ফিচার

বছরের দীর্ঘতম রাতে কোন দেশের মানুষ কী রীতি পালন করে

বছরের দীর্ঘতম রাতকে ঘিরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষের বিশ্বাস, রীতি ও আচরণে রয়েছে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এটি ‘উইন্টার সোলাস্টিক’ বা ‘শীত অয়নান্ত’, কিন্তু বহু সংস্কৃতিতে এই রাত শুধুই বৈজ্ঞানিক ঘটনা নয় এটি আশার, পুনর্জাগরণ ও পরিবর্তনের প্রতীক।

ইউরোপের দীর্ঘতম রাত উদযাপনইউরোপের বিভিন্ন দেশে বছরের দীর্ঘতম রাতকে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন উৎসবের ইতিহাস। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এই রাতকে ঘিরে আগুন জ্বালানো, গান গাওয়া ও পারিবারিক ভোজের আয়োজন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, দীর্ঘ অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফেরার সূচনা হয় এই রাতের পর থেকেই। অনেক জায়গায় মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে আলো রাখে, যেন অন্ধকারের মধ্যেও আলোকে আহ্বান জানানো যায়।

চীনে আয়োজন করা হয় ডংঝি উৎসবেরচীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শীত অয়নান্তকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হিসেবে দেখা হয়। চীনে এই সময় ‘ডংঝি’ উৎসব পালিত হয়। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে একত্র হয়ে বিশেষ খাবার খাওয়ার রীতি রয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, এই রাতের পর দিন বড় হতে শুরু করে, অর্থাৎ প্রকৃতি আবার শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।

এছাড়া ডংঝি উৎসবের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হলো টাংইয়ুয়ান, যা আঠালো ভাতের ছোট বলের আকারে তৈরি হয়। সাধারণত এগুলো মিষ্টি বা সুস্বাদু অন্যান্য উপাদানে ভরা থাকে। তাদের গোলাকার আকৃতি ঐক্য, সম্পূর্ণতা এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এগুলি ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন আরও শক্তিশালী হয়।

খাবারের আনন্দের পাশাপাশি, ডংঝি রীতিনীতিতে স্বাস্থ্য ও সুখের জন্য প্রার্থনা করা হয়, পূর্বপুরুষদের সম্মান জানানো হয় এবং সামনের উজ্জ্বল দিনগুলিকে স্বাগত জানানোর জন্য আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ব্যস্ত শহরের কোণে হোক বা শান্ত গ্রামীণ পরিবেশে, ডংঝি উৎসব সবসময়ই সংযোগ, পুনর্নবীকরণ এবং প্রাকৃতিক জগতের স্থায়ী চক্রের গুরুত্বের একটি সুন্দর স্মারক হিসেবে উদযাপিত হয়।

ইরানে পালন করা হয় শাব-ই ইয়ালদাশব-ই ইয়ালদা, বা ‘ইয়ালদার রাত’ বা ‘চেলে রাত’, পারস্য সংস্কৃতির সবচেয়ে লালিত এবং প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি। এটি শীতকালীন অয়নকাল এবং বছরের দীর্ঘতম রাতকে উদযাপন করে। জোরোস্ট্রিয়ান বিশ্বাসে এই উৎসবের গভীর তাৎপর্য রয়েছে অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় এবং জীবনের পুনর্নবীকরণ এর প্রতীক হিসেবে ইয়ালদা বিবেচিত হয়। প্রাচীন পারস্যে আলোর দেবতা মিত্রার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং শীতের সময় আশা, উষ্ণতা ও ঐক্য বজায় রাখতে এই উৎসব পালন করা হত।

এই রাতে পরিবার এবং বন্ধুরা একত্রিত হয়ে ভোর পর্যন্ত জেগে থাকে, একসাথে সময় কাটায় এবং আলোর প্রত্যাবর্তনকে উদযাপন করে। টেবিলগুলোকে মৌসুমী ফল যেমন ডালিম ও তরমুজ দিয়ে সাজানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, ডালিমের লাল বীজ জীবনের উজ্জ্বলতা প্রতিফলিত করে, আর তরমুজ গ্রীষ্মের উষ্ণতাকে জাগিয়ে তোলে। এছাড়াও বাদাম, শুকনো ফল ও মিষ্টি পরিবেশনের মাধ্যমে সমৃদ্ধি এবং প্রাচুর্যের প্রতীক ফুটিয়ে তোলা হয়।

ইয়ালদার অন্যতম বিশেষ অংশ হলো কবিতা আবৃত্তি, বিশেষ করে বিখ্যাত ফার্সি কবি হাফেজের কবিতার পংক্তি পাঠ। অংশগ্রহণকারীরা এই কবিতাগুলোকে আগামী বছরের বার্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করে। রাত জেগে ভোরের আলোকে স্বাগত জানানো হয় এবং অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় উদযাপিত হয়।

শব-ই ইয়ালদা শুধু পারস্যে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ফার্সি প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও উদযাপিত হয়। এটি এক ধরনের সংযোগ, পুনর্নবীকরণ এবং জীবনের আশা প্রকাশের উৎসব, যা সাংস্কৃতিক সীমা ছাড়িয়ে সকলের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়।

জাপানে উদযাপন হয় তোজিজাপানে শীতকালীন অয়নকাল বা তোজি উদযাপন করা হয় বিশেষ কিছু শান্তিপূর্ণ ও অনন্য প্রথার মাধ্যমে। এটি প্রকৃতি এবং ঋতুগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের গভীর সংযোগকে প্রতিফলিত করে।

তোজির সবচেয়ে জনপ্রিয় ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ইউজু স্নান। এই প্রথায় ছোট, সুগন্ধযুক্ত লেবু ফল ইউজু পুরো ফলই গরম স্নানে ভাসানো হয়, যা বাড়ি কিংবা জনসাধারণের অনসেনে করা হয়। ইউজুর সতেজ সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং মন ও শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে। বিশ্বাস করা হয়, এই প্রথা অসুস্থতা দূর করে, দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করে এবং আগামী বছরের জন্য সৌভাগ্য আনে।

তোজি হলো উষ্ণতা ও প্রাণশক্তি সমৃদ্ধ মৌসুমী খাবারের উৎসব। বিশেষ করে কাবোচা স্কোয়াশ বা জাপানি কুমড়া খুবই জনপ্রিয়। শীতকালে এটি শক্তি ও উদ্দীপনার উৎস হিসেবে খাওয়া হয়। এই সব প্রথা মানুষকে শেখায় আত্ম-যত্ন, ভারসাম্য এবং ঋতুর প্রাকৃতিক ছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার গুরুত্ব। তোজি উৎসব শুধু শীতকে উপভোগের মাধ্যম নয়, এটি শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার এক সুন্দর অভ্যাস হিসেবেও বিবেচিত হয়।

বাংলাদেশে নেই কোনো বাড়াবাড়ি তবে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে বছরের দীর্ঘতম রাত আলাদা কোনো উৎসবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও লোকবিশ্বাসের অভাব নেই। গ্রামাঞ্চলে অনেকেই মনে করেন, এই রাতে শীত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় এবং প্রকৃতি যেন একধরনের স্থিরতায় ঢুকে পড়ে। কেউ কেউ এই রাতকে নীরবতা ও আত্মবিশ্লেষণের সময় হিসেবে দেখেন। ধর্মীয় মানুষদের মধ্যে দীর্ঘ রাত জেগে প্রার্থনা বা ইবাদতের প্রবণতাও দেখা যায়।

আদিবাসী ও প্রাচীন সভ্যতায় এর বেশ গুরুত্ব ছিলআদিবাসী ও প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে বছরের দীর্ঘতম রাত ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক জাতিগোষ্ঠী বিশ্বাস করত, এই রাতে অশুভ শক্তি ও শুভ শক্তির মধ্যে লড়াই হয়। তাই তারা নাচ, গান বা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুভ শক্তিকে আহ্বান জানাত। আগুন জ্বালানো ছিল সবচেয়ে প্রচলিত রীতি, যা আলো ও জীবনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।

আধুনিক সময়ে এসে এই দীর্ঘতম রাতের অর্থ কিছুটা বদলে গেছে। শহুরে জীবনে অনেকেই এই রাত কাটান সিনেমা দেখা, বই পড়া বা মোবাইল ফোনে সময় কাটিয়ে। আবার কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রযুক্তি থেকে দূরে থেকে এই দীর্ঘ রাতকে নিজের সঙ্গে কাটানোর সুযোগ হিসেবে নেন। কারও কাছে এটি নিছক আরেকটি শীতের রাত, আবার কারও কাছে বছরের সবচেয়ে নীরব ও ভাবনার সময়।

সব মিলিয়ে বছরের দীর্ঘতম রাত মানুষকে ভিন্ন ভিন্নভাবে স্পর্শ করে। কোথাও এটি উৎসবের, কোথাও বিশ্বাসের, কোথাও আবার নিঃশব্দ আত্মসময়ের প্রতীক। তবে একটি বিষয় প্রায় সব সংস্কৃতিতেই মিল রয়েছে এই রাতের পর থেকেই আলো ফিরে আসার আশাই মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

আরও পড়ুনফাইনাল পরীক্ষা শেষ, ছুটিতে রঙিন হোক শৈশবগ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের আয়োজন কি হারাতে বসেছে

সূত্র: ইনসাইড ভ্যাকেশনস

কেএসকে/এএসএম