ফিচার

যে হাটে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়ে

বুধবারের সকাল এলেই ঢাকার রামপুরা-বনশ্রীর মেরাদিয়া এলাকায় বদলে যায় দৃশ্যপট। অলস রাস্তা হঠাৎই ভরে ওঠে দোকানিদের হাঁকডাকে, দরদামের হাসিতে, রঙিন কাপড়ের ছোঁয়ায়। কোথাও হাঁড়িপাতিল, কোথাও কাপড়ের স্তূপ আবার কোথাও গৃহস্থালির ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিসে সাজানো পসরা। এই হাট শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়-এ যেন সংসারের গল্পে ভরা এক মেলা, যেখানে প্রতিটি নারীর হাতে মিশে থাকে পরিশ্রম, সঞ্চয় আর সংসার চালানোর নিঃশব্দ প্রজ্ঞা।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মেরাদিয়া হাটে শুরু হয় সাজসাজ রব। কেউ রিকশায় করে নিয়ে আসছেন পণ্যভর্তি বস্তা, কেউ আবার নিজের দোকানের সামনে পসরা বিছাচ্ছেন মনোযোগ দিয়ে। বাতাসে ভেসে আসে মসলার গন্ধ, কাঁচা সবজির সোঁদা ঘ্রাণ আর বাজারের চিরচেনা শব্দ, ‘আপা একবার দেখে যান, কম দামে ভালো জিনিস দিচ্ছি’। হাটের প্রতিটি কোণ যেন জীবনের কোনো না কোনো গল্প বলছে। কারও গল্প সংসারের, কারও সংগ্রামের, কারও বা ছোট একটা স্বপ্নের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।

এই হাটের সবচেয়ে বেশি চোখে পরে নারীদের উপস্থিতি। সকাল থেকেই হাটের ভেতর ভিড় জমায় অসংখ্য নারী ক্রেতা। কেউ কোলে শিশুকে নিয়ে ঘুরছেন, কেউ বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করতে করতে দরদাম করছেন, আবার কেউ একা, হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে মনোযোগ দিয়ে জিনিসপত্র বাছছেন।

তারা সবাই যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা। সংসারের চাল-চলন, সন্তানের প্রয়োজন, নিজের ছোটখাটো আনন্দের গল্পে। একজন কিনছেন নতুন পর্দা, আরেকজন হাঁড়িপাতিল, কেউ বা সন্তানের জন্য জামা।

রামপুরার গৃহিণী শিউলি বেগম হাসতে হাসতে বলেন, এই হাটটা আমাদের জন্য খুব দরকারি। ঘরের যা লাগে সব এখানেই পাই, তাও একটু কম দামে। তাই বুধবার এলেই মনটা খুশি হয়ে যায়।

হাটের এক পাশে হাঁড়িপাতিলের দোকান, পাশে কাপড়ের স্টল আর একটু দূরে গৃহস্থালির প্লাস্টিকের পণ্য। দোকানিরা অভ্যস্ত এই ব্যস্ততায়। কেউ জোরে জোরে ডাকছেন, কেউ বসে হাসিমুখে গ্রাহকের সঙ্গে দরদাম করছেন।

এক দোকানি বলেন, ‘আমরা জানি আপারা সংসার চালান। তাই চেষ্টা করি ভালো জিনিস দিতে, কম দামে। লাভ একটু কম হোক, তবু ক্রেতা যেন খুশি থাকে সেই চেষ্টাই করি।’ তার চোখেমুখে ঝলক খুবই সাধারণ কিন্তু সত্যিকারের আনন্দের, মানুষকে সন্তুষ্ট করার আনন্দ।

নারীদের জন্য এই হাট কেবল কেনাকাটার জায়গা নয়, বরং এক দিনের মুক্তির মেলা। ঘরের চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসার, নিজের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ। কেউ পরিচিত মুখ খুঁজে পান, কারও সঙ্গে বসে চা খান, কেউ আবার পুতুল বা গয়নার দোকানে ঘুরে দেখেন নতুন কিছু।

এক তরুণী বলেন, ‘সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকি। এই একদিন একটু নিজের মতো সময় পাই। কিছু কেনাকাটা করি, কিছু গল্প করি। এটাই আনন্দ।’ এই কথাগুলোই বলে দেয়, হাট কেবল কেনাবেচা নয় এটি জীবনের ছোট ছোট সুখের আড্ডা।

মেরাদিয়া হাটে ঢুকলেই দেখা যায় এক রঙিন চিত্রপট নীল, লাল, সবুজ কাপড়ের ভাঁজে সূর্যের আলো, সস্তা গয়নায় ঝিকমিকে রঙ আর মিষ্টি গলার ডাক, ‘দেখে যান আপা, নতুন ডিজাইন আইছে!’ শিশুরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ আইসক্রিম খাচ্ছে, কেউ বেলুন হাতে নিয়ে হাসছে। সবকিছুর ভেতরে এক অনন্য সুর বাজে। এই হাটে অর্থনীতি, পরিশ্রম, সম্পর্ক সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এখানে বিক্রি হয় না শুধু জিনিস; বিক্রি হয় সংসারের গল্প, পরিশ্রমের ঘ্রাণ, জীবনের প্রাণবন্ততা।

বিকেলের দিকে সূর্য যখন ঢলে পড়ে, হাটে তখন গুটিয়ে নেওয়ার ব্যস্ততা। দোকানিরা মালপত্র গোছাচ্ছেন, ক্রেতারা শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা সারছেন। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হতে শুরু করে চারপাশ।

মেরাদিয়া হাট কোনো অভিজাত শপিং মল নয়, কোনো চকচকে বাজারও নয়। কিন্তু এখানেই প্রতিটি দরদামে মিশে থাকে জীবনের সত্য, প্রতিটি হাসিতে লুকিয়ে থাকে সংগ্রামের গল্প। এই হাট প্রমাণ করে মানুষ শুধু টাকার বিনিময়ে নয়, ভালোবাসা ও পরিশ্রমের বিনিময়েও একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকে। বুধবার এলেই তাই ঢাকার এই কোণে আবারও জেগে ওঠে সেই রঙিন মেলা, যেখানে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়ে।

জেএস/