ভ্রমণ

শতবর্ষী ঐতিহ্যের স্মারক যে মসজিদ

মো. রাহুল শেখ

প্রায় দেড়শ বছর ধরে স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অবস্থিত দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। নবাবি আমলের স্থাপত্যশৈলীর কারণে মসজিদটি হয়ে উঠেছে শতবর্ষী ঐতিহ্যের স্মারক। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময় এটি সংস্কার হলেও ধরে রাখা হয়েছে এর মূল নকশা ও স্থাপত্যশৈলী। স্থাপত্যশৈলীর চাকচিক্য পর্যটকদের মুগ্ধ করছে।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কোন্ডা ইউনিয়নের দোলেশ্বর গ্রামে ১৮৬৮ সালে দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ নিজ উদ্যোগে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। তাঁর ছেলে মইজউদ্দিন আহাম্মদ মসজিদের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। মইজদ্দিন আহাম্মদ, তমিজউদ্দিন আহাম্মদ, করিমউদ্দিন আহাম্মদ, খিদির বক্স মিয়া ও আবদুর গফুর আহাম্মদ মসজিদটির জন্য জমি দান করেন।

মসজিদের ইতিহাসমসজিদের সাইনবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সহোদর খিদির বক্স ও কাদের বক্স এবং মইজউদ্দিন আহাম্মদের পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমে মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়নকাজে অংশগ্রহণ করেন। কাদের বক্সের নাতি ও হাফেজ মো. মুছার ছেলে হামিদুর রহমান ১৯৬৮ সালে মিনারসহ মসজিদটির বর্ধিতাংশের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। কালের বিবর্তনে মসজিদটির মূল অবকাঠামো প্রায় বিলীন হওয়ায় হামিদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা নিজ উদ্যোগে স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদের মাধ্যমে মসজিদটি পুরোনো স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণ্ণ রেখে পুনরায় সংস্কারের কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে মসজিদের সংস্কারকাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

আরও পড়ুনআবার লালকুঠি হবে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ ৭০০ বছরের ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শন 

মসজিদের নামকরণজনশ্রুতি আছে, দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ মসজিদটির নির্মাণে প্রথম উদ্যোক্তা হওয়ায় এটি ‘দারোগা মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া মসজিদটির পূর্ণনাম দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদের নামকরণ হয়েছে মূলত ‌‘দোলেশ্বর’ নামক স্থানের নামে এবং ‘হানাফিয়া’ শব্দটি সম্ভবত ইমাম আবু হানিফার (রা.) হানাফি মাযহাব অনুসরণকারীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যা মসজিদের ধর্মীয় পরিচিতি বহন করে। এ ছাড়া মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে লাল রঙের হওয়ায় স্থানীয়ভাবে ‘লাল মসজিদ’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।

নির্মাণশৈলীর নিপুণতামসজিদটি লাল ইটের নির্মিত, যা ঐতিহাসিক বাংলার মসজিদগুলোর প্রাচীন নির্মাণশৈলীর সঙ্গে মিল আছে। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এক গম্বুজবিশিষ্ট নকশা। গম্বুজটি উঁচু ও গোলাকৃতির। গম্বুজের চারপাশে ছোট ছোট মিনার স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথে খিলানযুক্ত দরজা আছে, যার ওপরের অংশে সূক্ষ্ম কারুকার্য খোদাই করা। সামনের দেওয়ালে ও প্রবেশপথের চারপাশেও খোদাই করা নকশা দেখা যায়। মসজিদের অভ্যন্তরের অংশটি উঁচু ও প্রশস্ত। যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া মসজিদের আশপাশে সবুজ ঘাস ও ছোট ছোট গাছের সমাহার। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও নকশা ঠিক রেখে পুনঃসংস্কার করায় মসজিদটি ব্যতিক্রমী স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।

অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট লাভ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশনে ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয় ঐতিহাসিক মসজিদটি। সেই থেকে মসজিদটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নানা শ্রেণিপেশার মানুষের আগমন ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মসজিদটির ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পেরে দর্শনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ঘুরে আসলাম ঐতিহাসিক দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ থেকে।

লেখক: কার্যনির্বাহী সদস্য, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স।

এসইউ