ধারাবাহিক রচনা-তিন

জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার
সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার , লেখক
প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

লাকাঁর এই গল্পের উদাহারণ বেশ সাদামাঠা মনে হলেও মোটেও তা নয়। সাহিত্য, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, কিংবা মনঃসমীক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাকাঁর এ আলোচনা অত্যন্ত অর্থবহ। সুস্যুরের কাছে যে চিঠির অর্থ মাত্র একটাই; সেখানে এ চিঠি যতবার হাত বদল হয়েছে ততবারই এর অর্থ পাল্টেছে। রানির কাছে চিঠির অর্থ একরকম, প্রেমিকের চিঠি বলে কথা! মন্ত্রীর কাছে প্রেমের চিঠির কী বা মানে থাকতে পারে? তারপরেও এই চিঠি চুরি করার অর্থ রানিকে বেকায়দায় ফেলা। কারণ হয়তো রানির প্রতি মন্ত্রী কোনো কারণে বিরক্ত। পুলিশ অফিসার টাকার বিনিময়ে কাজটি করে দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে দুপ্যা এই চিঠি উদ্ধার তার প্রফেশনাল লাইফের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। ইত্যাদি। সিগ্নিফাইডের অর্থ বদল চিঠির হাত বদলের মতো।

আমরা দেকার্তের কোজিটোর সাথে পরিচিত। দেকার্ত দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আমার চিন্তা করার ক্ষমতা আমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ফরাসি দর্শনের দীর্ঘ ইতিহাসে এ কথার মূল্য সমধিক। তাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয়। দেকার্ত যে ‘আমি’র কথা বলেছেন; সেটা অখণ্ড, আত্ম-স্বচ্ছ, ব্যক্তিক চেতনা সম্পন্ন, পরিপূর্ণ ও অভগ্ন আমি। কিন্তু লাকাঁ সাংঘাতিকভাবে এর বিরোধিতা করে বলেন, আমি কিছুতেই অভগ্ন নয়। এই আমি খণ্ডিত এবং সময় ও বাস্তবতার ওপর গড়ে ওঠা একটা ভগ্নাংশ; যা গঠিত হয়ে থাকে অন্যের চিন্তা-ভাবনা এমনকি ইচ্ছার ওপর। এ সম্পর্কে লাকাঁর বক্তব্যটা অত্যন্ত গুরুত্বের। লাকাঁ বলেন, ‘man’s desire is the desire of the Other’। কাজেই আমার চেতনা, আমার ইচ্ছা পুরোটাই অন্যের দ্বারা সংগঠিত, অন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ‘আমি চিন্তা করি কাজেই আমি অস্তিত্বশীল’-এ ধরনের বক্তব্য ভুল যুক্তি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। ‘আমি চিন্তা করি’ বাক্য থেকে কিছুতেই ‘আমি অস্তিত্বশীল’ বাক্যে অবরোহণ করা যথার্থ নয়।

>> রেজিস্ট্রার তত্ত্ব
মানুষের তিনটি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে লাকাঁর রেজিস্ট্রার তত্ত্ব। অভিজ্ঞতার এই তিনটি অনুষঙ্গ হলো, কাল্পনিক (Imaginary), প্রতীকী (Symbolic) ও বাস্তব (Real)। ইমাজিনারি বা কাল্পনিক পর্বে শিশুর অহং গঠিত হয়। বলতে গেলে এই পর্বে প্রতিচ্ছবি ও শনাক্তকরণের মাধ্যমে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। মনে রাখার বিষয়, এই পর্বটি লাকাঁর বহুল আলোচিত আয়না ধাপ বা মুকুর ধাপ নামে পরিচিত। শৈশব থেকে ব্যক্তি মানস গঠনে কীভাবে অন্যান্য বিষয় ভূমিকা রাখে, তার একটা ডায়াগ্রামিক ম্যাপ হাজির করেছেন লাকাঁ। এর প্রথম ধাপ হলো, মুকুর ধাপ লাকাঁর ভাষায় le stade du mirror। একজন শিশু যখন প্রথম আয়নায় তার নিজের ছবি দেখে; তখন সে বুঝতে পারে সে একজন একক সত্তা। এর আগে শিশু নিজেকে অনুভব করতো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হিসেবে। শিশু ৬ মাস থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত বয়সের মধ্যে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।

সিম্বলিক বা প্রতীকী অভিজ্ঞতা সাধারণত ভাষা ও সমাজ ঘিরে গড়ে ওঠে। শিশুর বিকাশের এই পর্ব বুঝতে আমাদের তার ভাষা শেখার আগে ও পরের অবস্থা বুঝতে হবে। শিশু যখন কল্প জগতে বাস করে; তখন তার মায়ের সাথে গড়ে ওঠে আয়নার মতো সম্পর্ক। এই জগত আসলে প্রতিচ্ছবি, সংবেদন এবং কল্পনার সমগ্রতা। এটাই ভাষা আত্মিকরণের পূর্ববর্তী অবস্থান। যখন শিশু কথা বলতে শিখে ফেলে তখন সে সমাজ স্বীকৃত প্রতীক এবং সিগ্নিফাইয়ার বাধ্যতামূলকভাবে শিখে থাকে। এর ফলে শিশু ভাষা শেখার আগে ও পরের পার্থক্য করতে জেনে যায়। শিশু নিজেই তখন একটা সাবজেক্ট হয়ে পড়ে। মানুষের নির্জ্ঞান স্তর ভাষার মতোই কাঠামোবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রতীকী পর্বকে বলা হচ্ছে আইনের পিতা।

জ্যাক লাকাঁর রেজিস্ট্রার থিওরির সবশেষ ধাপ হলো ‘রিয়েল’ বা বাস্তব। রিয়েল বা বাস্তব হলো এমন এক ধারণা, যা মানব অভিজ্ঞতার সেই অংশকে বোঝায় যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এবং যা আমাদের সচেতনতা বা কল্পনার বাইরে থাকে। এটি সেই চূড়ান্ত, অনির্বচনীয় এবং অসংগঠিত বাস্তবতাকে বোঝায়, যা সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী (Symbolic) বা কল্পনার (Imaginary) স্তরে ধরা পড়ে না। এটি এমন একটি ধারণা, যা মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং বাস্তবতার মধ্যে একটি মৌলিক বিভাজন তৈরি করে। যেমন ধরুন, আপনি যদি কোনো একটা মারাত্মক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন; তখন বলে থাকেন, ‘আমার যে কী হয়েছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না’। এই অব্যক্ত কথাই হলো রিয়েল। আবার ধরুন স্বপ্ন। স্বপ্ন এমন এক অভিজ্ঞতা, যা অনেক সময় কোনো যুক্তি মানে না এবং ভাষার মাধ্যমে তার সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা যায় না। স্বপ্নের সেই অসংলগ্ন এবং অবাস্তব অংশটি ‘দ্য রিয়েল’ হতে পারে, যা আমাদের মনের অবচেতন অংশ থেকে উঠে আসে।

যা হোক, ইমাজিনারি, সিম্বলিক এবং রিয়েলের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে গেলে একটা চেস গেম বা দাবা খেলার উদাহারণ দিলে ভালো হবে। দাবার ঘুঁটিগুলোর আকার ও রং হচ্ছে ইমাজিনারি। দাবার নিয়ম-কানুন, অর্থাৎ কোন ঘুঁটি কীভাবে চালবে, এটাকে সিম্বলিক বলা হবে। আর রিয়েল হচ্ছে খেলার ওপর প্রভাব ফেলা সমস্ত অপ্রত্যাশিত ও অনির্ভরযোগ্য ঘটনা। যেমন: কোনো খেলোয়াড়ের বুদ্ধিমত্তা, অপ্রত্যাশিত কোনো ব্যাঘাত, অথবা প্রতারণা। দ্য রিয়েল হলো এমন কিছু যা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘটে যায়।

>> লাকাঁ ও ফ্রয়েড
পুরোনো দিনের রাজ্জাক-শবনম অভিনীত জনপ্রিয় একটা গান নিশ্চয়ই সবার মনে আছে—‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন/ কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে’। সত্যি আমরা যদি আয়নায় নিজেকে না দেখতাম তাহলে গণ্ডদেশের কালো তিল দেখতে পেতাম না। ছোট্ট শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে অন্তত ৬ থেকে ১৮ মাসের ভেতর; তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে অন্যদের থেকে সে আলাদা! লাকাঁর দর্শনে শৈশবের এই পর্বকে আমরা নাম দিয়েছি মুকুর ধাপ বা আয়না পর্ব। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে এই পর্ব নিয়ে লাকাঁর নির্মোহ ব্যাখ্যা আমাদের যুগ যুগ ধরে ভাবাবে। লাকাঁর বিশেষত্ব অন্য যে কোনো অংশ থেকে এটাই সবচেয়ে অর্থবহ। কিছুক্ষণ আগে আমরা লক্ষ্য করলাম, মনের নির্জ্ঞান ধারণা ব্যাখ্যা করতে ফ্রয়েড মনের গঠনকে তিনটা স্তরে ভাগ করেছেন; যার ভেতরে অদস, ইগো ও সুপার ইগো বা অধিশাস্তার মাঝে এক বিরোধ আছে বলে প্রতীয়মান হলো। এবং এটাও দেখলাম, মনের অনেক ইচ্ছা অবদমিত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু লাকাঁ মনের সেই নির্জ্ঞান ধারণাকে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ভাষার মতো কাঠামোগত, পরিচয় গঠনে প্রতীক এবং সামাজিক আলোচনার ভূমিকাকে সামনে রেখে। অর্থাৎ ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক ধারণাকে সাথে নিয়ে লাকাঁ ভাষার উত্তর-কাঠামোবাদের ফ্রেমে ফেলেছেন। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। আমরা ফ্রয়েডের বেলায় মনের স্তরের তিনটা ধাপ নিয়ে যে আলোচনা করলাম; সেই বিষয়টা লাকাঁর চিন্তায় উঠে এসেছে আয়না ধাপ বা মুকুর ধাপ এবং প্রতীকী অনুবৃত্তির মাধ্যমে।

ফ্রয়েড নির্জ্ঞান স্তরকে মনের ভাঁড়ার ঘর হিসেবে চিন্তা করেছেন; যেখানে জমা থাকে মানুষের কামনেচ্ছা বিশেষ করে যৌনেচ্ছা। কিন্তু লাকাঁ বলছেন, এটা আসলে কোনো বিশেষ জায়গা নয় বরং এটা একটা ভাষার মতো কাঠামো। আসলে এগুলো মানুষের পাশবিক আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার নয় বরং ভাষার প্রত্যিকায়নের অনুবৃত্তির দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে।

সন্দেহাতীত ভাবে বলা যাবে, জ্যাক লাকাঁ আমাদের চিন্তার জগতকে মারাত্মকভাবে আন্দোলিত করেছেন। ফ্রয়েড মানুষের মনের গভীর অন্তঃপুরে অকথিত বাণীর হদিস মেলাতে চেয়েছেন। লাকাঁ সেই অগ্রন্থিত বাণীর পিঠে চড়িয়ে দিয়েছেন পাখা। জ্যাক লাকাঁকে উত্তর-আধুনিক চিন্তার অগ্রণী ভূমিকায় আমরা লক্ষ্য করি। কারণ তাঁর মনোবিশ্লেষণ ও মনঃসমীক্ষণ মানুষের ভাষাতাত্ত্বিক জগতবীক্ষার ওপর দারুণ ভূমিকা রেখেছে। সেখানে সমগ্র সত্যের বিপরীতে জ্যাক লাকাঁ মানবসত্তার বিচ্ছিন্ন ও ভগ্নদশার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

আগের পর্ব
> ধারাবাহিক রচনা-এক; জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ
> ধারাবাহিক রচনা-দুই; জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।