বিনোদন

সমাজকে প্রশ্ন করা সিনেমার স্রষ্টা শ্যাম বেনেগাল

বলিউড চলচ্চিত্র মানেই একসময় ছিল গান, নাচ, রোমান্স আর তারকাখচিত রঙিন ক্যানভাস। সেই প্রবাহের মাঝেই একদল নির্মাতা উঠে এসেছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন- সিনেমা কেবল বিনোদন নয়। এটি সমাজকে প্রশ্ন করার, মানুষের ভেতরের সত্যকে তুলে ধরার শক্তিশালী মাধ্যমও।

এই সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলনের অগ্রদূতদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম শ্যাম বেনেগাল। আজ (১৪ ডিসেম্বর) তার জন্মদিন। এই দিনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, কীভাবে তিনি নীরব অথচ দৃঢ় ভাষায় ভারতীয় সিনেমাকে ভিন্ন পথ দেখিয়েছেন।

১৯৩৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দরাবাদে জন্ম শ্যাম বেনেগালের। শিল্প-সংস্কৃতির আবহেই তার বেড়ে ওঠা। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার গুরু দত্তের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ তার সিনেমাবোধ গড়ে উঠতে সহায়তা করে। তবে সরাসরি সিনেমা দিয়ে নয়, বিজ্ঞাপন নির্মাণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল তার কর্মজীবন। বিজ্ঞাপনের ছোট পরিসরে গল্প বলার দক্ষতা, ফ্রেমের সংযম আর ভিজ্যুয়াল ইঙ্গিতের ভাষা- এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তী সময়ে তার সিনেমায় গভীর প্রভাব ফেলে।

১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অঙ্কুর’ দিয়েই শ্যাম বেনেগাল বলিউডের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার দম্ভ, শোষণ আর মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এ ছবির মূল বিষয়। কোনো অতিনাটকীয়তা ছাড়াই নির্মোহ বাস্তবতায় গল্প বলাই ছিল তার শক্তি। এই সিনেমার মাধ্যমেই দর্শক নতুন করে চিনে নেয় শাবানা আজমিকে- যিনি পরবর্তীতে বেনেগালের বহু ছবির মুখ হয়ে ওঠেন।

এরপর ধারাবাহিকভাবে নির্মিত ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’, ‘জুনুন’, ‘কলযুগ’, ‘সুরজ কা সাতওয়াঁ ঘোড়া’- প্রতিটি ছবিই ভারতীয় সমাজের ভিন্ন ভিন্ন স্তরকে উন্মোচিত করেছে। ‘মন্থন’ ছিল ভারতের প্রথম ক্রাউড-ফান্ডেড সিনেমা। সেটি সামাজিক আন্দোলন ও সিনেমার সংযোগ ঘটায়। বাংলােদেশে তিনি ‌‘মুজিব’ সিনেমা বানিয়ে আলোচিত হয়েছেন দীর্ঘ বিরতির পর।

শ্যাম বেনেগালের সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল চরিত্রের গভীরতা। তার ছবিতে নায়ক-নায়িকার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেত পরিস্থিতি ও সামাজিক কাঠামো। তিনি কখনো সরাসরি উপদেশ দেননি, বরং প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন দর্শকের দিকে। শ্রেণিবৈষম্য, নারীস্বাধীনতা, ক্ষমতার রাজনীতি, নৈতিক সংকট- সবই এসেছে নিঃশব্দ অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

বড়পর্দার পাশাপাশি টেলিভিশনেও তার অবদান সমান গুরুত্বপূর্ণ। ‘ভারত এক খোঁজ’ ধারাবাহিকে ভারতের ইতিহাসকে তিনি সাধারণ দর্শকের কাছে সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেন। একইভাবে ‘সংবিধান’ সিরিজের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলেন। এই কাজগুলো প্রমাণ করে, টেলিভিশনও যে মননশীল ও গবেষণাভিত্তিক হতে পারে, তা শ্যাম বেনেগালই দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন:হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন নচিকেতাবাস কন্ডাক্টর থেকে যেভাবে সিনেমার মহাতারকা হলেন রজনীকান্ত

শ্যাম বেনেগাল ছিলেন এক অনন্য অভিনেতা-গড়ার কারিগর। নাসিরউদ্দিন শাহ, ওম পুরী, স্মিতা পাটিল, অমল পালেকর, শাবানা আজমি- এই শক্তিমান অভিনয়শিল্পীরা শ্যাম বেনেগালের হাত ধরেই পেয়েছেন নিজেদের প্রকৃত পরিচয়। তার সেটে অভিনয় মানেই ছিল চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়ার সুযোগ, নিজের অভিনয়ক্ষমতাকে নতুন করে আবিষ্কার করা।

আজকের দ্রুতগতির, বাণিজ্যনির্ভর বিনোদন জগতে দাঁড়িয়ে শ্যাম বেনেগালের সিনেমা যেন এক শান্ত প্রতিবাদ। তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন, সিনেমা সমাজের আয়না- যেখানে মানুষ নিজেকে দেখতে পায়। কোনো চমক বা উচ্চকণ্ঠ ছাড়াই তিনি সেই আয়নাটি দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন।

৯০ বছর বয়সে ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন শ্যাম বেনেগাল। তিনি রেখেছেন তার অসংখ্য কাজ ও গুণগ্রাহী।

এমএমএফ/এলআইএ/জেআইএম