সমতল। তবুও প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি দৃশ্যে ছিল এক অন্যরকম আকর্ষণ। পথে পথে মানুষজন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়েছে, কোনো শিশু এগিয়ে এসে পথ দেখিয়েছে, কোনো দোকানি আমাদের জন্য স্নেহভরে খাবার সাজিয়েছে। আমরা কোথাও কোনো সমস্যায় পড়িনি বরং প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের আন্তরিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়ে উঠলো। দেশটি আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ ভাষা বা সংস্কৃতির ভিন্নতায় আলাদা হয় না বরং হৃদয়ের ভালোবাসাতেই সে মহৎ হয়ে ওঠে।
তৃতীয় দিনে আমরা পৌঁছলাম লুডওয়ারে, তুরকানা অঞ্চলের রাজধানী। এখান থেকে শুরু হলো আমাদের প্রকৃত অভিযান, সেই কিংবদন্তি তুরকানা লেকের পথে। নাম শুনলেই মনে হয় রহস্যময় কোনো কাহিনি লুকিয়ে আছে। আমরা যখন লেকের ধারে দাঁড়ালাম, তখন বিস্ময়ে নিঃশ্বাস আটকে গেল। বিশাল জলরাশি যেন দিগন্ত গিলে খাচ্ছে, তার মাঝখানে আগ্নেয়গিরির মতো দ্বীপ মাথা তুলে আছে। লেকের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তুরকানা উপজাতির মানুষ, তাদের পোশাক, গান, নাচ আর সাদাসিধে ব্যবহার যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
আমরা নৌকায় করে গেলাম সেন্ট্রাল আইল্যান্ডে। দ্বীপটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর রূপ। আগ্নেয় শিলায় ঘেরা চারপাশ, মাঝে কিছু সবুজের ছোঁয়া, যেন জীবন্ত কোনো আগ্নেয়গিরির হৃদয়। কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর হলো সেখানে বারো হাজার কুমিরের বসবাস। যখন নৌকা দুলতে দুলতে দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল মৃত্যু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তবুও সেই ভয়কে জয় করেই আমরা দ্বীপে ঘুরে বেড়ালাম। প্রকৃতি যেন আমাদের শিখিয়ে দিলো, জীবন ক্ষণস্থায়ী কিন্তু সাহসী হলে তবেই সে পূর্ণতা পায়।

তুরকানার মানুষ আমাদের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেছে। তারা হয়তো আধুনিকতার জটিলতা জানে না, কিন্তু তাদের চোখের দৃষ্টিতে যে সত্য আর আন্তরিকতা আছে, তা শহুরে জীবনে খুঁজে পাওয়া কঠিন। লেকের ধারে নৌকায় চড়ে, বাতাসের তীব্রতায় দুলতে দুলতে মনে হচ্ছিল আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রান্তে চলে গিয়েছি। এ অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রইলো।
তবে এই ভ্রমণ শুধু সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেন্ট্রাল আইল্যান্ড থেকে ফেরার সময় আমরা জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলাম। বাতাস ভয়ংকর গতিতে বইছিল, নৌকা দুলছিল ভীষণভাবে। মনে হচ্ছিল এক মুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ভাগ্যের দয়ায় আমরা বেঁচে ফিরেছি। মৃত্যুর এত কাছ থেকে ফিরে আসা মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। আবারও ফিরে আসবো এই সুন্দর দেশগুলোয়। যেখানে মানুষ চমৎকারভাবে হাসতে জানে, ভালোবাসতে জানে।
এসইউ/জিকেএস