বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য

ইফতেখার রবিন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখান থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা, এখানেই প্রথম উত্তোলিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের সবুজ-লাল পতাকা। শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে তার স্বাধীনতা সংকুচিত করতে। কালাকানুন জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যা এমনকি ব্রিটিশ আমলেও অক্ষুণ্ণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের লেখালেখি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে; আবার কখনো তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে কাছে টানার চেষ্টাও হয়েছে।

শুধু দেশি শাসকরাই নয়, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল বিশেষ আগ্রহ। প্রতিষ্ঠার শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরির উদ্দেশ্যে। এই শ্রেণি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেও গড়ে উঠছিল দুর্বলচিত্ত, লোভী মানুষও সেখানে ছিলেন। তবুও বিচ্যুতি সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবস্থান ছিল জনতার পক্ষে, বাংলাদেশের পক্ষে। পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় থাকলেও তাদের প্রভাব শেষ পর্যন্ত বড় কোনো ঢেউ তুলতে পারেনি; বরং তাদের কার্যকলাপই জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

ব্রিটিশরা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সন্দিগ্ধ ছিল, পাকিস্তানিরা সেই সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি তারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছিল জনবহুল শহর থেকে দূরে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে। সাভারে পরিকল্পিত মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রান্তরে। এমনকি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শহর থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার: বিশ্ববিদ্যালয়কে জনতা থেকে দূরে রাখলে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি করার সুযোগ কমবে, অধিকারের দাবি তোলার শক্তি ক্ষীণ হবে।

এই আক্রোশের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭১ সালে। গণহত্যার সূচনাতেই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী প্রথম ছুটে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নির্বিচারে হত্যা করে শিক্ষক-ছাত্রদের; ধ্বংস করে ভবন-প্রাঙ্গণ। আত্মসমর্পণের ঠিক আগে তারা অনুচরদের পাঠায় আন্দোলনপন্থী শিক্ষকদের বেছে বেছে হত্যার জন্য।

বুদ্ধিজীবী সমাজ তখনো ছিল হানাদারদের প্রধান নিশানা। তাদের ধারণা ছিল বুদ্ধিজীবীদের উসকানিতেই বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। তাই প্রতিটি শহরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা চলছিল; কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু শেষ করার আগেই তারা পরাজিত হয় যা বাংলাদেশের জন্য রক্ষা।

অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল সম্পদ পাচার হচ্ছে এ সত্য তারা আরও স্পষ্ট করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তারা জানান, পশ্চিমাদের কৌশলে পূর্ববাংলার অর্থনীতি ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। তথ্য গোপন, কেন্দ্রীয় পদে বাঙালি বঞ্চনা সব বাধা সত্ত্বেও তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, দুই অঞ্চলের আলাদা অর্থনীতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই দাবি থেকেই জন্ম নেয় এক সময় দুই রাষ্ট্রের ধারণা।

বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা যেমন ছিল, তেমনি ছিল অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম হওয়ায় এ দেশে বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক মর্যাদা ছিল বিশেষ। ফলে তাদের ওপর আক্রমণ মানেই পুরো জাতি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া। ১৯৫২-তে ছাত্রদের ওপর গুলি চলার পর যখন শিক্ষকদেরও গ্রেফতারের পরোয়ানা নামল,জ তখনই ছাত্র আন্দোলন পরিণত হলো সর্বজনীন গণআন্দোলনে।

১৯৬৯-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোহা নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই কার্ফু অমান্য করে হাজারও মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ড. জোহাকে অনেকেই চিনতেন না, তবুও সাধারণ মানুষ তার হত্যাকে নিজেদের অস্তিত্বে আঘাত হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেই ক্ষোভের প্রবল স্রোতে আইয়ুব খান ও মোনেম খান ভেসে যায়।

মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা জনগণকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। যে পত্রিকাকে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, জনতা তাকে ততই আপন করে নিয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ঠিক তখনই, যখন তার প্রকাশনা বন্ধ ছিল আর সম্পাদক কারারুদ্ধ।

১৯৭১-এর গণহত্যার সময়ে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও ক্ষোভজাগানিয়া ঘটনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ। এ দৃশ্য পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে থাকা বাঙালিদের বুঝিয়ে দিয়েছিল পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই।

যেসব বুদ্ধিজীবী জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকারের তাঁবেদারি করেছিল, তাদের ওপর শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে। আইয়ুব শাসনামলে যারা রবীন্দ্রনাথ কিংবা বাংলা ভাষাকে বর্জনের ডাক দিয়েছিল তাদের বক্তব্য জনমানসে উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যাকে তারা অগ্রাহ্য করতে বলেছে, মানুষ তাকে আরও বেশি আপন করে নিয়েছে। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্যকে দমনের প্রতিটি চেষ্টা পরিণামে ব্যর্থ হয়েছে।

অথচ এই বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবীরাও অজান্তে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছেন কারণ তাদের কর্মকাণ্ড মানুষের চেতনা আরও উজ্জীবিত করেছে।

জনতার পক্ষে থাকা বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন আন্দোলনের অগ্রবর্তী অংশ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯ তারপর ১৯৭১ প্রতি পর্যায়ে তারা রাজপথে ছিলেন, সশব্দে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, সভা করেছেন, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেছেন। এসব ঘটনা হয়তো ছোট, কিন্তু তাৎপর্য গভীর। এগুলো প্রমাণ করেছে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ একসূত্রে গাঁথা হলে কোনো শক্তিই তাদের দাবিকে থামাতে পারে না।

এভাবেই বুদ্ধিজীবী সমাজ ও জনতার মিলিত শক্তির ফলেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছে। জনতাই মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই লড়েছে, কিন্তু তাদের চেতনা নির্মাণে, পথে আলো দেখাতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অমূল্য।

আরও পড়ুন
মহাবিশ্বের কোথায় প্রথম সূর্যোদয় হয় জানেন?
নারী জাগরণের অগ্নিশিখা বেগম রোকেয়া

লেখক: শিক্ষার্থী,বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।