বাজারের অনিশ্চয়তায় থমকে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতি
কৃষিনির্ভর জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তঘেঁষা একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অঞ্চল। ‘আমের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এ জেলায় আমচাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বৃহৎ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। তবে এরপরও সামগ্রিক অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি আসেনি। জেলায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, রপ্তানিমুখী ব্যবসা বিস্তার, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ গড়ে তোলার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ ও সংকট। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সার্বিক শিল্প সম্ভাবনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি-অর্থনীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ, সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ।
জাগো নিউজ: জাগো নিউজের পক্ষ থেকে শীতের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন?
আব্দুল ওয়াহেদ: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পক্ষ থেকে জাগো নিউজের সাংবাদিকবৃন্দ, আমাদের পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সকল কলাকুশলীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তাদের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও উৎসাহই আমাদের কাজের মূল শক্তি। এ ধরনের সমর্থন আমাদের আরও উদ্যমী করে তোলে, জনসেবা ও সৃজনশীলতায় আরও ভালো করতে পারি।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের দায়িত্বে অনেকদিন ধরে আপনি আছেন। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি চেম্বারের এই দায়িত্ব কেমন উপভোগ করছেন?
আব্দুল ওয়াহেদ: আমি মনে করি, চেম্বারের দায়িত্ব নেওয়া মানে শুধু চেয়ারে বসে থাকা নয়। আমাদের অবশ্যই ব্যবসায়ীদের দুঃখ-দুর্দশা এবং ভালো-মন্দ সব খবর জানা ও সেই অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সবমিলিয়ে, আমার দায়িত্ব উপভোগ করছি এবং আশা করছি আরও সমৃদ্ধ ও সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারব।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজের ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে?
আব্দুল ওয়াহেদ: আমার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে নানা ধরনের সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। সেই সময় থেকে ব্যবসার পরিকল্পনা ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নানা ঝামেলা, বাজারের অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রতিদিন। তবুও হাল ছাড়ছি না। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ব্যবসাকে সচল রাখতে এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে।
আরও পড়ুন-
‘উদ্যোক্তাদের বৈষম্যহীন ঋণ দিলে জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়বে’
‘উদ্যোক্তাদের বৈষম্যহীন ঋণ দিলে জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়বে’
জাগো নিউজ: জেলার বর্তমান উৎপাদনমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ কেমন?
আব্দুল ওয়াহেদ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে বিশাল এই উৎপাদনের পরও চাষি ও ব্যবসায়ীরা প্রাপ্য দাম পাচ্ছেন না। ফলে তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এই পরিস্থিতির প্রভাব সরাসরি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও পড়ছে।

সঙ্গে একটি বড় চ্যালেঞ্জ সোনামসজিদ স্থলবন্দর। ভারতে রপ্তানি বন্ধ থাকায় ব্যবসায় সংকট তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিকে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
গত দুই-তিন বছর ধরে জেলায় অর্থনীতি ধাক্কা খাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতি মূলত আমের ওপর নির্ভর করে। তাই আমের বাজারে দামের অনিশ্চয়তা এবং রপ্তানি সীমাবদ্ধতা সরাসরি প্রভাব ফেলছে পুরো অর্থনীতিতে।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে কৃষিভিত্তিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। এই খাতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
আব্দুল ওয়াহেদ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য অনেক বড় সম্ভাবনা নিয়েই এগোচ্ছে। আম, খাদ্যপণ্য, পাটজাত পণ্যসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্যকে কেন্দ্র করে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তবে শুধু সম্ভাবনা দেখলেই হবে না, তা কাজে রূপ দিতে হলে যথাযথ বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সঠিক বাজার সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সরকারি সহায়তা এই খাতকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন? রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কোনো প্রভাব ব্যবসায়ীদের মাঝে পড়েছে কি না?
আব্দুল ওয়াহেদ: ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করছেন। আর্থিক চাপের কারণে অনেক উদ্যোগ স্থগিত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবও দেখা দিয়েছে মার্কেটে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই সরকারের সঙ্গে ভারত ব্যবসা করতে চাইছে না। তাই রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত ব্যবসার পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
জাগো নিউজ: নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী গত এক বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কার্যক্রম শুরু করেনি। এমনটা কেন হচ্ছে, সমাধান কী?
আব্দুল ওয়াহেদ: গত এক বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারীর আগমন কম হওয়ার মূল কারণ হলো বাজারের অনিশ্চয়তা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং রপ্তানি-বাজার সংযোগে বিভিন্ন বাধা। অনেক উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী মনে করছেন এখানে বিনিয়োগ করলে লাভ নিশ্চিত করা কঠিন। আমরা চাই সরকারি প্রণোদনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বিনিয়োগবান্ধব জেলা হিসেবে গড়ে তোলা হোক। ভোটের মাধ্যমে কোনো সরকার না এলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে, আর এজন্য নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিসিক শিল্পনগরী নিয়ে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কোনো পরিকল্পনা বা প্রত্যাশা আছে কি না?
আব্দুল ওয়াহেদ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট প্রত্যাশা রয়েছে। আমরা চাই, এটি বিনিয়োগবান্ধব জোন হিসেবে কাজ করুক, যেখানে শিল্পকারখানা সহজেই স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে। বিসিক শিল্পনগরী বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধাজনক হবে। তবে বর্তমানে এই জেলার বিসিক নগরীতে পর্যাপ্ত স্থান বা প্লট নেই। এটি অন্তত ছোট একটি জায়গা। আমরা সরকারের প্রতি আবেদন করছি দ্রুত এই স্থান সম্প্রসারিত করে প্লটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হোক, যাতে নতুন শিল্প ও বিনিয়োগকারীদের আগমন সহজতর হবে।
জাগো নিউজ: চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও শিল্প বিনিয়োগের প্রসার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। আপনারা এ নিয়ে কী ভাবছেন?
আব্দুল ওয়াহেদ: সত্যি বলতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগের প্রসার এখনো তেমন চোখে পড়ার মতো হয়নি। মূলত এর পেছনে রয়েছে বাজারে অনিশ্চয়তা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশের অভাব। উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা দেখছেন, বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদি লাভ নিশ্চিত করা কঠিন। আমরা চাই সরকারি প্রণোদনা, সঠিক নীতিমালা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা হোক। যদি এসব বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে নতুন শিল্প ও বিনিয়োগের প্রসার দ্রুত বাড়তে পারে।
জাগো নিউজ: তরুণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী?
আব্দুল ওয়াহেদ: আমার তরুণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে বার্তা হলো— ধৈর্য, উদ্যম এবং সঠিক পরিকল্পনা থাকলেই সফল হওয়া সম্ভব। সমস্যার মুখে হাল ছাড়বেন না। নতুন চিন্তা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দক্ষতার বিকাশ আপনার পথকে শক্তিশালী করবে। আমি চাই, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যোক্তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান, একে অপরকে উৎসাহ দিন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা ও সৃজনশীলতা বজায় রাখুন। সরকারি সহায়তা ও বাজারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের উদ্যোগকে আরও বড় করুন। আর আমাদের কাছে আসেন কথা বলেন। আমরা বিভিন্নস্থানে প্রশিক্ষণসহ নানা সুবিধা করে দিব।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ায় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
আব্দুল ওয়াহেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ। এছাড়া আমি জাগো নিউজকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ তারা জেলা পর্যায়ে অবদান রাখা ব্যবসায়ীদের ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ধরনের মিডিয়ার কার্যক্রম শুধু উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতি ও শিল্প-বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করার পথও সুপ্রশস্ত করে। আমি আশা করি, এই প্রচেষ্টা আরও বেশি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীকে কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করবে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এফএ/জেআইএম