কৃষি ও প্রকৃতি

শীতকালে গবাদিপশুর যত্নে করণীয়

‎শীতকাল গবাদিপশুর জন্য সংবেদনশীল সময়। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। খাদ্য ও পানির চাহিদারও পরিবর্তন ঘটে। পাশাপাশি ঠান্ডাজনিত রোগের ঝুঁকিও বাড়ে। তাই শীত মৌসুমে গবাদিপশুর যথাযথ পরিচর্যা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

‎শীতকালে কীভাবে যত্ন নিলে গবাদিপশু সুস্থ থাকে, উৎপাদনশীলতা বজায় থাকে এবং ঠান্ডাজনিত সমস্যা থেকে সুরক্ষিত থাকে—এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ইন্টার্ন প্রাণী চিকিৎসক মো. রাজিবুল ইসলাম।

গবাদিপশুর সমস্যাসমূহ‎শীতকালে গবাদিপশুর তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, যা হাইপোথার্মিয়া নামে পরিচিত। এতে বাছুরসহ ও অন্যান্য কম বয়সী প্রাণী নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়। ‎এ ছাড়া কিছু ভাইরাল রোগ, যেমন- এলএসডি, এফএমডি এবং বাছুরের বিআরডি রোগের প্রবণতা বেড়ে যায়।

শীতে গবাদিপশুর রক্তনালী সংকুচিত হয়, পানিগ্রহণ ক্ষমতা কমে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। পশুর শরীর গরম রাখার জন্য বেশি এনার্জি দরকার। এজন্য খাদ্যতালিকায় ভুষি, গম, খৈল ও গুড় রাখতে হবে। ‎খাবার স্বাভাবিক মাত্রার থেকে ৫-১০% বৃদ্ধি করতে হবে। পানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। ১০°সেলসিয়াস কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে। ‎ভিটামিন এ, ডি, ই এবং বি কমপ্লেক্স ও মিনারেল খাওয়াতে হবে।

শীতে গোয়ালঘরে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শীতল বাতাস না প্রবেশ করতে পারে। পর্যাপ্ত আলো প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। এ ছাড়া শীতে আরও কিছু রোগ, যেমন- লিভার ফ্লুক ও ফুট রট এসবও বৃদ্ধি পায়। বাছুরের বিশেষ যত্ন হচ্ছে জন্মের পর ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের শালদুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জ্যাকেট বা ভারী কাপড় দিয়ে শরীরকে রক্ষা করতে হবে। দুধ গরম করে পান করাতে হবে। নিয়মিত ভ্যাক্সিনেশন ও ডিওয়ার্মিং করাতে হবে।

দৈনিক গবাদিপশুর জন্য করণীয়> তাপমাত্রা, পালস্ রেট এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার পরিমাপ করতে হবে।> মল-মূত্রের পরিমাণ, গন্ধ এসব চেক করতে হবে।> দুধ উৎপাদন, ম্যাস্টাইটিস এসবের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে। > চোখ, নাক ও মুখের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।> রোগাক্রান্ত গবাদিপশুকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে।> শীতে গর্ভবতী গাভি ও মহিষের যত্ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। > এ সময়ে ঠান্ডা, সংক্রমণ ও পুষ্টিহীনতার কারণে মা ও বাচ্চা—দুজনই ঝুঁকিতে থাকে।

‎নিচে সহজভাবে গুরুত্বপূর্ণ যত্নগুলো দেওয়া হলো:‎উষ্ণ ও আরামদায়ক বাসস্থানক. ‎খড়, শুকনা বিছানা (স্ট্র বেড) ব্যবহার করুন।খ. ‎বাতাস ঢোকে এমন খোলা দিকগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিন।গ. ‎বৃষ্টি ও কুয়াশা যাতে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করুন।ঘ. ‎খুব ঠান্ডায় রাতের সময় অতিরিক্ত বিছানা দিন।

‎সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করাক. ‎গর্ভকালীন পুষ্টির ঘাটতি হলে মৃত বাচ্চা, রিটেইন্ড প্লাসেন্টা, দুর্বল বাচ্চা ইত্যাদি বাড়ে।‎খ. গর্ভের শেষ ২ মাসে ক্যালসিয়াম-ব্যালেন্স বজায় রাখতে ভেটেরিনারি পরামর্শে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট।গ. ‎খাদ্যতালিকায় যা রাখতে হবে> ‎ভালো মানের শুকনা খড়।> ‎সবুজ ঘাস (লুসার্ন, ন্যাপিয়ার)– দিনে ১০-১৫ কেজি।> গম ভাঙা, ভুষি, খৈল– গাভির বয়স ও ওজন অনুযায়ী।> ‎খনিজ ও লবণ।

‎পরিষ্কার পানি ও হালকা গরম পানি> ‎ঠান্ডা পানি খেতে না চাইলে পানির পরিমাণ কমে যায়। এতে দুধ কমে, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, কিটোসিস দেখা দেয়।> ‎তাই দিনে ২-৩ বার হালকা গরম পানি দিন।

আরও পড়ুনআগাম সবজি চাষে সফল জিসান, চলতি মৌসুমেই বিক্রি সাড়ে ৩১ লাখ কৃষির নতুন দিগন্ত সয়েল সেন্সর 

‎দৈনিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ‎প্রতিদিন নিচের বিষয়গুলো লক্ষ্য করবেন—ক. ‎খাওয়ানোর প্রতি অনীহা আছে কি?খ. ‎আচরণ স্বাভাবিক কি না।গ. ‎জ্বর, কাশি, নাক-চোখ দিয়ে পানি পড়া।ঘ. পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া, অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট, খোঁড়া ভাব।ঙ. ‎বাচ্চা নড়াচড়া কম মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।

‎গর্ভধারণের শেষ ২ মাসে বিশেষ যত্ন> ‎ভারী কাজ নিষেধ– টানাটানি, বেশি হাঁটানো, দৌড়ানো নয়।> পেটের ওপর চাপ পড়ে এমন স্লিপারি মেঝে এড়িয়ে চলুন।> ‎হঠাৎ খাদ্য পরিবর্তন করবেন না।> শেষ পর্যায়ে (৮ম-৯ম মাস) যোনির ফোলা, দুধ ঝরা, পেট নেমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করুন।

‎টিকা ও ডিওয়ার্মিং‎শীতের আগেই এফএমডি, বিএসই, ব্ল্যাক কোয়ার্টার, এইচএস, পরজীবী নিয়ন্ত্রণ (ডিওয়ার্মিং), ভেটেরিনারি নির্দেশ অনুযায়ী দিন।

‎প্রসবের আগে প্রস্তুতি> ‎আলাদা পরিষ্কার ক্যালভিং পেন তৈরি রাখুন।> ‎বিছানা শুকনা ও উষ্ণ রাখুন।> ‎প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের এক সপ্তাহ আগে থেকে বাড়তি নজরদারি শুরু করুন।

‎ঠান্ডাজনিত রোগ প্রতিরোধ‎শীতে সাধারণত যে রোগগুলো বাড়ে, যেমন- ‎নিউমোনিয়া, ‎মাস্টাইটিস, ‎এফএমডি। ‎প্রয়োজন হলে স্টিম ইনহেলেশন ব্যবস্থা বা শেডে আর্দ্রতা কমানোর ব্যবস্থা করুন।

‎সর্বশেষ কথা হচ্ছে, কোনো রোগ হলে তিন মাসের ট্রেনিং প্রাপ্ত এআই কর্মী বা কোয়াকদের না দেখিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের অফিসারের পরামর্শ ও চিকিৎসা নেন। এতে আপনার খরচও কমবে এবং প্রাণীও সুস্থ থাকবে। এ ছাড়া হাতুড়ে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষক ও খামারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

‎শীতে গবাদিপশুর পরিচর্যা মানেই তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একটু সচেতনতা ও যত্নই পারে শীতকালজুড়ে পশুগুলোকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে।

‎এসইউ