বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফেন্সি
লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াছমিন ফেন্সি। সকলে তাকে বাল্য বিয়ে ফেন্সি আপা বলেই চেনেন। জেলা জুড়ে প্রতিবাদী নারীর মধ্যে একজন তিনি। প্রায় শতাধিক শিশু-কিশোরীর বাল্য বিয়ে ঠেকিয়েছেন।
তিনি নিজেই বাল্য বিয়ের শিকার হয়ে একদিন শশুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাই সংসার জীবনে এর কুফল সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতাও আছে তার। ফলে সেই থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সমাজের আর কোনো মেয়ে জেন তার মতো বাল্য বিয়ের শিকার না হয়।
পরবর্তীতে চাকরি জীবন শুরু করে নেমে পড়েন বাল্যবিয়ে মুক্ত সমাজ গড়তে। দিনে রাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মেয়ের বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তিনি।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে হাতিবান্ধার একটি গ্রামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন চলছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্কুল শিক্ষিকা ফেন্সি। বর ও কনে পক্ষের কাছে বাল্য বিয়ের কুফল তুলে ধরে বিয়ে বন্ধের আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু কোনো পক্ষই তার কথা আমলে না নিয়ে বিয়ে সম্পন্নের কাজ শুরু করেন। পরে তিনি মুঠোফোনে সহযোগিতা চান স্থানীয় প্রশাসনের। মুহুর্তে প্রশাসনের লোকজন ছুটে এসে বিয়ে বন্ধ করে দেয়। আর বর বেশে আসা সেই তরুণ ও তার বড় ভাইকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফলে সেই রাতে বধূ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় শিশুটি। এরপর থেকে স্কুল শিক্ষিকা ফেন্সি একে একে প্রায় শতাধিক বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন।
বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পাওয়া ছাত্রীটি বলেন, ফেন্সি আপা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। ফলে আজও আমি পড়াশোনা করতে পারছি। এজন্য আমি ফেন্সি আপার কাছে কৃতজ্ঞ।
তবে এমন কথা শুধু ওই ছাত্রীর নয়, বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অসংখ্য কিশোরীর। তারাও এনিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সমাজে এমন প্রতিবাদী নারী থাকলে কেউ আর বাল্য বিয়ের দেয়ার সাহস পাবেন না।
ফরিদা ইয়াছমিন ফেন্সির ১৯৮১ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়। তার স্বামী রফিকুল ইসলাম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মার্কেটিংয়ে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। অন্য দুই ছেলের একজন ইতিহাসে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। আর এক ছেলে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন।
অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির কাজকর্ম করতে ও সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে নানা অসুবিধায় পড়েন ফেন্সি। তাই তখন থেকেই তিনি মনে মনে সংকল্প করেন- ‘বাল্যবিবাহের কারণে কোনো মেয়ে শিশু যাতে তার শৈশব ও স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে”। এ জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাওয়ার প্রতিশ্রুবদ্ধ হন তিনি। সংসারের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যান স্বামীর উৎসাহে। লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে বিএসএস পাস করেন। এ ছাড়া তিনি এলএলবি প্রথম ভাগ সম্পন্ন করেন। হাতিবান্ধা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সালে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পরে ২০০৬ সালে প্রধান শিক্ষক হন তিনি।
এই অবস্থায় ২০১২ সালে একই উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫ জন নারী শিক্ষকের অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন আঁচল নারী কল্যাণ সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক হন ফেন্সি। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ওই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বেসরকারি সংস্থা রূপান্তর-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হাতিবান্ধা ইউনিটের সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি এই নেটওয়ার্কের উপজেলা সহসভানেত্রী ও লালমনিরহাট, হাতিবান্ধা বাংলাদেশ স্কাউটের সহকারী লিডার প্রশিক্ষক ।
তিনি যেখানেই বাল্য বিয়ের খবর পান, সেখানেই হাজির হন। অন্যদেরও এ কাজে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। আর বাল্য বিয়ে বন্ধে প্রথমে তিনি চেষ্টা করেন অভিভাবকদের বোঝাতে, এতে ব্যর্থ হলে মুঠোফোন কিংবা লোক পাঠিয়ে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চান স্কুল শিক্ষিকা ফেন্সি।
ফরিদা ইয়াছমিন ফেন্সি জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষকতা শেষেও জীবনের বাকি সময় বাল্যবিবাহ বন্ধ করাসহ নারী-শিশু নির্যাতন বন্ধের জন্য কাজ করে যাবো। এসব কাজে তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসা প্রশাসন, বেসরকারি সংগঠনসহ বিভিন্ন মানুষজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
হাতিবান্ধা উপজেলায় বাল্যবিয়ে বন্ধে অবদান রাখায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদফতর থেকে উপজেলা পর্যায়ে ২০১৩ সালে জয়িতা বাংলাদেশ পুরস্কার পান ফরিদা ইয়াছমিন ফেন্সি।
২০১৪ সালে উপজেলা শিশু ফোরাম তাকে সম্মাননা দেয়। সর্বশেষ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তার অবদানের জন্য বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল চ্যাপ্টারের স্বেচ্ছাসেবক ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশে একক এবং এশিয়ায় যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ফরিদা ইয়াছমিন ফেন্সি।
এফএ/পিআর