ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। স্থানীয় সময় সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) জার্মানির রাজধানী বার্লিনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূতদের সঙ্গে নতুন দফা বৈঠকে বসেন তিনি। এর আগে ইউরোপীয় নেতাদের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনেও যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে জেলেনস্কির।
এই আলোচনায় ইউক্রেনের লক্ষ্য হলো, রাশিয়ার কাছে কোনো ভূখণ্ড ছাড় না দিয়েই যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো। একই সঙ্গে ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা জোর দিচ্ছে, যেকোনো চুক্তিতে ‘ন্যায্য শান্তি’ নিশ্চিত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে রাশিয়া যেন আবার আগ্রাসন চালাতে না পারে, সে নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জানান, রোববার (১৪ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠকে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। ওই বৈঠকে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারও উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের বহর বার্লিনের চ্যান্সেলারি ভবনে পৌঁছায়। কিছুক্ষণ পর ইউক্রেনের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, আলোচনা পুনরায় শুরু হয়েছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস এই আলোচনার আয়োজক। তিনি সোমবার জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এদিন সন্ধ্যায় ইউরোপীয় একাধিক নেতার পাশাপাশি ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ কর্মকর্তারা আলোচনায় যোগ দেবেন, যা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থনের বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) জেলেনস্কি জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এরপর তিনি ও চ্যান্সেলর মের্ৎস ইউক্রেন-জার্মানি ব্যবসায়িক সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং যৌথ সংবাদ সম্মেলন করবেন।
সন্ধ্যায় নৈশভোজে অংশ নেবেন ইউরোপের একাধিক শীর্ষ নেতা। বার্লিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক এবং ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব অংশ নেবেন।এছাড়া ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডার লায়েনের উপস্থিতিও প্রত্যাশিত।
এদিকে, আলোচনাকে ঘিরে মধ্য বার্লিনকে উচ্চ নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। গাড়িবহর চলাচলের জন্য রাস্তা বন্ধ, ছাদে পুলিশ স্নাইপার, রাস্তায় কুকুর টহল ও আকাশে ড্রোন নজরদারি ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রায় চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে আগ্রহী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে গত মাসে উপস্থাপিত ২৮ দফা প্রস্তাবকে কিয়েভ ও ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার পক্ষে বেশি ঝুঁকে আছে বলে মনে করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেন পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে। রোববার (১৪ ডিসেম্বর) জেলেনস্কি বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেলে ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসতেও প্রস্তুত তার দেশ।
এ বিষয়ে রাশিয়ার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের জানান, ন্যাটো প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বার্লিনে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে মস্কো।
এদিকে, আলোচনার অন্যতম জটিল বিষয় হলো, ইউক্রেনকে কতটা ভূখণ্ড ছাড় দিতে হতে পারে এবং ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র যে সমঝোতা করবে, রাশিয়া তাতে রাজি হবে কি না।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকরা এখনো ইউক্রেনকে একত্রে দনবাস নামে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক শহর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। তবে ইউক্রেন এ প্রস্তাবে সম্মত নয় বলে জানান আলোচনায় যুক্ত এক কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, পুতিন ভূখণ্ড চান। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউক্রেন যেন ওই অঞ্চলগুলো থেকে সরে যায়। কিন্তু কিয়েভ এতে রাজি হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়ার অবস্থানের সঙ্গে মিলে যাওয়াটা কিছুটা বিস্ময়কর।
‘গভীর ও নিবিড় আলোচনা চলছে’
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ওয়াডেফুল সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করেন। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আদৌ তার সর্বোচ্চ দাবি থেকে সরে আসবেন কি না।
ওয়াডেফুল বলেন, আমার বিশ্বাস, আলোচনাগুলো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে পরিচালিত হচ্ছে। আলোচনা খুবই নিবিড়।’ তবে তিনি যোগ করেন, সপ্তাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সফলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভয়াবহ এই প্রাণহানি থামাতে ও যুদ্ধের ইতি টানতে প্রতিটি প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা এখনো জানি না, পুতিন সত্যিই এই যুদ্ধ শেষ করতে চান কি না।
জেলেনস্কি জানিয়েছেন, যদিও চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, তবে ওয়াশিংটন চায় বড়দিনের আগেই একটি সমঝোতার কাঠামো প্রস্তুত করতে।রোববার তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পরিকল্পনাটি যেন যতটা সম্ভব ন্যায্য হয়, বিশেষ করে ইউক্রেনের জন্য। কারণ যুদ্ধটি শুরু করেছে রাশিয়াই।
সূত্র: এএফপি
এসএএইচ