বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবকে আলাদা করে বোঝা যাবে না। এটি ছিল একদিকে ছাত্রদের দুর্নীতিবিরোধী প্রকৃত গণআন্দোলন, অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল জালে জড়িয়ে পড়া।
কেউ কেউ বলেন, ইসলামী দলগুলোও এতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে আসল সত্য আরও বিস্তৃত, যেখানে সক্রিয় ছিল একাধিক শক্তি। একই সঙ্গে, বড় মঞ্চটি গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ আর ব্রিকসের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ঘিরে, যারা বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে চাইছে।
এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের গোলকধাঁধায় মূল কাজ হলো সচেতনতা, অদৃশ্য হাতগুলোকে চেনা, জোট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা, আর প্রশ্ন তোলা: বৈশ্বিক দক্ষিণের অংশ হিসেবে আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কেননা, দক্ষিণ যদি উঠে দাঁড়াতে চায়, তবে সেটি হতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে, অন্য কারও খেলায় ঘুঁটি হয়ে নয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শেখ হাসিনার শাসন ছিল গভীরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশের সম্পদ নিঃশেষ করা। একইসঙ্গে এটিও সত্য যে, চীন ও ভারতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁকে অনেক বড় ধরনের সমালোচনা থেকে রক্ষা করেছিল। বিশেষ করে বামপন্থার সেই অংশের কাছ থেকে, যারা তাঁর শাসনামলে প্রায় নীরব ছিল। তবে আজ পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে। আমাদের স্বীকার করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট প্রভাব, যার হস্তক্ষেপ প্রায়ই দেশগুলোকে আরও চরমপন্থি ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে— আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের বড় অংশই এর প্রকট উদাহরণ। যদি আমরা বৈশ্বিক রাজনীতির বৃহত্তর স্রোতগুলো বুঝতে ব্যর্থ হই, তবে বাংলাদেশও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের চলমান ক্ষমতার দ্বন্দ্বের আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
ভিন্নতা মুছে ফেলা আমাদের কাজ নয়। কিংবা এগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাও নয়, বরং এগুলোর সঙ্গে পাশাপাশি বাঁচতে শেখা। এটাই এই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি: বিভাজন নয়, সহাবস্থান; অন্ধকার নয়, আলোর পথে।
আমরা আজ এক গভীর বৈশ্বিক পরিবর্তনের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিশ্বের বহু অঞ্চলের রাজনীতি ক্রমশ আরও স্পষ্টভাবে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে। কেন এমন হচ্ছে তা বোঝার জন্য আমাদের নজর দিতে হবে বামপন্থার ব্যর্থতার দিকে। একসময় ন্যায়বিচার ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, বর্তমানের অনেক বামপন্থা ক্রমে পুঁজিবাদী ও করপোরেট-নির্ভর হয়ে উঠেছে। ধনীদের অর্থায়ন ও করপোরেট স্বার্থে বাধা পড়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাধারণ মানুষের বাস্তবতা ও সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
অনিশ্চয়তা ও হতাশার সময়ে, সাধারণ মানুষ, যাদের একটি বড় অংশ গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ, ধর্মের দিকে ঝোঁকে এবং ঈশ্বরের আশ্রয় খোঁজে। এই আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা সমাজগুলোকে ডানপন্থি রাজনীতির দিকে টেনে আনার অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কারণ এই রাজনীতি অনেক সময় মানুষের অর্থ ও জীবনের মানে খোঁজার ইচ্ছাকে সরাসরি স্পর্শ করে।
তবে ‘বাম’ ও ‘ডান’ লেবেলের বাইরে, মানবজাতি আসলে খুঁজছে ন্যায়বিচার, মর্যাদা, এবং ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অবসান। মানুষ এমন নেতার জন্য আকুল, যারা পৃথিবীকে এক বিশাল বাজার হিসেবে দেখবে না, যেখানে মানুষও পণ্য হয়ে যায়। বরং দয়া, ন্যায্যতা ও পৃথিবীর প্রতি যত্নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে।
এখন প্রয়োজন এমন নেতৃত্বের, যারা সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবা করবে, দুর্বলদের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং পরিবেশকে সুরক্ষিত করবে। এমন নেতা, যারা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে, মানুষের জীবনে অর্থ ও উদ্দেশ্য যোগ করবে, এবং শোষণ থেকে সরে এসে আরও মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।
বাংলাদেশ একটি তরুণ রাষ্ট্র, জন্ম ১৯৭১ সালে। এরপরের দশকগুলোতে আমাদের অন্যতম বড় সংগ্রাম ছিল পরিচয়ের প্রশ্ন। যে রাজনৈতিক শক্তিই ক্ষমতায় এসেছে, তারা পরিচয়ের সংজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারেনি যা আমাদের সবাইকে ধারণ করতে পারে। বরং আমরা আটকে পড়েছি এক দ্বিধায়, আমরা কি প্রথমে বাঙালি, নাকি প্রথমে মুসলমান? এই দুই মাত্রাকে একত্রে মেলাতে না পারার কারণে আমরা ক্রমে বিভক্ত ও খণ্ডিত হয়ে পড়েছি।
সত্য হলো, পরিচয়কে একটি চিহ্নে সীমাবদ্ধ করা যায় না। একটি জাতি এক সংস্কৃতির নয়, বরং বহু সংস্কৃতির সমাহার। বাংলাদেশ হলো ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্যের এক মোজাইক। অথচ এই বহুত্বকে গ্রহণ করার পরিবর্তে আমাদের রাজনীতি নিজেকে সীমিত করেছে চরমপন্থার মধ্যে। একদিকে কঠোরভাবে ধর্মকেন্দ্রিকতা, অন্যদিকে অতিরঞ্জিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। এই দুই মেরুর মধ্যে একটি অভিন্ন মধ্যপথের জন্য খুব সামান্য জায়গাই অবশিষ্ট আছে।
যদি আমরা এই বিভাজনগুলো দূর করতে চাই, তাহলে আমাদের একমাত্রিক নয়, একসঙ্গে বহু পরিচয়ের ধারক হিসেবে নিজেদের দেখা শিখতে হবে। আমাদের বৈচিত্র্যকে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করাই হলো সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র পথ। কেবল তখনই আমরা বুঝতে শুরু করব, বাঙালি কিংবা মুসলমান হয়ে নয়, বরং বাংলাদেশি হয়ে ওঠার প্রকৃত অর্থ কী।
এই যুগে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ছায়াচ্ছন্ন দাবার ছকের ওপর, যেখানে বাইরের শক্তি ও বিদেশি বয়ান আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করতে চায়। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম অন্যের খেলায় ঘুঁটি হয়ে থাকতে চায় না। বাম বা ডান, ঐতিহ্য বা আধুনিকতা, জাতীয়তাবাদ বা বিশ্বায়নের দ্বন্দ্বে আটকে না থেকে তারা খুঁজছে এক মধ্যমপন্থা। তারা নিজেদের ‘সেন্ট্রিস্ট’ বা মধ্যপন্থি বলে। নিষ্ক্রিয়তার কারণে নয়, বরং বিশ্বাস থেকে। এই বিশ্বাস যে, বৈরিতার বদলে আসতে হবে সম্প্রীতি, অন্ধ আনুগত্যের বদলে বেছে নিতে হবে ভারসাম্য।
তাদের খোঁজ কোনো শূন্য স্লোগান নয়, কোনো ভাঙা দেশপ্রেম নয়, বরং মানবিক মর্যাদার সহজ ভিত্তি— একটি দেশ, যেখানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। আমাদের জাতি কোনো এক সংস্করণে বাঁধা ইসলাম নয়, কোনো একক সংস্কৃতিও নয়, বরং বহু উপাদানে গঠিত, যেগুলো একত্রে বোনা হয়েছে একটি যৌথ ঘর হিসেবে।
ভিন্নতা মুছে ফেলা আমাদের কাজ নয়। কিংবা এগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাও নয়, বরং এগুলোর সঙ্গে পাশাপাশি বাঁচতে শেখা। এটাই এই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি: বিভাজন নয়, সহাবস্থান; অন্ধকার নয়, আলোর পথে।
লেখক : শিল্পী ও সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট।ইংরেজি থেকে অনুবাদ : রাসেল মাহমুদ
এইচআর/জিকেএস