শিশুদের প্রয়োজন সুষম খাবার
ফাইল ফটো
প্রখর রোদ। রোদ যেন দুষ্টমী করেই চোখে মুখে পড়ছিল। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সে। ওড়না দিয়ে কয়েকবার ঘাম মুছে নিল নিজের অজান্তে। আবার কাজ করতে লাগল সে। ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ব্রহ্মপুত্র নদ। তার পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট পার্ক। সেখানে ফুসকা আর চটপটির দোকানে কাজ করে একটি মেয়ে। বয়স আনুমানিক ১৩ থেকে ১৪ বছর।
নাম জিজ্ঞাসা করতেই মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় ‘সুমি’। চার ভাই বোনের মধ্যে সুমি সবার বড়। বাবা রিকশা চালিয়ে যে আয় করেন তা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলে না। তাই সুমি লেখাপড়া বন্ধ করে চটপটির দোকানে কাজ করে যে সামান্য আয় করে তা সন্ধ্যার পরে তুলে দেয় মায়ের হাতে। বড় ইচ্ছা ছিল একদিন লেখাপড়া শিখে মস্তবড় অফিসে চাকরি করবে। বাবা-মা আর ভাই-বোনদের মুখে হাসি ফুটাবে একদিন। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিজেকে এখন মানিয়ে নিয়েছে কাজের সাথে। কিন্তু অপুষ্ট তার শরীরে ক্লান্তির চিহ্ন বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। এমনই হাজারো শিশু রয়েছে আমাদের চারপাশে।
অপুষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে- অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। অধিক জনসংখ্যা যে দেশে, সেখানে পরিবেশ দুষিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, অল্প জায়গার মধ্যে অনেক লোকের বসবাসের ফলে নোংরা পানি, আবর্জনায় ভরপুর পথঘাট স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। এ ছাড়া অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্য দ্রব্যের সহজলভ্যতাও কমে যায়। ফলে কিশোর-কিশোরীরা স্বাভাবিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। আর্থিক কারণে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে না পারায় অপুষ্টির শিকার হয়। আবার যে পরিবারে অর্থের সমস্যা নেই, সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অতিরিক্ত পরিমাণে জাঙ্কফুড খাওয়ায় অপুষ্টির শিকার হতে পারে।
পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা যেমন- বয়স অনুপাতে কতটুকু খাবার, কি খাবার, কত সময় পর পর খেতে হবে, তা অনেক মা-বাবাই জানেন না। এখানে সুষম খাবারের ঘাটতি দেখা যায়। অপুষ্টি দূর করতে হলে সুষম খাবার খেতে হবে। এটা শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। রক্তস্বল্পতা, মুখের কোনায় ঘা, পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, চোখের অসুস্থতা, চুল পড়া, পেটে কৃমি, দুর্বলতা, শারীরিক গঠন সুষ্ঠু না হওয়া ইত্যাদি শারীরিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। এছাড়া অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীর বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। তার স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণভাবে ঘটে না। বুদ্ধিগত বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বড় হলে সেই কিশোর বা কিশোরী মেধাবী হতে পারে না। এ কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
অনেকেরই ধারণা বেশি বেশি দুধ ও মাংস খেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। কিন্তু ধারণাটি ঠিক নয়। প্রতিটি মানুষেরই সুষম খাবার অর্থাৎ খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি খাবারে থাকতে হবে, এমন সব খাবার খাওয়া উচিত। সে জন্য মাংস ও দুধের পাশাপাশি মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, ফলমুল সবই খেতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো একটি খাবার বেশি বেশি খাওয়া ভালো নয়।
আমাদের দেশে বহু কিশোর-কিশোরী অপুষ্টির শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ এ্যান্ড সার্ভের (বিডিএইচএস) সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ২৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। এই সমীক্ষায়, কিশোর উচ্চতা ন্যুনতম ১৪৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই হার ১৩ শতাংশের কম। আবার কিশোরদের উচ্চতা ১৫০-১৫৫ সেন্টিমিন্টার হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানেও অনেক কম।
বডি মাস ইনডেক্স (বিএমডি) অনুযায়ী, ওজন ১৮ শতাংশ হতে হবে। এই সার্ভেও উল্লেখ করা হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ কিশোরীর ওজন ১৮ শতাংশের নিচে। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, একজন অপুষ্ট কিশোরীর মাসিক ঋতুস্রাবের শুরুটা দেরীতে হতে পারে। আর এই রোগের প্রধান কারণ পুষ্টিহীনতা।
প্রতিটি শিশুর জন্মের সময় ওজন আড়াই কেজির বেশি হওয়া উচিত। বিডিএইচএস-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাংলাদেশে কম ওজনের শিশু ছিল ৩৬ শতাংশ। কিশোরী মায়েদের মাতৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে তার গর্ভধারণ হলে শিশুটির অপুষ্টি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন। সার্বিকভাবে দেশের কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করতে ব্যাপক উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, উপযুক্ত সম্পুরক খাবার খাওয়ানো, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো এসব কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিশু বয়স থেকেই এটা করতে হবে। তাহলে শিশুদের অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিশোর বয়সেও অপুষ্টির শিকার কম হবে। ভাতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাল, শাক-সবজি, ফলের চাষ বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে অপুষ্টি দূরীকরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। - বাসস