ভ্রমণ

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদারবাড়ি

মানিকগঞ্জের ঐতিহাসিক তেওতা জমিদারবাড়ি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একসময় জেলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই প্রাসাদ এখন নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে অবহেলা, অযত্ন আর প্রাকৃতিক ক্ষয়ের চাপে।

জানা যায়, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা এলাকায় জমিদারবাড়িটি অবস্থিত। সতেরো শতকে জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণ করেছিলেন পঞ্চানন সেন নামক একজন জমিদার।

জনশ্রুতি অনুসারে, পঞ্চানন সেন একসময় খুবই দরিদ্র ছিলেন। দিনাজপুর অঞ্চলে তিনি তামাক উৎপাদন করে প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়ার পর প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। পরে এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন জয়শংকর ও হেমশংকর নামের দুই ব্যক্তি। ভারত বিভক্তির পর তারা ভারত চলে গেলে বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

তেওতা জমিদারবাড়িটি মোট ৭.৩৮ একর জমি নিয়ে স্থাপিত। মূল প্রাসাদের চারপাশে আছে বিভিন্ন স্থাপনা ও একটি বড় পুকুর। প্রাসাদের মূল ভবনটি লালদিঘি ভবন নামে পরিচিত। এখানে একটি নটমন্দির আছে। এ ছাড়াও আছে নবরত্ন মঠ ও বেশ কয়েকটি মঠ। সবগুলো ভবন মিলিয়ে এখানে মোট কক্ষ আছে ৫৫টি।

সরেজমিনে জানা যায়, তেওতা জমিদারবাড়িতে প্রবেশ করতে প্রথমেই চোখে পড়ে কাচারি ঘর। এখানে জমিদাররা ব্যবসার হিসাব করতেন। এ ছাড়া যদি কেউ দেখা করতে আসতেন; তখন জমিদাররা তাদের সাথে দেখা করতেন। ঘরটি এখন জরাজীর্ণ ভবনে পরিণত হয়েছে। ওপরের চালা খুলে পড়ছে।

বিপরীত পাশেই আছে নবরত্ন মন্দির (মঠ)। সুন্দর কারুকার্য আর নয়টি গম্বুজের কারণে এটি নবরত্ন মঠ হিসেবে পরিচিত। মূলত এটি মন্দির। এখানে পূজা করা হতো। মন্দিরটির ওপরে যে গম্বুজ আছে, তাতে একটি করে রত্ন ছিল বলে এর নাম নবরত্ন মন্দির দেওয়া হয়। মন্দিরটি আছে ঠিক কিন্তু এর ওপরে যে নয়টি রত্ন ছিল; সেগুলো এখন আর নেই।

তার পাশে আছে উত্তরীসর ভবন। সদ্য ভবনটির সংস্কার কাজ শেষ করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। মূল যে ভবনটি আছে; সেটি সবচেয়ে বেশি অবহেলায় পড়ে আছে। ইটগুলো খুলে খুলে পড়ছে। কারুকার্য প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালে তৈরি হয়েছে বড় বড় ক্ষত। দোতলা ভবনটির সিঁড়িগুলো ভেঙে গেছে। ছাদের ঢালাই খুলে পড়ছে। এখন মাদক সেবীদের নিরাপদ আশ্রয়। মূল ভবনের পাশের ভবনগুলো যে কোনো সময় মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।

আরও পড়ুনমসজিদের নান্দনিক নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের বিলুপ্তির পথে দেড়শ বছরের বাজপাই জমিদারবাড়ি 

তেওতা এলাকার মো. জয়নাল মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘এখানে জমিদার আমলে রথের মেলা হতো। এখনো মেলাটা হয়। ওই আমলের মতো জমজমাট না। নবরত্ন মন্দিরের নয়টি মাথায়ই নয়টি রত্ন ছিল। রত্নগুলো যুদ্ধের সময় মানুষ নিয়ে গেছে। একটা রত্ন ছিল। হঠাৎ করে একদিন ওই রত্নও নাই হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘কাচারি ঘরটাতে বেশিরভাগ হিসাব হতো। বাহির থেকে যে খাজনা আদায় হতো, ঘরটিতে হিসাব-নিকাশ শেষ করে ভেতরে যেতো। বাহির থেকে কোনো লোকজন এলে জমিদাররা এই কাচারি ঘরে দেখা করতেন। তারপর বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতেন। তাও চোখ বেঁধে নেওয়া হতো। যাতে কেউ বুঝতে না পারেন বা জমিদারবাড়ির নকশা না দেখতে পারেন।’

আরিচা এলাকার নাহিদ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তেওতা জমিদারবাড়ি আমাদের অনেক পুরাতন একটি ঐতিহ্য। আমাদের জমিদারবাড়িটি খুবই অবহেলিত। সরকার বাড়িটির সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয় না। আমি সরকারের কাছে আশাবাদী, জমিদারবাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ নেবে এবং দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করবে।’

ষাটঘর তেওতা গ্রামের মো. ফারুক শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘তেওতা জমিদারবাড়িতে কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রীর অনেক স্মৃতি আছে। দেশের অনেক জায়গায় জমিদারবাড়ি আছে; সেগুলো সংস্কার হয়েছে। এই জমিদারবাড়িটিতে কোনো কাজ করা হয়নি। সরকার চাইলে এটা ঠিক করতে পারে। কিছুদিন আগে কাজ ধরেছিলেন, তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে একটি কলেজ হওয়ার কথা ছিল। সেটাও হয় নাই।’

মো. আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন তেওতা জমিদারবাড়ি। সরকারের অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সঠিক পরিকল্পনা করে সংস্কার করে, এখানে একটি দর্শনীয় জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ছাড়া জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত স্থান এটি। এখানে নজরুল গবেষণা কেন্দ্র কিংবা নজরুল ইসলামের স্মরণে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা যেতে পারে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গত অর্থবছরে কিছু কাজ করিয়েছি। এবার আমরা বাউন্ডারি ওয়ালটা দিতে চাচ্ছি। পুরোটা পারবো না। অর্ধেক অংশের প্রস্তাবটা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। একটি প্রাচীর হলে নিরাপত্তাটা সুসংহত করা যাবে। তখন কয়েক বছরের ভেতরে কাজগুলো সুন্দর করে করার পর একটা প্রদর্শনী করা যেতে পারে। এটা আমাদের পরিকল্পনায় আছে।’

এসইউ