ময়মনসিংহের ত্রিশালের এক নৃশংস ঘটনার সংবাদ সম্প্রতি নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত এক ছেলে, টাকা না পেয়ে নিজের জন্মদাতা বাবা-মাকেই হত্যা করেছে! তারপর নির্মমভাবে তাদের লাশ ঘরের মেঝেতে পুঁতে রেখেছে। পিতা—মোহাম্মদ আলী (৭০) ও মাতা—রানোয়ারা বেগম (৬০), যাদের শেষ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল সন্তানের হৃদয়ে, সেই সন্তানই পরিণত হয়েছে তাদের কবর খননকারী হিসেবে। এই ঘটনা কেবল এক পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, বরং সমকালীন সমাজের এক ভয়াবহ সংকেত—একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল নেশার অন্ধকারে।
জানা যায়, প্রথমে মাকে গলা চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়, এরপর বাবাকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে অন্তত চার ফুট গভীর গর্তে তাদের লাশ পুঁতে রাখা হয়। অভিযুক্ত ছেলে অনলাইন জুয়া খেলায় আসক্ত ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম উল্লেখ করেছে। সে টাকা চেয়েছিল পিতা-মাতার কাছে, কিন্তু তা না পেয়ে রাগের উত্তরে এই নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানা গেছে। কিছুদিন আগে নরসিংদীর শিবপুরে একটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছেলে তার মাকে হত্যা করেছে। খবর অনুযায়ী ড্রাগ নেশার কারণে ছেলে মার কাছে টাকা চেয়েছিল– কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হবিগঞ্জে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে ঝগড়ার পর, পনের বছর বয়সী মেয়েকে তার বাবার দ্বারা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এছাড়া কক্সবাজারে একটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে বাবা স্ত্রীর সঙ্গে নেশার টাকা নিয়ে ঝগড়ার সময় চার বছরের মেয়েকে একটি হাতুড়ির আঘাতে হত্যা করেন।
অনেক ঘটনাই ঘটছে পারিবারিক সহিংসতার সীমায়। “Violence against women & children” সংক্রান্ত পুলিশ রিপোর্ট এবং খবরে দেখা যাচ্ছে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে।“Intimate Partner Violence Survey 2024” বলছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন—তবে শিশু বা সন্তান দ্বারা অভিভাবক হত্যার তথ্য তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নরসিংদীতে মে ২০২৫ সালে এক ছেলে তার মাকে হত্যা করেছে। বাড়িতে বাগ্বিতণ্ডার পর ছেলে কাঠের ভারসাম্যহীন বস্তু গলায় ধরে হত্যা করেছে।
পরিবারকে আবার নিরাপত্তার আশ্রয়ে ফিরিয়ে আনতে হলে—প্রথমে আমাদের ফিরতে হবে মানুষ হয়ে ওঠার অনুশীলনে, যেখানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহানুভূতিই হবে পরিবারের আসল ভিত্তি। একসময় পরিবার ছিল ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও শান্তির আশ্রয়। কিন্তু আজ সেই পরিবারই বহু ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে সহিংসতার অগ্নিগর্ভ মঞ্চ। বাবা মারে সন্তানকে, স্বামী নির্যাতন করে স্ত্রীকে, সন্তান আঘাত করে পিতা-মাতাকে—ঘর নামের আশ্রয় যেন হারাচ্ছে তার উষ্ণতা।
এপ্রিল ২০২৪ সালে ছেলের হাতে মা খুন হয়েছেন—চাঁদপুর, ইছাপুর গ্রামে, ছেলের বয়স প্রায় ২২ বছর। খাগড়াছড়ি, আগস্ট ২০২৫: দুই বছরের সন্তানকে মায়ের হাতে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দুই.পারিবারিক সহিংসতার সামগ্রিক চিত্র খেয়াল করলে দেখা যায় জাতিসংঘের ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক বছরে এই সহিংসতার হার ৪১ শতাংশ। শুধু শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৪ শতাংশ নারী, যার মধ্যে ১৬ শতাংশ সহিংসতা ঘটেছে গত এক বছরে।
পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার পেছনে বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে একাধিক কারণ কাজ করছে। এসব কারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও আইনগত পর্যায়ের হতে পারে। নিচে কিছু মূল কারণ, প্রেক্ষাপট, কিছু গবেষণা ও সারাদেশের তথ্যসহ দেওয়া হলো-পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও লিঙ্গ অসমতা অনেক সমাজে পুরুষকে পরিবারের ‘প্রধান আধিপত্য’ ধরা হয়, যেখানে নারী ও মেয়েদের অধিকার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা কম থাকে। এই লিঙ্গভিত্তিক গণ্ডি ও প্রত্যাশা অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতার সুযোগ তৈরি করে। অর্থনৈতিক চাপ ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি বেকারত্ব, আয় খর্ব হাওয়া, ব্যবসার ক্ষতি— এসব মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে এবং সহিংসতার প্রবণতা বাড়ে। COVID-19 প্যান্ডেমিকের সময় এই বিষয়টি আরও প্রকট ছিল। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার সময় মানসিক অবস্থা খারাপ হতে পারে, ক্রোধ, হতাশা, উদ্বেগ বেড়ে যেতে পারে। সহিংসতার রিলিজ হিসেবে এসব সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া মাদক বা অন্য কোনো আসক্তি থাকলে পারিবারিক সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ে। একটানা ঘরে অবস্থান, বেকারত্ব, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময়, বাইরের কোনো সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের ঘাটতি—ফলে ঘরের ভেতরে ঝামেলা, বিবাদ বাড়তে পারে। সহিংসতার মামলা ও হেল্পলাইন কলের পরিমাণও ইদানীং ব্যাপকহারে বেড়েছে।
যদিও বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন রয়েছে (Domestic Violence Prevention and Protection Act 2010 ইত্যাদি), আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, অপরাধীদের প্রতি সহনশীল মনোভাব, শাস্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতা ইত্যাদির কারণে অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থাকে বা ভুক্তভোগী পার পায় না। সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘পরিবারের ব্যাপার’ হিসেবে দেখা হয়। বাড়িতে এমন ঘটনা দেখার অভ্যাস থাকলে, শিশুরা ও অন্য সদস্যরা উপেক্ষা করে বা সহ্য করে যেতে শেখে এবং এটি পরবর্তী প্রজন্মেও বিরূপভাবে প্রভাব ফেলে। যত বেশি মানুষ শিক্ষা ও তথ্য পাবে— তাদের অধিকারে সচেতন হবে, সহিংসতা কি কি ধরনের হয়, কখন আইনগতভাবে সহায়তা পাওয়া যায় ইত্যাদি— সেই অনুযায়ী সহিংসতার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু শিক্ষার অভাব ও সামাজিক রীতি-বিরুদ্ধ সচেতনতার ঘাটতি এখনো প্রকট রয়েছে।
বর্তমান যুগে নারীর শিক্ষা বাড়ছে, কর্মের সুযোগ বাড়ছে, তাদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে। পুরাতন রোল মডেলগুলো যখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন পুরুষ/পরিবারের পুরাতন প্রত্যাশা যেমন- ‘পরিবারে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ’, ‘নারীর কাজ সীমিত হওয়া উচিত’ ও নতুন বাস্তবতার মধ্যে সংঘাত হয়, যা সহিংসতার কারণ হতে পারে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির খরচ বাড়লে পরিবারে অনিশ্চয়তা ও ঐক্যহীনতা বাড়ে। মানুষ নিজে ও পরিবারের বিষয়ে নিরাপত্তাহীন বোধ করলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ে, যা মানুষকে সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে।
তিন.Violence Against Women Survey 2024 অনুসারে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী বলেছেন, বিবাহিত জীবনে আজীবন কোনো না কোনো রকম দাম্পত্য সহিংসতা, মানসিক/অর্থনৈতিক/শারীরিক সহিংসতা বা নিয়ন্ত্রক আচরণের শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা অনেকসময় ঘটনাটি বাড়িয়ে বলে না বা মামলা করে না —সামাজিক লজ্জা, পরিবারের মর্যাদার ভয়, জানাজানি হওয়া ইত্যাদির কারণে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, টেলিভিশন–সব জায়গায় নিয়মিত “গার্হস্থ্য সহিংসতা কী” এবং “এর শাস্তি কী”-এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ছেলে ও মেয়েদের শৈশব থেকেই শেখানো দরকার, সম্পর্ক মানে শ্রদ্ধা ও সমান মর্যাদা, নিয়ন্ত্রণ নয়। ভারতে “Gender Sensitization in Schools” নামে একটি কার্যক্রম চলছে, যা শিক্ষার্থীদের সহিংসতাবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলছে—বাংলাদেশেও এমন পাঠক্রম জরুরি।
পারিবারিক সহিংসতা প্রায়ই মানসিক চাপ, হতাশা বা রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি ক্লিনিকে “Family Counselling Corner” চালু করা যেতে পারে, যেখানে দাম্পত্য বা পারিবারিক দ্বন্দ্বে থাকা মানুষরা পেশাদার কাউন্সেলরের সাহায্য পাবে। শ্রীলঙ্কা সরকার এই মডেল ব্যবহার করে পারিবারিক সহিংসতা ১৮ শতাংশ কমাতে পেরেছে (2020–2023 তথ্য অনুযায়ী)। Domestic Violence (Prevention and Protection) Act, 2010–এর কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার। প্রতিটি থানায় “নারী ও শিশু নির্যাতন সেল” থাকলেও, অভিযোগ নেওয়া ও দ্রুত জিডি রেজিস্ট্রেশনে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। ভারত, নেপাল ও মালয়েশিয়ায় Fast-Track Family Courts চালু হয়েছে—বাংলাদেশেও জেলা পর্যায়ে তা করা যায়।
বর্তমানে জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯ ও ১০৯ আছে, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এতে পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও সাহায্য পাওয়া যায়। এদের প্রচারণা বাড়াতে হবে, যেন গ্রামাঞ্চলের মানুষও সহজে জানে কোথায় কল করতে হবে।“Mobile Safe House” –অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—যেমন পাকিস্তানের লাহোরে চালু আছে। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল নারীরা অনেক সময় সহিংসতা সহ্য করতে বাধ্য হন। এজন্য উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, ডিজিটাল স্কিল ট্রেনিং ও ঘরে বসে আয়মূলক কাজের সুযোগ দিলে তাদের আর্থিক ও মানসিক স্বাধীনতা বাড়বে। রুয়ান্ডায় “Women Cooperative Model” এভাবে পারিবারিক সহিংসতার হার প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। স্থানীয় ইমাম, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধিদের “সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করা যেতে পারে। যেমন—নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, খুলনায় ইতোমধ্যে এমন কয়েকটি স্থানীয় গ্রুপ কাজ করছে, যারা বিরোধ মীমাংসা ও সচেতনতা কর্মশালা করছে। পরিবারভিত্তিক সহিংসতা অনেক সময় সমাজের নীরব অনুমোদন পায়—এটি ভাঙতে স্থানীয় নেতৃত্বের সক্রিয়তা জরুরি। টিভি নাটক, ওয়েবসিরিজ বা বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি অসম্মানজনক উপস্থাপনাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে “টক্সিক রিলেশনশিপ” বা “কন্ট্রোলকে ভালোবাসা ভাবা”—এই ভুল ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণা জরুরি।
ব্রাজিলে “Love is Respect” নামের ক্যাম্পেইন অনলাইনে অনেক সফলতা পেয়েছে—বাংলাদেশেও এমন প্রচারণা চালানো সম্ভব। ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু—সব ধর্মেই পারিবারিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়িত্বের কথা বলা আছে। সেই মূল্যবোধগুলোকে নতুন করে পাঠ্যসূচিতে ও সামাজিক বার্তায় যুক্ত করতে হবে—যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সহিংসতার বদলে সহমর্মিতা শেখে। Shelter Home বা Safe House সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেখানে শুধু আশ্রয় নয়, আইনি সহায়তা, ট্রেনিং, চাকরি-সংযোগ ও মানসিক সহায়তা দিতে হবে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এমন কেন্দ্রগুলোতে ৬ মাসের পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ফলে পুনরায় সহিংসতায় ফেরার ঝুঁকি কমে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ গবেষণা NGO-নির্ভর। সরকারের “Gender Statistics Cell” সক্রিয় করলে এটি আরও টেকসই হবে।
আমরা আজ এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পরিবারের উষ্ণতা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে দগ্ধ বাস্তবতা। একসময় “বাড়ি” মানে ছিল আশ্রয়, শান্তি আর নিরাপত্তা। কিন্তু এখন সেই ঘরই অনেক সময় হয়ে উঠছে রক্তাক্ত, নৃশংস ঘটনার মঞ্চ। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে—বাবা-মাকে হত্যা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নির্যাতন, সন্তানদের ওপর হিংসা—এসব অপরাধ যেন বেড়েই চলেছে।
প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হচ্ছে? পরিবারে ভালোবাসার জায়গা ফুরিয়ে যাচ্ছে কেন?
জীবনের খরচ বাড়ছে, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অর্থের টানাপড়েন, ঋণ, বেকারত্ব—সব মিলিয়ে পরিবারের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষ যখন বারবার ব্যর্থ হয়, তার রাগ, হতাশা, হীনম্মন্যতা—সব একসাথে মিশে যায় সহিংসতায়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা তাই এখন শুধু দরিদ্রতার সংকট নয়, বরং মানসিক ভারসাম্যের সংকট।
চার.অনলাইন জুয়া, গেমিং বা সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর জীবন—এই নতুন ‘অ্যাস্কেপিজম’-এর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে তরুণ সমাজ। বাস্তব সম্পর্কগুলো দুর্বল হচ্ছে, ভার্চুয়াল জগৎ হয়ে উঠছে বাস্তবের বিকল্প। যখন পরিবার “আলাপের জায়গা” হারায়, তখন ভুল বোঝাবুঝি, ক্রোধ আর সহিংসতার জন্ম হয় নিঃশব্দে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবারে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গভীরভাবে প্রোথিত। নারীর আত্মনির্ভরতা ও শিক্ষার প্রসার এই ক্ষমতার ভারসাম্যে ধাক্কা দিয়েছে।
পুরুষরা অনেক সময় এ পরিবর্তনকে হুমকি হিসেবে নেয়—ফল, সম্পর্কের টানাপড়েন ও সহিংসতা।আমরা শারীরিক অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাই, কিন্তু মানসিক ক্লান্তিতে কাউন্সেলর নয়। হতাশা, বিষণ্নতা, রাগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা—এসব থেকে জন্ম নিচ্ছে সহিংসতা। অনেক হত্যাকাণ্ড বা আত্মহত্যার পেছনে থাকে এই নীরব মানসিক ব্যাধি, যা আমরা কখনোই ‘রোগ’ বলে মানি না। পরিবার এখন আর ‘একসাথে থাকার জায়গা নয়—বরং ‘একসাথে থাকা সত্ত্বেও আলাদা থাকার বাস্তবতা। প্রত্যেকে সময় কাটাচ্ছে নিজের ফোনে, নিজের দুনিয়ায়। ভালোবাসা, যত্ন, আলাপ—এসব দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে।
যেখানে যোগাযোগ নেই, সেখানে ভুল বোঝাবুঝি ফুলে ফেঁপে রূপ নেয় সহিংসতায়।
বাংলাদেশে Domestic Violence Prevention and Protection Act, 2010 আছে—কিন্তু অনেক ভুক্তভোগী জানেন না কোথায় যাবেন, কাকে বলবেন, কিংবা বললেও কোনো ফল হবে কিনা। আইন প্রয়োগে জটিলতা, সামাজিক লজ্জা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই সহিংসতাকে আরও বেড়ে দিচ্ছে। পরিবারভিত্তিক মানসিক কাউন্সেলিং সেবা চালু করা দরকার, বিশেষত উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে “মানবিক শিক্ষা” বা “জেন্ডার সেনসিটাইজেশন” কোর্স চালু করা যেতে পারে। প্রতিটি থানায় পরিবার নির্যাতন হেল্প ডেস্ক কার্যকরভাবে চালাতে হবে—৯৯৯ ও ১০৯ হেল্পলাইনের প্রচারণা বাড়াতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ানো, পুরুষের বেকারত্ব কমানো দীর্ঘমেয়াদে সহিংসতা কমানোর মূল উপায়। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা ছড়ানো প্রয়োজন—ভালোবাসা মানে নিয়ন্ত্রণ নয়, শ্রদ্ধা; পরিবার মানে কর্তৃত্ব নয়, সহযাত্রা। সহিংসতা কোনো হঠাৎ জন্ম নেওয়া ঘটনা নয়; এটি আমাদের সমাজের ভেতরকার দীর্ঘদিনের অসুখের প্রতিফলন। আমরা যতদিন পারিবারিক সম্পর্ককে “ক্ষমতার লড়াই” হিসেবে দেখবো, ততদিন ভালোবাসা হারাবে তার অর্থ।
পরিবারকে আবার নিরাপত্তার আশ্রয়ে ফিরিয়ে আনতে হলে—প্রথমে আমাদের ফিরতে হবে মানুষ হয়ে ওঠার অনুশীলনে, যেখানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহানুভূতিই হবে পরিবারের আসল ভিত্তি। একসময় পরিবার ছিল ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও শান্তির আশ্রয়। কিন্তু আজ সেই পরিবারই বহু ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে সহিংসতার অগ্নিগর্ভ মঞ্চ। বাবা মারে সন্তানকে, স্বামী নির্যাতন করে স্ত্রীকে, সন্তান আঘাত করে পিতামাতাকে—ঘর নামের আশ্রয় যেন হারাচ্ছে তার উষ্ণতা।
প্রশ্ন আসে, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে কেন? অর্থনৈতিক চাপ, বেকারত্ব, ঋণ—সব মিলিয়ে জীবনের ভরকেন্দ্র নড়ে গেছে। মানুষের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ, ব্যর্থতা, হীনম্মন্যতা, পরিবারের সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের ওপর ঝরে পড়ছে সহিংস আচরণে। অর্থের সংকট যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ভালোবাসার অনাহার। এক ছাদের নিচে সবাই থাকে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। প্রত্যেকে ডুবে থাকে নিজেকে নিয়ে। পরিবারে এখন শুধু দেয়াল থাকে, মানুষ থাকে না—থাকে নিঃসঙ্গ দেহ।
অন্যদিকে, নারীর আত্মনির্ভরতা বেড়েছে, কিন্তু মানসিকতায় বদল আসেনি সমানতালে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা এখনও কর্তৃত্ব চায়, আর প্রতিরোধ পেলেই রূপ নেয় সহিংসতায়। ভালোবাসা যেখানে সম্মান হারায়, সেখানে পরিবার ভেঙে যায় নিঃশব্দে। হতাশা, রাগ, মানসিক ভারসাম্যহীনতা—এসব এখন নীরব মহামারি। কিন্তু সমাজ এখনও মনে করে, “পাগল না হলে মনোবিদের দরকার কী!” এই অস্বীকারই তৈরি করছে অদেখা আগ্নেয়গিরি, যা একদিন বিস্ফোরিত হয় সহিংসতায়। সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি আমাদের হারানো মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। পরিবার তখনই নিরাপদ হবে, যখন সম্পর্কের মূলে থাকবে ক্ষমতা নয়, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।কারণ পরিবার টিকে থাকে দেয়ালে নয়–টিকে থাকে মানুষের হৃদয়ে।
পাঁচ.রাত জেগে মোবাইলের পর্দায় আঙুল চালাচ্ছে এক তরুণ। চারপাশ নিস্তব্ধ, কিন্তু তার মস্তিষ্কে চলছে উত্তেজনার ঝড়। ‘একটা ম্যাচ জিতলেই লাখ টাকা!’—এই মায়ার দড়িতে বাঁধা পড়েছে অসংখ্য তরুণ। অবশেষে পরদিন সকালে, কেউ হারাচ্ছে টাকার শেষ অঙ্ক, কেউ হারাচ্ছে আত্মসম্মান, আর কেউ কেউ হারাচ্ছে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুও। এ যেন আধুনিক প্রযুক্তির ছদ্মবেশে নতুন এক মাদক—যার নাম অনলাইন জুয়া। আজকের তরুণ প্রজন্মের হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট আর মোবাইল ব্যাংকিং–
এই তিনটি হাতিয়ারই অনলাইন জুয়ার জন্য নিখুঁত অবকাঠামো তৈরি করেছে।“ফ্রি গেম”, “বেটিং”, “ক্যাসিনো অ্যাপ”—এসব শব্দ এখন ডিজিটাল বিনোদনের নামে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ানক গতিতে। এক ক্লিকেই অর্থ লেনদেন, এক সেকেন্ডেই জেতা–হারার নেশা। আর এই সহজলভ্যতা তৈরি করছে ধ্বংসের এক সরল রাস্তা। জুয়া শুধুই টাকার খেলা নয়, এটি মানুষের মস্তিষ্কের পুরস্কার-ব্যবস্থাকে বিকৃত করে দেয়।যখন কেউ “জেতে”, তখন ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা মস্তিষ্কে সাময়িক আনন্দ দেয়। কিন্তু সেই আনন্দের পুনরাবৃত্তি পেতে মানুষ আবার বাজি ধরে, আবার হারায়—এভাবেই সে ডুবে যায় এক চক্রে, যেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। এটি একধরনের আসক্তি, যার প্রভাব মাদকাসক্তির চেয়েও গভীর হতে পারে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যেখানে জুয়ার টাকার জন্য ছেলেরা মেরেছে বাবা-মাকে, স্বামী বিক্রি করেছে স্ত্রীর গয়না, অথবা ছাত্র জুয়ার ঋণে ডুবে আত্মহত্যা করেছে।
অর্থ হারানোর চেয়েও ভয়ংকর হলো নৈতিকতা ও সম্পর্কের অবক্ষয়। যেখানে টাকার কাছে হার মানে রক্তের বন্ধন—সেখানে সমাজের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? বাংলাদেশে পেনাল কোড ও সাইবার আইন অনুযায়ী অনলাইন জুয়া দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু এসব প্ল্যাটফর্ম পরিচালিত হচ্ছে বিদেশি সার্ভারে, যেখানে আইন প্রয়োগের হাত পৌঁছায় না সহজে। বিজ্ঞাপন আসে ফেসবুক, ইউটিউব, এমনকি ক্রীড়া সম্প্রচারেও—যেখানে তরুণেরা প্রলুব্ধ হয় অবচেতনভাবেই। তাই শুধু আইন নয়, দরকার ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা–সচেতনতা।
স্কুল-কলেজে ডিজিটাল সচেতনতা ক্লাস চালু করা উচিত, যেখানে অনলাইন আসক্তি, গেমিং ও জুয়া সম্পর্কে বাস্তব তথ্য শেখানো হবে। মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপগুলোতে বয়স যাচাই ব্যবস্থা ও ট্রান্সেকশন সীমা থাকতে হবে। গণমাধ্যমে প্রচার অভিযান চালাতে হবে, যেমন মাদকবিরোধী প্রচারণা হয়। পরিবারে বাবা-মাকে সন্তানদের অনলাইন আচরণ বোঝার দক্ষতা শেখাতে হবে।
প্রযুক্তি মানুষের জীবনে আলো এনেছে,কিন্তু সেই আলোর ছায়াতেও জন্ম নিয়েছে অন্ধকার। অনলাইন জুয়া সেই অন্ধকারেরই এক নিঃশব্দ দানব—যে দানব নিঃশেষ করে দিচ্ছে তরুণদের স্বপ্ন, শিক্ষা ও মানবিকতা। সময় এসেছে সমাজ–রাষ্ট্র–পরিবার মিলে এই ডিজিটাল মহামারির বিরুদ্ধে একযোগে দাঁড়াবার। না হলে একদিন পুরো প্রজন্ম হারাবে তাদের ভবিষ্যৎ— শুধু একটা “বেটিং নোটিফিকেশনের” বিনিময়ে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/এএসএম