অর্থনীতি

৫০০ টাকার ব্যবসা নিয়ে পৌঁছেছেন ৫০ লাখে, হয়েছেন ক্যানসারজয়ী

‘ব্যবসা শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায় ক্যানসারে আক্রান্ত হই। কেমোথেরাপি দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা চালিয়ে যাই। চিকিৎসক বলেছিলেন পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে। কিন্তু বিছানায় পড়ে না থেকে ফেসবুক পেজ চালানোর কাজসহ ঢাকায় এসে ট্রেনিং নিয়েছি, মেলায় অংশ নিয়েছি। একটি লক্ষ্য ছিল, আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ছেলের জন্য কিছু করতে হবে। মাত্র ৫০০ টাকায় যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, সেই ব্যবসা প্রায় ৫০ লাখ টাকায় পৌঁছেছে।’

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে আয়োজিত এসএমই মেলায় কথাগুলো বলছিলেন ক্যানসারজয়ী সফল নারী উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা তানিয়া। এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ মেলা চলে রোববার (১৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত। এতে টাঙ্গাইলের উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা তার ‘তনয় ক্রিয়েশন’ নিয়ে অংশ নেন। প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুক পেজ ও শোরুমের মাধ্যমে জামদানি ও টাঙ্গাইলের শাড়ি এবং বাটিক থ্রি-পিস বিক্রি করে।

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে কানিজ ফাতেমার কঠিন পথচলার গল্প। জানা যায়, তার ছেলের বয়স যখন আট মাস, তখন স্বামীকে হারান তিনি। এতে করে পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ক্যানসারকে তুড়ি মেরে হারিয়েছেন। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তাও। এখন হয়ে উঠছেন অনুপ্রেরণার নাম।

করোনায় ব্যবসা শুরুকানিজ ফাতেমা জানান, তিনি ২০২০ সালে ব্যবসা শুরু করেন। করোনা মহামারির মধ্যে যখন সব অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়, মানুষজন ঘরে বসে যায়, তখন তিনিও গৃহবন্দি থেকে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। সবার মতো হতাশ হয়ে পড়েন যে জীবন কীভাবে যাবে। তার ছেলে তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। এসময় মা-ছেলে পরিকল্পনা করে অনলাইনে তাদের তনয় ক্রিয়েশনের পেজ চালু করেন।

চিকিৎসার একপর্যায়ে শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে আমি একদম বিছানায় পড়ে যাই। কিন্তু বিছনায় শুয়ে শুয়েও থেমে থাকিনি। ছেলেকে দিয়ে ব্যবসার টুকটাক কাজ করাতাম। পেজের কাজ ধারাবাহিক রাখতে পরামর্শ দিতাম। ২০২২ সালে শরীরটা মোটামুটি ভালো হয়ে আসে। তখন আরও অনেক বেশি কাজ করতে থাকি। এসময় অনলাইনে বুস্ট ও লাইভ নিজেই করতাম। ২০২৩ সালে এসে যখন দেখি ব্যবসাটি মোটামুটি ভালো হচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিই যে টাঙ্গাইলে একটি শোরুম করবো।

অনলাইনে পেজ খোলার পর আমাদের টাঙ্গাইলের তাঁতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের বলি, আমাকে নিজস্ব ডিজাইনে কাপড় তৈরি করে দেবেন। প্রথমে মাত্র ৫০০ টাকার একটি ড্রেস আমার পেজে পোস্ট করি। আত্মীয়স্বজনকে পেজটি ফলো করার জন্য বলি ও অনেকে ফলো করে শেয়ার দেয়। এভাবে ২০২০ সালে ব্যবসাটি একটু একটু করে চলতে শুরু করে।

ক্যানসারের হানা২০২১ সালে কানিজ ফাতেমার ক্যানসার ধরা পড়ে। ক্যানসারটি দ্বিতীয় স্তরে ধরা পড়ার পর তৃতীয় স্তরে চলে যায়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যবসায় সময় দিতে থাকেন। তখন পর্যন্ত এটি মূলত অনলাইন ও বিভিন্ন মেলার ওপর নির্ভর করে চলছিল। তিনি কেমোথেরাপি দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকায় এসএমই ও বিসিকে প্রশিক্ষণ নেন। মতিঝিলে বিসিকের মেলাগুলোতেও অংশগ্রহণ করেন। ওই বছর চিকিৎসা ও ব্যবসা- দুটি একসঙ্গেই চলতে থাকে।

এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘চিকিৎসার একপর্যায়ে শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে আমি একদম বিছানায় পড়ে যাই। কিন্তু বিছানায় শুয়ে শুয়েও থেমে থাকিনি। ছেলেকে দিয়ে ব্যবসার টুকটাক কাজ করাতাম। পেজের কাজ ধারাবাহিক রাখতে পরামর্শ দিতাম। ২০২২ সালে শরীরটা মোটামুটি ভালো হয়ে আসে। তখন আরও অনেক বেশি কাজ করতে থাকি। এসময় অনলাইনে বুস্ট ও লাইভ নিজেই করতাম। ২০২৩ সালে এসে যখন দেখি ব্যবসাটা মোটামুটি ভালো হচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিই যে টাঙ্গাইলে একটি শোরুম করবো। এরই মধ্যে সারাদেশে পাইকারি ও খুচরা সেল দিতে থাকি। এভাবে চলতে চলতে ছেলেকে নিয়ে শোরুমটি দাঁড় করাই। এটি শহরের ভেতরেই। সেখানে ভালোই ব্যবসা চলছে।’

আরও পড়ুনমাত্র ২ বছরেই চামড়া শিল্পে বাজিমাত উদ্যোক্তা তাহমিনারখুলনা বিসিক: দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না থাকায় হতাশ উদ্যোক্তারাব্যাংক ঋণ পেতে নারী উদ্যোক্তারা এখনো অবহেলিতকষ্টের সেই দিনগুলোকানিজ ফাতেমা জানান, শুরুতে পণ্য উপস্থাপনে অনলাইনে শুধু তিনিই কাজ করতেন। পাশাপাশি কেমোথেরাপি দিতে ঢাকায় আসতেন। সকাল ৬টার ট্রেনে এসে রাতের ট্রেনে ফিরে যেতেন। এভাবে মতিঝিল এসে মেলায়ও অংশ নিতেন। তা করেই তিনি ছেলেকে নিয়ে ব্যবসাটি চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘কেমো দিতে যখন ঢাকায় আসতাম তখন কষ্ট হতো। অনেক কষ্ট হয়েছে। তারপরও একটিই লক্ষ্য ছিল- আমাকে বাঁচতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, ছেলেটার জন্য কিছু একটা করতে হবে।’

চিকিৎসক পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বললেও ব্যবসা চালিয়ে গেছেন জানিয়ে কানিজ ফাতিমা বলেন, ‘তখন সবাই বলেছে, তুমি এই অবস্থায় কেন এগুলা করছো? তোমার তো এখন রেস্ট নিতে হবে। আমার ডাক্তারও বলছে- তুমি যা করছো এটা তোমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কেমো দেওয়ার সময় ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে। কিন্তু আমার মনে আল্লাহ একটা শক্তি দিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে আমি ব্যবসাটি চালিয়ে যেতে পেরেছি।’

সাধারণত ক্যানসার হলে মানুষ মৃত্যুভয়ে থাকেন ও একদম ভেঙে পড়েন। ঠিক সে সময়েও কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে গেলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে সফল এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘তখন আমার একটাই কথা মনে হয়েছে, আমাকে ফাইট করতে হবে। আমাকে বাঁচতে হবে। ছেলের জন্য হলেও বাঁচতে হবে। যখন চার নম্বর কেমো চলে, আমার ব্ল্যাড ইনফেকশন হয়ে যায়। প্লাটিলেট নেমে আসে ২০০-তে। তখন ডাক্তার জানিয়ে দেয় আমার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এতে গ্রামে কান্নার রোল পড়ে যায়। বাবা-মা ভেঙে পড়েন। আমাকে সাদা কাপড় দিয়েও ঢেকে দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস ছিল আমি বাঁচবো। আল্লাহর কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাই। পরদিনই আড়াই লাখ প্লাটিলেট হয়ে যায়। শুকরিয়া, তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন আমি ভলো আছি। ডাক্তাররা দেখেও বলেছেন, আপনার ইচ্ছা শক্তির কারণেই আপনি বেঁচে আছেন।’

আমি একদম শূন্য থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত এসেছি কারও সহযোগিতা ছাড়াই। মেয়ে হিসেবে আরেকজন মেয়েকে বলতে চাই, কারও ওপর নির্ভর না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেই স্বাবলম্বী হতে হবে। অন্যকে কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিতে হবে।

কানিজ ফাতেমা জানান, তিনি এখন সুস্থ। কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশে দেড় বছর চিকিৎসা করানোর পর ভারতের সিএমসিতে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে তিনি কেমো রেডিওথেরাপি নেন। চিকিৎসকদের অনুপ্রেরণা ও নিজের ইচ্ছাশক্তি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ব্যবসার বর্তমান অবস্থা এ উদ্যোক্তা জানান, এখন তার শোরুমে প্রায়ই ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার পণ্য থাকে। প্রতি মাসে তিন লাখ টাকার ওপর বেচাকেনা হয়। এতে ২৫ শতাংশের মতো লাভ হয়। তার শোরুমে দুজন কাজ করেন। পোশাক উৎপাদনে তার নিজস্ব মেশিন নেই। তিনি তাঁতিদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেন।

আরও পড়ুনবাজারের অনিশ্চয়তায় থমকে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিগর্তে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ, মাঠে নামতে অনাগ্রহী চাষিরাপেঁয়াজ সংরক্ষণে এয়ার ফ্লো মেশিন, বাজিমাত কৃষি বিভাগেরভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকানিজ ফাতিমা বলেন, ‘টাঙ্গাইলে একটি লেদার ফ্যাক্টরি করবো। সেজন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। টাঙ্গাইলে যেহেতু লেদারের ফ্যাক্টরি নেই, চিন্তাভাবনা আছে সেখানে অরিজিনাল লেদারের একটি ফ্যাক্টরি করার। জামদানির পাশাপাশি এটি করবো। সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আমার প্রত্যাশা। এখন বিভিন্ন জায়গায় যে মেলাগুলো হচ্ছে, প্রায় সবগুলোতে অংশ নিচ্ছি। আমার প্রোডাক্টের কোয়ালিটি দেখে সবাই অনেক প্রশংসা করছেন।’

যে পরামর্শ দিলেনএই সফল নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমি একদম শূন্য থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত এসেছি কারও সহযোগিতা ছাড়াই। মেয়ে হিসেবে আরেকজন মেয়েকে বলতে চাই, কারও ওপর নির্ভর না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেই স্বাবলম্বী হতে হবে। অন্যকে কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিতে হবে।’

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তার বার্তা- শেখার কোনো শেষ নেই। প্রচুর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ব্যবসা সম্পর্কে জানতে হবে। তিনি এখনো প্রশিক্ষণ নিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসা করতে হলে সেই খাত সম্পর্কে জানতে হবে। প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।

ইএইচটি/একিউএফ