আবার লালকুঠি হবে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ
১৮৭৪ বুড়িগঙ্গার তীরে নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হয়, ছবি: লেখকের সৌজন্যে
আশরাফুল ইসলাম আকাশ
সাত সকালেই কবি সাজেদুর আবেদীনের ফোনে ঘুম ভাঙল। কথা শেষে চোখের পাতায় আর ঘুম নামলো না। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক গড়াগড়ি দিয়ে বিছানা ছাড়লাম। শৌচাগারের কাজ শেষে খাবার টেবিলে বসেছি। হালকা নাস্তা সেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। নতুনবাজার থেকে লোকাল বাস ধরে পৌঁছলাম পল্টন মোড়ে। সাজেদুরকে রিসিভ করে রিকশায় রওয়ানা হলাম ভিক্টোরিয়া পার্কে।
মধ্য দুপুর। রোদের তাপে পিচঢালা সড়ক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সেই তাপে গরমের মাত্রা বেড়েছে আরও কয়েক ডিগ্রি। শরীরটাকে জিরিয়ে নিতে দুজনে আশ্রয় নিলাম ভিক্টোরিয়া পার্কে। অনেকে একে বাহদুর শাহ পার্ক নামেও চেনেন। গাছের ছায়ায় মৃদু বাতাসে শরীরটা শীতল হলো। দুজনেই ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়? এর আগে যেখানে গিয়েছি; সেসব বাদ রেখে নতুন কিছু নিয়ে আলাপ হলো। ঐকমত্যে পৌঁছলাম রুপলাল হাউজ আর বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা প্যালেসে যাবো।

শুরু হলো পুরান ঢাকা এক্সপ্লোর মিশন। এর আগেও অনেকবার ইতিহাসের চাদরে মোড়ানো এলাকাটিতে এসেছি। তবু কেন যেন মনটাকে তৃপ্ত করতে পারিনি। খায়েশ মিটবেই বা কী করে? পুরান ঢাকার অলি-গলির মধ্যে এক চৌম্বকীয় আকর্ষণ আছে বৈকি! এখানকার প্রতিটি সংকীর্ণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেন সময়ের আবর্তে ভেসে যাওয়া যায়। শ্যাওলা জমা দালান-কোঠা, স্থানীয়দের আভিজাত্যপূর্ণ চলাফেরা, রং-বেরঙের দোকান, ছোট ছোট রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসা বিরিয়ানির সুঘ্রাণ, হকারদের চিৎকার পুরোনো এই শহরকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
এসব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছলাম ঢাকার কেন্দ্রীয় লঞ্চঘাটের সামনে। সাজেদুরকে বললাম, কোথাও যাওয়ার আগে লঞ্চঘাটে ঢুঁ মেরে যাই। ভরদুপুরে দৈত্যাকার সব লঞ্চ ঘাটে ভেড়ানো। নির্দিষ্ট সময়ে বুড়িগঙ্গার বুকে ভেসে গন্তব্যে ছুটবে নৌযানগুলো।

লঞ্চঘাট থেকে বেরিয়ে রুপলাল হাউজের দিকে রওয়ানা হয়েছি। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে জীবিকার নানা উপজীব্য। ডান-বাম যেদিকেই চোখ যায় ভাসমান খাবার আর চায়ের টং দোকান। রোদের তীব্রতা মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই চোখে পড়ে লাল ইটের বিশাল এক ভবন। শুরুতে কিছুটা আশ্চর্য হলাম। স্থাপনাটা আবার কী? দুপাশে আধুনিক স্থাপত্যের অবকাঠামো। চারপাশ মসলার ঘ্রাণে ম ম করছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী এ স্থাপনা আলাদাভাবে নজর কাড়ছে। প্রখর রোদে লাল রঙের স্থাপনাটি চোখে ধরেছে। বোধহয় সবেমাত্র ভিত্তি পেল!
বুড়িগঙ্গার তীরে ভ্রাম্যমাণ দোকানির কাছে জানতে পারলাম—এটা নর্থব্রুক হল। মানে লালকুঠি! অথচ কয়েক বর্ষা আগেও স্থাপনাটি ছিল জরাজীর্ণ, খসে পরা ইতিহাসের স্রেফ নীরব কান্না। সংস্কারের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে সব, পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরতে শুরু করেছে হাল আমলের নর্থব্রুক হল! স্থাপনাটি ঘুরে দেখার স্বাদ জাগলো মনে। ফিকে হলো রুপলাল হাউজ আর জিঞ্জিরায় যাওয়ার শখ।
ইতিহাস ঘেটে জানা গেল, ১৮৭৪ বুড়িগঙ্গার তীরে নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হয়। ওই বছরই ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের ঢাকা সফরকে স্মরণীয় করতেই এ টাউন হল গড়ে তোলা হয়েছিল। স্থাপত্যশৈলীর কারণে পরে তা লালকুঠি নামে পরিচিতি পায়।
আরও পড়ুন
ক্ষুদ্রঋণে টিকে আছে ফুলগাজীর ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম
তুলসী লাহিড়ীর পৈতৃক ভিটার স্মৃতি রক্ষার দাবি
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ঠিক পাশেই ফরাশগঞ্জ বাজার। বুড়িগঙ্গা তীরের এই বাজার এখন মসলার অন্যতম মোকাম। এর ঠিক পেছনের শতবর্ষী ভবনটিই ঢাকাইয়্যা স্মৃতির পাতায় উঁকি দিচ্ছে। লাল ইট, চুন আর সুরকির মিশ্রণের অবকাঠামোর ইতিহাসে ডুব দেওয়ার আগে মনে হতে পারে, এটি স্রেফ একটি পুরোনো ভবন। কিন্তু একটু গভীরে পা ফেললেই বোঝা যাবে একদা এটিই ছিল ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। এ শহরের অভিজাত পরিবার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং বিদেশি অতিথিদের আড্ডাস্থল।
সময়ের ছাপ কখনো কেউ থামাতে পারেনি। লালকুঠির সৌন্দর্য আজ অনেকটাই বিবর্ণ। জানালার ফাঁকে পাখি, প্রধান গেটের সামনের ঝরনাকল বিকল। তাই এটি ঢাকা পড়েছে মোটা নীল পলিথিনের আড়ালে। এ মুহূর্তে ভবনের একপাশে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়, অন্যপাশে ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব ও ডায়াবেটিক সমিতির কার্যালয় গড়ে উঠেছে।

সাজেদুরকে সাথে নিয়ে ভাঙাচোরা প্রধান ফটক হয়ে নর্থব্রুক হলে পৌঁছলাম। প্রধান হলের অন্দরে ঢুকতেই বদলে গেল সব ধারণা। লাল ভবনটির দুপাশে রয়েছে চারটি অষ্টাভুজাকৃতির মিনার। দরজাগুলো অশ্বখুরাকৃতির ও অর্ধ-বৃত্তাকার। মিনার, দেওয়াল, দরজা, ঘুলঘুলিসহ প্রতিটি স্থাপনায় নান্দনিক নিঁখুত কারুকাজ। প্রধান হলের বাইরের ছাদছোঁয়া উঁচুতে ছোট ছোট অসংখ্য খোপ করা ছিল আগেই। যেখানে আয়েশে দিন যাপন করছে শান্তির প্রতীক পায়রা। সুযোগ এলেই বাক-বাকুম করছে। জানলে অবাক হবেন, নর্থব্রুকের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে; যাতে দক্ষিণ পাশের সৌন্দর্য একরকম এবং উত্তর পাশ থেকে ভিন্নরকম দৃশ্য চোখে ধরা দেয়।
সংস্কারের ছোঁয়ায় লালকুঠিতে বইছে আধুনিকতার হাওয়া। শত বছরের পুরোনো আসবাবপত্র সুঁতোয় বাঁধা পড়েছে। তাতে জমা হয়েছে ধূলিকণা। বিশাল উঁচু হলে লেগেছে বড় বড় এয়ার কন্ডিশনার। বাইরের দেওয়ালের গায়ে লেগেছে লাল রং আর হলের অন্দরে ফুটে উঠেছে শ্বেত শুভ্রের সাদা। সংস্কারের পর লালকুঠি কেবল তার জৌলুসই ফিরে পাবে না বরং ভেতরে লাইব্রেরি, ডিজিটাল আর্কাইভ, বুক ক্যাফে এবং ঐতিহাসিক ছবি প্রদর্শনী গ্যালারি থাকবে। সামনে থাকবে সাংস্কৃতিক উৎসব পালনের স্থান, চা-কফি শপও।

লালকুঠির সৌন্দর্য শুধু স্থাপত্যে নয়, এর ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিন নিজ ইচ্ছাতেই লালকুঠিতে অবকাশ যাপনে মনোস্থির করেছিলেন তিনি। পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি (ঢাকা পৌরসভা) ও পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে লালকুঠিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবিকে। ঢাকার সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ আর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভিড় করেছিলেন সেই সংবর্ধনায়। এরও অনেক বছর পর এখানেই অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল দেশের প্রখ্যাত চিত্রনায়ক প্রবীর মিত্রের। সেই অভিজ্ঞতাতেই রুপালি পর্দায় তিনি ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা।
টাউন হলের পাশেই ছিল পাঠাগার। সংস্কার কাজের জন্য এর গেটে ঝুলছে তালা। তাই লাইব্রেরিতে থাকা বইয়ের মলাট ধরে অদেখা বইয়ের অপূর্ণতা নিয়েই লালকুঠি ছাড়লাম। বাইরে এসে বুড়িগঙ্গার তীর ধরে হাঁটছি। ভাবছি, সংস্কার যদি শেষ হয়, তবে আবারও লালকুঠি হবে ঢাকার পর্যটকদের জন্য এক বড় আকর্ষণ। শতবর্ষী এ ভবনের গল্প আরও একবার পৌঁছবে নতুন প্রজন্মের কাছে। আবারও আড্ডা জমবে লালকুঠিতে।
এসইউ/জিকেএস