আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান যেন এক পরিচিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন ছিল বেনিন। সেখানে গত রোববার (৭ ডিসেম্বর) কয়েক ঘণ্টার জন্য ক্ষমতা দখলের ঘোষণা আসে। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকার জানায়, সেনা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
মূলত ২০২০ সাল থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থানের ঢেউ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, সাংবিধানিক পরিবর্তন, নিরাপত্তাহীনতা ও তরুণদের ক্ষোভ—সব মিলিয়ে অভ্যুত্থানের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বারবার।
জেনে নেওয়া যাক আফ্রিকায় কোন কোন দেশে সম্প্রতি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে-
মালি: পরপর দুই অভ্যুত্থানমালিতে ২০২০ সালে প্রথম অভ্যুত্থান ঘটে ব্যাপক নাগরিক বিক্ষোভের পর। সেনারা তখন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম কেইতাকে আটক করেন। সামরিক নেতা কর্নেল আসিমি গোইতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকারের অংশ হলেও ২০২১ সালে আবারও ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ঘোষিত নির্বাচন ২০২২ সাল থেকে ঠেলে নিয়ে গেছেন একেবারে ২০৭৭ সালে।
নিরাপত্তার অজুহাতে মালি, বুরকিনা ফাসো ও নাইজার—এই তিন সেনাশাসিত দেশ নিজেদের আলাদা জোট গঠন করেছে এবং গণতন্ত্রে ফিরতে দৃঢ় আপত্তি জানিয়েছে।
চাদ: বংশানুক্রমিক ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় সামরিক কর্তৃত্ব২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট ইদরিস দেবে নিহত হলে তার ছেলে মাহামাত ইদরিস দেবে দ্রুত ক্ষমতা দখল করেন। তিনি পরে নির্বাচন আয়োজন করলেও বিরোধী দলগুলো সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে দাবি করে। এরপর থেকে সমালোচকদের ওপর চড়া হন ইদরিস। এ বছরের শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাকিস মাসরাকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গিনি: সংবিধান বদল ও তৃতীয় মেয়াদে যাওয়ার চেষ্টা২০২০ সালে আলফা কঁদে সংবিধান পরিবর্তন করে তৃতীয়বার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন। এর পরপরই সেনাপ্রধান মামাদি দুম্বুয়া ক্ষমতা দখল করেন। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের পর তিনি চলতি মাসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তার আগেই প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করেছেন দুম্বুয়া।
সুদান: অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ২৬ বছর ধরে দেশশাসন করা ওমর আল-বশিরকে সরিয়ে ২০২১ সালে সুদানের ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আবদেল-ফাত্তাহ বুরহান । পরে তিনি মোহাম্মদ হেমেদটি দাগালোর সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন। কিন্তু ২০২৩ সালের এপ্রিলে তাদের মধ্যকার বিরোধ ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেশী মালির মতো বুরকিনা ফাসোও পরপর দুইবার সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছে। ২০২২ সালে প্রথমে প্রেসিডেন্ট রক কাবোরেকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল দ্যাবা। কয়েক মাস পর আবারও বিদ্রোহের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেন ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। তিনি এখনো দেশ পরিচালনা করছেন এবং নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়েছেন।
নাইজার: গণতন্ত্র থেকে সামরিক শাসনে প্রত্যাবর্তন২০২৩ সালে জেনারেল আব্দুরাহমান তিয়ানি প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বাজুমকে অপসারণ করে ক্ষমতা নেন। এতে আফ্রিকান দেশগুলোর জোট ইকোয়াসের সঙ্গে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। বাজুমকে ক্ষমতায় না ফেরালে নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপেরও হুমকি দেয় তারা। এ অবস্থায় নাইজার ইকোয়াস থেকে বেরিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে বুরকিনা ফাসো ও মালির মতো দুই সামরিক শাসিত প্রতিবেশীর সঙ্গে জোট গঠন করে।
গ্যাবন: নির্বাচনের পর সেনা হস্তক্ষেপ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আলি বংগো ২০২৩ সালে ফের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এরপর ক্ষমতায় আসেন বংগোরই দুঃসম্পর্কের ভাই ও সেনা কর্মকর্তা ব্রিস ওলিগি নগিমা। গত এপ্রিলের এক নির্বাচনে তাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
মাদাগাস্কার: পানি সংকট, বিদ্যুৎ বিপর্যয় ও তরুণদের ক্ষোভদীর্ঘদিনের পানি স্বল্পতা ও বিদ্যুৎ সমস্যার বিরুদ্ধে জেন জি বিক্ষোভে গত অক্টোবরে উত্তাল হয়ে ওঠে মাদাগাস্কার। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা পদত্যাগ দাবি করেন। তবে তিনি পদত্যাগ করেননি, শুধু সরকার ভেঙে দেন। এরপর সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয় ও রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়ে পালান।
গিনি-বিসাউ: নির্বাচন বিতর্কের পর অভ্যুত্থানগত ২৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে তীব্র বিতর্কের পর সেনারা ক্ষমতা দখল করে। প্রেসিডেন্ট উমারো সিসোকো এমবালোকে আটক করা হলেও পরে সেনেগালে চলে যেতে দেওয়া হয়। বিরোধীদের দাবি, এমবালোর নির্বাচনী পরাজয় এড়াতেই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নতুন সামরিক সরকার এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন পদে এমবালোর মিত্রদের নিয়োগ দিয়েছে।
বেনিন: ব্যর্থ অভ্যুত্থানে উত্তেজনাগত রোববার বেনিনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একদল সেনা সদস্য হঠাৎ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়। তারা একটি অংশ নিজেদের ‘মিলিটারি কমিটি ফর রিফাউন্ডেশন’ নামে পরিচয় দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পাস্কাল তিগ্রিকে দেশের নেতৃত্বে বসানোর ঘোষণা দেয়। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকার জানায়, এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
আফ্রিকাজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধপূর্ণ নির্বাচন, নিরাপত্তাহীনতা ও তরুণদের ক্ষোভ যে এখনো তীব্র, এই ধারাবাহিক সেনা অভ্যুত্থান তারই ইঙ্গিত বলে মনে করছেণ বিশ্লেষকরা। ফলে মহাদেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সূত্র: এপিকেএএ/