দেশজুড়ে

বগুড়া বিমানবন্দর এখন আশ্বাসের প্রকল্প

ঘোষণা হয়েছিল ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বগুড়া থেকে উড়বে যাত্রীবাহী বিমান। উত্তরবঙ্গের মানুষ ভেবেছিলেন এবার হয়তো তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সেই জুলাই পেরিয়ে বছর শেষ হওয়ার পথে। তবে বগুড়ার আকাশে এখনো শোনা যায়নি কোনো যাত্রীবাহী বিমানের শব্দ।

সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি নেই। ফলে প্রশ্ন উঠছে বগুড়া বিমানবন্দর কি আদৌ বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে, নাকি এটি শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

রানওয়ে আছে কিন্তু উপযোগী নয়

বগুড়া বিমানবন্দরে বর্তমানে যে রানওয়ে রয়েছে, তার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট। এটি মূলত প্রশিক্ষণ বিমান ও সীমিত কার্গো চলাচলের জন্য ব্যবহারযোগ্য। নিয়মিত যাত্রীবাহী বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য প্রয়োজন অন্তত ছয় হাজার ফুট রানওয়ে। শুধু দৈর্ঘ্য নয়; রানওয়ের পুরুত্ব, প্রশস্ততা, ব্রেকিং সিস্টেম, লাইটিং ও নেভিগেশন সুবিধার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করাও জরুরি।

বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবকাঠামো নিয়ে কোনো বড় বা মাঝারি যাত্রীবাহী বিমান এখানে নিরাপদে চলাচল করতে পারবে না। এই বাস্তবতায় বগুড়া থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর ঘোষণা এখনো কাগজেই সীমাবদ্ধ।

রানওয়ে ছাড়াও একটি বিমানবন্দর চালু করতে সবচেয়ে জরুরি যে অবকাঠামোগুলো প্রয়োজন, সেগুলোর কোনোটিই এখানে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। নেই আধুনিক যাত্রী টার্মিনাল, কন্ট্রোল টাওয়ার, ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ ইউনিট। লাগেজ স্ক্যানিং, নিরাপত্তা চৌকি, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাও নেই।

স্থানীয় যাত্রীরা বলছেন, যাত্রী ওঠানামার ন্যূনতম পরিবেশ ছাড়া বিমানবন্দর চালুর প্রতিশ্রুতি শুধু মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর নামান্তর। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ থেকেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হচ্ছে না।

প্রকল্প ঝুলে আছে অর্থায়ন আর জমি অধিগ্রহণে

বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটি তিন ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলেও এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে এই অর্থ এখনো চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র না থাকায় প্রকল্পের বড় কোনো কাজই শুরু করা যাচ্ছে না।

সবচেয়ে বড় আরেকটি সংকট হলো জমি অধিগ্রহণ। রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য অতিরিক্ত জমি প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

বগুড়া জেলা প্রশাসনের একজন রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, অনুমোদন না থাকায় তারা আইনগত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ফলে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধাপ অর্থায়ন ও জমি দুটোতেই কার্যত অচলাবস্থা চলছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও কৃষকদের কাছে বগুড়া বিমানবন্দর মানে শুধু যাতায়াত নয়, এটি হতে পারতো উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির গতিপথ বদলে দেওয়ার বড় হাতিয়ার। বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, ‘বিমানবন্দর চালু হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, রপ্তানি সহজ হবে, ব্যবসায়ীরা দ্রুত কাজ শেষ করতে পারবেন।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বগুড়ার আলু, সবজি, আম ও লিচুর বিদেশি বাজার থাকলেও সরাসরি কার্গো ফ্লাইট না থাকায় কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত দাম পান না। বিমানবন্দর চালু হলে ঢাকাকেন্দ্রিক ঝামেলা কমবে। পরিবহন খরচ ও সময় দুটোই কমে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সমাজকর্মী আব্দুল মতিন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিকিৎসা ও উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিদিন বগুড়া থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকায় যাতায়াত করেন। বিমান চলাচল শুরু হলে এই যাত্রা সহজ হতো। পাশাপাশি মহাস্থানগড়সহ বগুড়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানে পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বাড়তে পারতো। স্থানীয় হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন খাতেও এর প্রভাব পড়ার কথা ছিল।’

স্থানীয় উদ্যোক্তা আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি নির্বাচন এলেই বিমানবন্দর চালুর কথা শোনা যায়। নির্বাচন চলে গেলে আর কোনো খোঁজ থাকে না। এটা এখন শুধু রাজনৈতিক আশ্বাসে পরিণত হয়েছে। জুলাইয়ের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও কোনো দৃশ্যমান কাজ না হওয়ায় মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ আরও বাড়ছে।’

আরও পড়ুন: অগ্নিকাণ্ডের দেড় মাস পর শাহজালালে আগুন নেভানোর মহড়াআগুন লাগার ৩০ সেকেন্ডেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বিমানবন্দরের ফায়ার ইউনিট

প্রশ্নের মুখে কর্তৃপক্ষ

১৯৮৭ থেকে ২০২৫ দীর্ঘ ৩৮ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বগুড়া বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। নব্বইয়ের দশকে ২২ কোটি টাকার প্রকল্পে রানওয়ে, টার্মিনাল, আবাসিক ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কথা ছিল ২০০০ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল শুরু হবে। কিন্তু ২০০১ সালে বিমানবন্দরটি বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর হয়। এরপর প্রায় ২৫ বছর ধরে এটি সামরিক প্রশিক্ষণ ও রাডার স্টেশন হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিমানবন্দর নিয়ে সরকারের সবশেষ বড় প্রতিশ্রুতি এসেছিল ২০২২ সালে। তখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, ধাপে ধাপে উন্নয়ন শেষ করে ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যেই বগুড়া থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করা হবে। সেসময় সিভিল এভিয়েশন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেছিলেন, এই বিমানবন্দর চালু হলে উত্তরাঞ্চলের জন্য এটি হবে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।

জেলা প্রশাসন থেকেও একাধিকবার জানানো হয়, রানওয়ে প্রস্তুতিসহ বাকি অবকাঠামোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতির সময় পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

২০২৪ সালের জুনে বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মনজুর কবির ভূঁইয়া সরেজমিনে বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানেও তিনি স্বীকার করেন, বর্তমান রানওয়ে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রথম ধাপে রানওয়ে ছয় হাজার ফুটে উন্নীত করতে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগবে বলে তিনি জানান। পরবর্তী ধাপে এটিকে ১০ হাজার ফুট পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এজন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানান বেবিচক চেয়ারম্যান।

কিন্তু বাস্তবতা হলো দেড় থেকে দুই বছরের যে সময়ের কথা বলা হয়েছিল, তার প্রস্তুতির কোনো দৃশ্যমান কাজ এখনো শুরুই হয়নি।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করে আবারও জানিয়ে দেন, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও প্রাথমিক অবকাঠামো শেষ হতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বগুড়া বিমানবন্দরকে দেশের নবম বিমানবন্দর হিসেবে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার এ বক্তব্যের পরও বাজেট চূড়ান্ত হয়নি, জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়নি, প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজও দৃশ্যমান নয়। ফলে প্রশ্ন উঠছে এই এক বছরের হিসাব শুরু হচ্ছে কবে থেকে?

কর্তৃপক্ষের একাধিক ঘোষণার বিপরীতে বাস্তব অগ্রগতি প্রায় শূন্য। এখনো প্রকল্পের চূড়ান্ত বাজেট অনুমোদিত হয়নি। রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এই দুটি বিষয় ছাড়া বিমানবন্দরকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া কাগজে-কলমেও সম্ভব নয়।

সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, পরিকল্পনা এখনো বাতিল হয়নি। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ধাপে ধাপে কাজ বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বা অগ্রগতির তথ্য তিনি দিতে পারেননি। ফলে ‘কাজ চলমান’ কথাটিও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

এ বিষয়ে বগুড়ার সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে তিনি বগুড়ায় নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বাড়তি জমি অধিগ্রহণের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জেলা প্রশাসনের কাছে আসেনি। প্রস্তাব এলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই আশ্বাস থাকলেও বাস্তবে প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) জেলা সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, ‘এখন প্রশ্ন একটাই—পরিদর্শন আর প্রতিশ্রুতির এই দীর্ঘ তালিকার পরও বগুড়া বিমানবন্দর কি আদৌ কখনো বাণিজ্যিক ফ্লাইটের মুখ দেখবে? নাকি এটি চিরকালই ফাইলে আটকে থাকা একটি প্রকল্প হয়ে থাকবে? বগুড়াবাসী এই গুরুত্বপূণ প্রকল্পের শেষ অবস্থা জানতে চায়।’

এসআর/এমএস