নারী জাগরণের অগ্নিশিখা বেগম রোকেয়া
স্নেহা মির্জা
এমন এক সময় ছিল, যখন বাংলার মুসলিম নারীরা ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বন্দি। ঘর-সংসারই ছিল তাদের একমাত্র পরিচয়, আর বাংলা বা ইংরেজি শিক্ষা ছিল যেন ‘নিষিদ্ধ পাপ’। ঠিক সেই অন্ধকার সময়েই উদিত হন এক আলোর দ্যুতি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত, মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই নারী ছোটবেলা থেকেই সমাজের রক্ষণশীলতা ও নারীর প্রতি অবিচারের বাস্তবতা দেখেছেন। পর্দার আড়ালে বেড়ে ওঠা রোকেয়ার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছিল সামান্য। কিন্তু বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও বোন করিমুন্নেসার গোপন সহায়তায় রাত জেগে বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি শেখা এই ছোট ছোট প্রচেষ্টাই পরবর্তী জীবনে গড়ে দেয় তার অসীম জ্ঞানপিপাসা এবং নারীর মুক্তি-বিশ্বাসের ভিত।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় শিক্ষানুরাগী ও উদারচিন্তার অধিকারী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। স্বামীর উৎসাহ ও সমর্থন রোকেয়ার ভাবনা ও লেখনীকে করে আরও দৃঢ়। এখান থেকেই শুরু নারীশিক্ষা ও নারী-অধিকার আন্দোলনে তার বিপ্লবী পথচলা।
রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন নারী শিক্ষার আলো ছাড়া কোনো জাতি এগোতে পারে না। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি প্রথমে ভগলপুরে এবং পরে ১৯১১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। মাত্র কয়েকজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও তা পরিণত হয় নারীশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে। দরিদ্র ও সাধারণ মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে; অপমান, ধিক্কার এমনকি প্রতিবন্ধকতাও তাকে দমাতে পারেনি।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ছিল সমাজ বদলের হাতিয়ার। সুলতানার স্বপ্ন-এ তিনি হাজির করেন এক নারীমুক্তির স্বপ্নরাজ্য যেখানে নারীরা সমাজ-রাষ্ট্র চালায়, আর পুরুষেরা থাকে গৃহবন্দি। অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগসহ তার সব রচনাতেই উঠে আসে নারীশিক্ষা, সমানাধিকার, কুসংস্কার দূরীকরণ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জোরালো দাবি।
ব্রাহ্মসমাজ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি লড়েছেন নারীর সম্পত্তির অধিকার, আইনি অধিকার ও সামাজিক সম্মানের প্রশ্নে। তার চোখে নারী কোনো ভোগের বস্তু নয় বরং সমাজের একজন পূর্ণ মানবসত্তা। তিনি লিখেছিলেন, “শিক্ষা লাভ করা সব নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা অমান্য করেছে।”
তার সংগ্রামের ফলেই আজকের নারী ঘর থেকে বের হয়েছে, কলম ধরেছে, বিশ্বজয় করছে। তার অবদানের স্বীকৃতিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘বেগম রোকেয়া দিবস’। বাংলাদেশ সরকার প্রদান করে ‘বেগম রোকেয়া পদক’। বিবিসির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি স্থান পান ষষ্ঠে। তার নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ‘রোকেয়া হল’।
আজো যখন নারীর অগ্রযাত্রায় নানা বাধা-বিপত্তি, তখন বেগম রোকেয়া আমাদের মনে করিয়ে দেন জ্ঞানই মুক্তির চাবিকাঠি, সমান অধিকারই মানবতার ভিত্তি। তার জীবন, চিন্তা ও সংগ্রাম তাই শুধু নারী উন্নয়নের নয় সমগ্র সমাজ জাগরণের চিরন্তন প্রেরণা। নারীর অধিকার, মর্যাদা ও শিক্ষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। তাই বেগম রোকেয়া শুধু এক নাম নয় এক ইতিহাস, এক আলোর পথ।
আরও পড়ুন
পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস
অনেকেই ভূমিকম্প টের পান না, কিন্তু কেন?
লেখক: শিক্ষার্থী, সহযোগী সদস্য রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার ইউনিটি, রাজশাহী কলেজ।
কেএসকে/জেআইএম