ফিচার

১৪ ডিসেম্বর সকাল, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিথর দেহ পাওয়া গেলো

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের সকালটি ছিল অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া। ঢাকার আকাশে তখনো যুদ্ধের গন্ধ, বারুদের ধোঁয়া আর আতঙ্কের ভার। বিজয় আর মাত্র দু’দিন দূরে এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু সেই সকালে কেউ জানত না, দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাতটি আসতে চলেছে বাঙালি জাতির মেধা ও মননের ওপর। শহরের রাস্তাঘাট ছিল তুলনামূলক ফাঁকা, মানুষের চোখেমুখে চাপা উৎকণ্ঠা। ভোর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে গুজব ছড়াতে থাকে গত রাতে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে আলবদর বাহিনী।

১৩ ডিসেম্বর রাত থেকেই শুরু হয়েছিল পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর বাহিনী তালিকা ধরে ধরে দেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষকদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। চোখ বেঁধে, হাত পিছমোড়া করে ট্রাকে তুলে নেওয়া হয় তাদের। পরিবারের সদস্যদের সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই দৃশ্য আজও অনেকের স্মৃতিতে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। কেউ জানত না, প্রিয় মানুষটিকে আর কখনো ঘরে ফিরবে না।

১৪ ডিসেম্বর দুপুর গড়াতেই ঢাকার বাইরে রায়েরবাজার, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অস্বাভাবিক নড়াচড়া লক্ষ করা যায়। স্থানীয় মানুষজন প্রথমে ভয়ে কাছে যেতে সাহস পাননি। পরে কিছু সাহসী মানুষ এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান ইটভাটার ধারে, পরিত্যক্ত মাঠে পড়ে আছে সারি সারি নিথর দেহ। চোখ বাঁধা, হাত পেছনে বাঁধা, শরীরজুড়ে নির্যাতনের চিহ্ন। অনেকের মাথায় গুলির ক্ষত, কারো শরীরে বেয়নেটের আঘাত। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় বুদ্ধিজীবীদের গণকবর।

খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরে। স্বজনহারা পরিবারগুলো ছুটে যায় রায়েরবাজারে। কান্না, আর্তনাদ আর নিঃশব্দ শোক মিলে জায়গাটি যেন পরিণত হয় এক জীবন্ত মৃত্যু উপাখ্যানে। পরিচয়ের জন্য অনেকেই পোশাক, জুতা, চশমা কিংবা আঙুলের আংটি দেখে প্রিয়জনকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। কারো ক্ষেত্রে সেটুকুও সম্ভব হয়নি।

এমনই এক পরিবারের গল্প অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে ১৪ ডিসেম্বর ভোররাতে তার আজিমপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। তার স্ত্রী লিলি চৌধুরী সেদিন অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন স্বামীর চলে যাওয়ার দিকে। তিনি পরে লিখেছিলেন, শেষবার মুনীর চৌধুরী শুধু বলেছিলেন ‘ভয় পেয়ো না।’ কয়েকদিন পর রায়েরবাজারে পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত দেহ। স্বাধীনতা দেখার আগেই নিভে যায় একজন আলোকিত মানুষের জীবন।

চিকিৎসক আলিম চৌধুরীর পরিবারও একই ট্র্যাজেডির সাক্ষী। দেশের খ্যাতিমান এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে ১৪ ডিসেম্বর সকালে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী ও সন্তানরা বহু দিন আশায় ছিলেন হয়তো ফিরে আসবেন। কিন্তু রায়েরবাজারের গণকবর সেই আশার অবসান ঘটায়। স্বাধীন বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা যে একজন পথপ্রদর্শককে হারাল, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়।

দেশের আরেক সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তার বাসা ২৯, বিকে গাঙ্গুলী লেন থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফেরেন নি। ধারণা করা হয় যে, অপহরণকারীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে খুঁজতে গিয়ে চিরদিনের মত হারিয়ে যান আরেক নক্ষত্র জহির রায়হান। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার।

বাংলাপিডিয়া অনুসারে, ১৯৭১ সালে প্রায় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, যার মধ্যে শিক্ষাবিদ ৯৯১, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২, অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড ছিল নিছক প্রতিশোধ নয়, ছিল সুপরিকল্পিত জাতিঘাতী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জানত, যুদ্ধ জিতলেও বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তার বুদ্ধিজীবীদের হাত ধরেই। তাই বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে মস্তিষ্কটাকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়।

১৪ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি তারিখ নয়। এটি শোক ক্ষতি আর আত্মত্যাগের প্রতীক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল্য শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, ঘরের ভেতরেও দিতে হয়েছে। রায়েরবাজারের নীরব ইটভাটা আজও সাক্ষ্য দেয়, কীভাবে একটি জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্ত দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে নিয়েছে। এই স্মৃতি আমাদের কাঁদায়, আবার শক্তও করে। কারণ বুদ্ধিজীবীদের সেই আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই আজকের বাংলাদেশ।

আরও পড়ুনমহাবিশ্বের কোথায় প্রথম সূর্যোদয় হয় জানেন?নারী জাগরণের অগ্নিশিখা বেগম রোকেয়া

কেএসকে/জেআইএম