পৃথিবীর বয়স যত বাড়ে; পৃথিবীকে তত বেশি সভ্য হতে হয়। এটাই তো স্বাভাবিক প্রথা বা রীতিনীতি হওয়া উচিত। তা না হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম বর্বরোচিত কালের ছায়া স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। অন্যথায় আমাদের সভ্যতায় বিপরীত আবহমানতার দৃশ্য আরও প্রকটভাবে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পঁয়ত্রিশ বছর পৃথিবীতে আমার যা জানাশোনা হলো, ক্ষুদ্রতর অভিজ্ঞতায় জীবনক্ষেত্রের সম্মুখভাবে ত্বরান্বিত উজ্জ্বল দিনের মতো তা পরিস্ফুটিত। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি কী হয়েছিল, তা না ভেবে যদি আমার শুরু থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই দিগন্ত পর্যন্ত অবলোকন করি; তাহলে পূর্ববর্তী সময়ের সাদৃশ্যের কোনো তফাত করতে পারি না।
বাস্তব জীবনের এবং বিশ্বগ্রামের মনোজগত আজ নারকীয় অবস্থায় অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি। সামাজিক বা মানসিক দূরত্ব, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, পৃথকীকরণ এবং আবেগগতভাবে দূরে সরে যাওয়া- যেন কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের সমান ব্ল্যাকহোলের গভীরতা সমান দুঃখের পাতাল বিনির্মাণ হচ্ছে। ফলে বিশ্ব মানচিত্র সদাচার এবং শুদ্ধাচারের গভীরতম সংকটে নিমজ্জিত। এর মধ্য দিয়েও সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির পথে পৃথিবীর বিভিন্ন অভিনবত্বের আবিষ্কার আলোর মুখ দেখছে। কেন, কীভাবে, কী কারণে তার সুফল বা সুবিধাসমূহ ব্যবহারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এত বড় পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেট প্রযুক্তি সংযোগের কারণে মানববিশ্বের সঙ্গে একটা ডিরেক্ট কানেকশন চালু হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী বিশ্বমানবতার সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষেত্র, প্রেক্ষাপট, মাধ্যম আর বর্তমানের অবস্থান সম্পূর্ণভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈসাদৃশ্যের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। আমাদের অভিজ্ঞতা শিকড়সমেত সময়ের পথে অত্যন্ত শক্তিশালী মানসম্মত, মহৎ সাহিত্যের উচ্চতর স্থানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে পদচারণা করছে। এখন আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি, প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য সহজেই উপলব্ধিতে সক্ষম। বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা, ওশেনিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অ্যান্টার্কটিকা তথা মহাবিশ্বের নানা কেন্দ্রের পথে-প্রান্তের নানাবিধ জ্ঞানার্জনে বিশ্বপ্রকৃতির খুঁটিনাটি জানছি আঙুলের ক্লিকে এবং দৃষ্টিকে স্থিতিশীল অবস্থায় এমনকি শ্রবণেন্দ্রিয়কে ঠিকঠাক রেখে।
এখন নিত্যনতুন তথ্য-উপাত্ত, তথ্য-প্রযুক্তি এবং তার শক্তির উৎস রহস্য, রহস্য-উৎসের নেপথ্যের কোনো প্রকার লুকোচুরি নেই। যেন খোলামেলা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কোনো কিছুই অগোচরে নেই বরং গোচরে ভেসে ভেসে আসছে সম্মুখে।বিশ্বপ্রকৃতি, বিশ্বপরিক্রমা, বিশ্বপরিচয় এখন অন্ধকারে নেই। প্রকৃতিতত্ত্ব এবং বিশ্বতত্ত্ব ছাড়াও সাহিত্য গবেষক, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা এখন অনেক। ফলশ্রুতিতেই নানাবিধ সাহিত্য আর অজানা নয়। এটি বরং বেশ উপভোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপরও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য সংকট প্রকটভাবে উভয় সংকটে নিমজ্জিত। রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্বিন্যাসের সঙ্গে সাহিত্যের কাঠামোর সম্পর্ক গভীরতর। আমাদের সাহিত্যের ভান্ডার সম্পদের ভান্ডারের মতো যথেষ্ট। কিন্তু এর সঠিক সংস্থান সুনিশ্চিত করতে না পারলে সাহিত্যের যেমন ভগ্নদশা নিশ্চিত; তেমনই রাষ্ট্রের ভগ্নদশা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বাস্তব পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ে নীতিনৈতিকতার স্খলন ঘটেছে। এর শিরশ্ছেদ দিতে পারলে বিশ্বসাহিত্য তথা বিশ্ববাসী প্রশান্তির সুখ সংকট থেকে উত্তরণ হবে।
আরও পড়ুনহুমায়ূন আহমেদ: সময়ের প্রতিচ্ছবি জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ
এখানে প্রকৃষ্টরূপে মুখরিত হয় জীবনানন্দ দাশের বাগ্মিতা, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, জসীম উদ্দীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, আবুল হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামদের ভাষাপ্রবাহ তরঙ্গভঙ্গের খেলা।এ ছাড়া প্রতিনিয়তই আলোচনা চলছে ফ্রেডরিক নিৎসের সাহিত্যকর্ম, লাজলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের বর্ণাঢ্য সাহিত্যকর্ম এবং হান কাংয়ের চমৎকার কাব্যিক গদ্য নিয়ে। একসময় সুন্দর পৃথিবীতে রাজনীতিতে সর্বত্র বিশ্বমানবতার জয়জয়কার ধ্বনি তরঙ্গায়িত হতো। এখন পুরোপুরি উল্টোপথে সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক অঙ্গন হেঁটে চলেছে। স্বজাতির প্রতি স্বজাতির বিরুদ্ধাচারণ, অন্য জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্রের প্রতি আরও কী যে শোচনীয় অবস্থা; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখকের প্রতি লেখকের অসম্মান, অহমিকা, ইগোয়েটিক মনোভাব, সিনিয়র-জুনিয়র তকমায় অভদ্রোচিত আচার-আচরণ। এসব মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় কতটা সংকটে তা বিমূর্ত করে তোলে।
জেনেছি একসময় নিপীড়িত অত্যাচারিত জাতির পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল ছিল ইংল্যান্ড। এখন সেটা বোধহয় বিলীন হয়েছে। সাম্যাবস্থার সমাধি রচিত হয়েছে নব্য সাম্রাজ্যবাদের চাতুর্যে কলুষিত হয়ে। পৃথিবীর মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোনো শক্তি নেই; যা কিছু আছে তা হলো অপশক্তি আর ক্ষমতা অপব্যবহারের কারসাজি। বুদ্ধিমত্তার পৃথিবী। টেকনোলজির পৃথিবী। ধূর্ত পৃথিবী। চালাক পৃথিবী। তার বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা, চাতুর্য এবং চিন্তাভাবনার জোরে আবিষ্কার করেছে অপরাজেয় শক্তি। সেটাকে মেধাশক্তি অথবা যন্ত্রশক্তি বলা যেতে পারে। এর ফলেই যত অসভ্যতা নামক অসদাচার শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী। আপনার কর্তৃত্ব এখন বিশ্বকর্তৃত্বের হাতে; যথেচ্ছাচার চর্চায় নিঃসহায় জাতি-গোষ্ঠী, জাতি-ধর্ম অসহায় থেকে আরও অসহায় হচ্ছে। দমন-পীড়নে নির্যাতিত, বঞ্চিত হয়ে পদে পদে নিঃস্ব হচ্ছে। রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, ধ্বংসস্তূপে সহায় সম্বল ভূমি হারাচ্ছে। হৃতসর্বস্ব হচ্ছে। প্রাণ হারাচ্ছে।
পৃথিবী ভীত-সন্ত্রস্ত হচ্ছে। হাতের মুঠোয় দৃশ্যমান পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল (পারমাণবিক অস্পষ্টতা) ক্ষমতার জোরে সর্বতোভাবে কী রকম তুড়ি মেরে চালাচ্ছে বিশ্বকে! এসব রাষ্ট্র নগরীর সাহিত্য বিস্তারে নিরাময় বিস্তারের কী চমৎকার কঠোর পরিশ্রম; সৃজনশীলতাও আজকাল প্রকাণ্ড সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পতিত অনাবাদি জমির ফসল। এই নির্বুদ্ধিতার খেসারত হিসেবে মূর্খতা, ধূর্তামি, দৈন্যদশা কাতর হয়ে আত্মানবতাসহ বিশ্ববিবেককে অনগ্রসর অপসারিত করে জর্জরিত করছে। সেখানে বিশুদ্ধ প্রকৃতিসম্বন্ধ, মানবসম্বন্ধ, সাহিত্যসম্বন্ধ সর্বত্র কতটুকু প্রভাব বিস্তার করছে; বিষয়টি অগোচরে থেকে যায়। আরও বিশুদ্ধ ও শুদ্ধাচার সাহিত্য জানা ও উপভোগ করা মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয় রহস্যময় থাকে।
পরিচিত ফ্রান্স প্রবাসীর মারফত জেনেই আনন্দ হয়েছিল আমার মনে: প্যারিসের কৃষ্টি-কালচার, রীতিনীতি, প্রথা, আইন-কানুন, সিস্টেম, পরিবেশ আমাকে বিমুগ্ধ করেছিল; আমার হৃদয় অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেখানকার আইনব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র অধিকারের ন্যায্যতা ও সাম্যের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক ভূমিকা দেখায় না। বেদনার কথা বেদনার সঙ্গে বলাই ভালো, আমার জাতি-গোষ্ঠীর, জাতি-ধর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা, রাজনীতি-অর্থনীতি, শিল্প-ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অন্যান্য সব দিকে ভঙ্গুর জরাগ্রস্তের জন্য দায়ী পরচর্চা, নিন্দাসূচক বিশেষণ, অলসতা, দুর্নীতি, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, মানুষে মানুষে বিরুদ্ধাচারণ, হিংসা, পরশ্রীকাতর, ঈর্ষাকাতর, অমর্যাদা, দোষারোপ, অসম্মানজনক অসৌজন্যমূলক আচরণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠীকে উন্নততর সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে কঠোর অধ্যবসায়ী রূপের বিবর্তন জরুরি। সাথে সুনীতি চর্চায় বিশুদ্ধ মানবসম্বন্ধকে শুদ্ধাচার ও সদাচার লালন-পালন করতে হবে এবং সরকারকে সহনশীল বেশে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই সাম্যতা ও ন্যায্যতার পক্ষে এবং গণতন্ত্রকামী হতে হবে। পরিশেষে বলতে হয়, বর্তমানের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ব্যবহার পুনরালোচনা, ন্যায়বুদ্ধির অনুশাসন বিধিবিধান এবং সাহিত্যানুরাগীদের নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের দিগন্তের দিকে ছড়িতে পড়তে হবে। সাহিত্যজগৎ, মনজগৎ, সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে নিবিষ্ট হয়ে।
লেখক: কবি ও শিক্ষক।
এসইউ