আন্তর্জাতিক

আরব বসন্তের ১৫ বছর: ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টরা কে কোথায়?

আজ থেকে ১৫ বছর আগে, ২৬ বছর বয়সী তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মোহামেদ বুয়াজিজি পুলিশের হয়রানি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতিবাদে নিজের গায়ে আগুন দেন। ওই ঘটনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় আরব বিশ্বের ইতিহাস বদলে দেওয়া গণআন্দোলন, যা পরে পরিচিতি পায় ‘আরব বসন্ত’ নামে।

বেকারত্ব, দুর্নীতি, দমন-পীড়ন ও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তিউনিসিয়া। মাত্র ২৮ দিনের আন্দোলনে ২৩ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট জিন এল আবিদিন বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হন। তিউনিসিয়ার এই অভ্যুত্থান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গণবিক্ষোভ। এর ফলে পাঁচজন দীর্ঘদিনের শাসক ক্ষমতা হারান। সেই নেতারা এখন কোথায়—তা নিয়েই এই প্রতিবেদন।

তিউনিসিয়া: জাইন এল আবিদিন বেন আলি(১৯৩৬–২০১৯)ক্ষমতায়: ১৯৮৭–২০১১ (২৩ বছর)অবস্থা: নির্বাসনে মৃত্যু

১৯৮৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আজীবন প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবাকে শাসনের অযোগ্য ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করেন বেন আলি। সাবেক নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে তিনি কঠোর দমননীতি, নিরাপত্তা সংস্থা-নির্ভর শাসনব্যবস্থা ও অনুগত রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। অর্থনীতি কিছুটা খুলে দিলেও দুর্নীতি, বৈষম্য ও গণমাধ্যম সেন্সরশিপ তীব্র আকার ধারণ করে।

আরও পড়ুন>>দেশে দেশে পলাতক নেতাদের বিচার: কেমন ছিল পরিণতি?ঐতিহাসিক বিচার/ ক্ষমতার চূড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডের মঞ্চে যেসব সরকারপ্রধানহাসিনা, আসাদ—এরপর কে?

২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বৌআজিজির আত্মাহুতির পর দেশজুড়ে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে বেন আলি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। পরে তিউনিসিয়ার আদালত তাকে অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্বাসিত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

মিশর: হোসনি মুবারক(১৯২৮–২০২০)ক্ষমতায়: ১৯৮১–২০১১ (৩০ বছর)অবস্থা: মুক্তির পর দেশে মৃত্যু

১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্ট হন সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান হোসনি মুবারক। জরুরি আইন, সেনাবাহিনীর প্রভাব ও দমননীতির মাধ্যমে তিনি তিন দশক ক্ষমতায় থাকেন। দুর্নীতি, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়।

১৮ দিনের আন্দোলনের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মুবারক পদত্যাগে বাধ্য হন। বিপ্লব চলাকালে বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল হয়। দুর্নীতির মামলায় কিছুদিন আটক থাকলেও ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কায়রোতে তার মৃত্যু হয়।

ইয়েমেন: আলি আবদুল্লাহ সালেহ(১৯৪৭–২০১৭)ক্ষমতায়: ১৯৭৮–২০১২ (৩৩ বছর)অবস্থা: হুথিদের হাতে নিহত

উত্তর ইয়েমেন ও পরে একীভূত ইয়েমেন শাসন করা সালেহ উপজাতীয় ও সামরিক রাজনীতির কৌশলী খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১১ সালের আন্দোলনের পর ২০১২ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তবে পরে সাবেক শত্রু হুথিদের সঙ্গে জোট বেঁধে ২০১৪ সালে রাজধানী সানা দখলে সহায়তা করেন।

আরও পড়ুন>>আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় এক বছরে কতটা পরিবর্তন হলো?আফ্রিকায় হঠাৎ সেনা অভ্যুত্থানের ঢেউ, গণতন্ত্র হারালো কোন কোন দেশযাদের হাত ধরে ক্ষমতায়, তাদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট!সাধারণ ক্ষমার নিশ্চয়তায় দেশ ছাড়তে রাজি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট

২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলে হুথিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে যায়। ওই বছরই হুথি বাহিনীর হাতে নিহত হন সালেহ।

লিবিয়া: মুয়াম্মার গাদ্দাফি(১৯৪২–২০১১)ক্ষমতায়: ১৯৬৯–২০১১ (৪২ বছর)অবস্থা: বিদ্রোহীদের হাতে নিহত

১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন গাদ্দাফি। তেলসম্পদের ওপর ভর করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন তিনি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনগাজিতে মানবাধিকারকর্মী গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়, যা দ্রুত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।

ন্যাটো অভিযানের সহায়তায় বিদ্রোহীরা আগস্টে ত্রিপোলি দখল করে। অক্টোবরের ২০ তারিখ নিজ শহর সির্তে পালানোর সময় বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হন গাদ্দাফি।

সিরিয়া: বাশার আল-আসাদ(১৯৬৫–বর্তমান)ক্ষমতায়: ২০০০–২০২৪ (২৪ বছর)অবস্থা: ক্ষমতাচ্যুত, নির্বাসনে

২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর বিশেষ সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন বাশার আল-আসাদ। ২০১১ সালে দেরা শহরে স্কুলের দেয়ালে সরকারবিরোধী গ্রাফিতি লেখাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয়, তা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা যুদ্ধে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের আকস্মিক অভিযানে সিরীয় সেনাবাহিনী ভেঙে পড়ে। দামেস্কে বিদ্রোহীরা ঢোকার পর বাশার আল-আসাদ পরিবারসহ প্লেনে করে রাশিয়ার মস্কোতে পালিয়ে যান এবং সেখানে আশ্রয় নেন।

সূত্র: আল-জাজিরাকেএএ/