২০২৬ সাল থেকেই বিশ্বজুড়ে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করার সর্বশেষ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’-এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। নতুন করে চুক্তির জন্য আলোচনার সময় প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন এক পরিস্থিতি সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এই অনিশ্চয়তার পটভূমিতে চীন দ্রুত তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যেও নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের ভাবনা জোরদার হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যদি নতুন কাঠামো তৈরি না হয়, তাহলে ২০২৬ সাল থেকেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এই প্রতিযোগিতা ঠেকানোর সবচেয়ে বড় আশা হলো নিউ স্টার্ট চুক্তির অনানুষ্ঠানিক মেয়াদ বাড়ানো, যাতে পরবর্তী কোনো চুক্তির জন্য সময় পাওয়া যায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বর্তমান সীমা আরও এক বছরের জন্য বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার হামলার পর যেসব যাচাই-বাছাই ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, নতুন কোনো অন্তর্বর্তী চুক্তিতে সেগুলো ফিরবে কি না, তা অনিশ্চিত। ফলে এমন সাময়িক সমাধান হয়তো কেবল সমস্যাকে কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দেবে।
আরও পড়ুন>>যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে পৃথিবীকে ১৫০ বার ধ্বংস করা সম্ভব: ট্রাম্পপাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে, দাবি ট্রাম্পেরউ. কোরিয়ার মজুত ইউরেনিয়াম দিয়ে ৪৭ পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভবইউক্রেনের কাছেও ছিল পরমাণু অস্ত্র, ছেড়েছিল যে আশ্বাসে
নিউ স্টার্ট চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া প্রত্যেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি মোতায়েনকৃত ‘কৌশলগত’ বা দূরপাল্লার পারমাণবিক ওয়ারহেড এবং ৭০০ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা রাখতে পারে। তবে বাস্তবে দুই দেশের মোট মজুত আরও অনেক বড়। কৌশলগত অস্ত্রের পাশাপাশি স্বল্পপাল্লার তথাকথিত ‘ট্যাকটিক্যাল’ অস্ত্র ও সংরক্ষিত ওয়ারহেড মিলিয়ে উভয় দেশের কাছেই পাঁচ হাজারের বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে, চীনের কাছে বর্তমানে ৬০০র বেশি ওয়ারহেড আছে এবং পেন্টাগনের হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে তা এক হাজার ছাড়াতে পারে।
নতুন চুক্তি কি সম্ভব?যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় শিবিরের পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, রাশিয়া ও চীন—এই দুই সমমর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র দরকার। কেউ কেউ বলছেন, নিউ স্টার্ট থেকে সরে আসার সময় হয়ে গেছে। আবার অন্যদের মতে, নতুন কোনো চুক্তিতে রাশিয়ার প্রায় ১ হাজার ৫০০ ট্যাকটিক্যাল অস্ত্র (যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১০০টি) এবং উন্নয়নাধীন পরমাণুচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বা টর্পেডোর মতো বিশেষ ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনকে কোনোভাবে এই নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আওতায় আনা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন যুদ্ধে যদি রাশিয়ার অবস্থান অচলাবস্থায় থাকে, তাহলে পুতিন পারমাণবিক হুমকি ব্যবহার করে যেতে চাইবেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে শক্তির ভারসাম্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বা আদৌ কখনোই চীন পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাজি না-ও হতে পারে।
ট্রাম্প কী করবেন?এই পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানও জটিল। একদিকে, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর সামরিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় ফেরার বিষয়ে তার ঢিলেঢালা মন্তব্য যদি বাস্তব রূপ নেয়, তাহলে অন্য দেশগুলোর মধ্যেও নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।
আবার অন্যদিকে, পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ট্রাম্পকে আশির দশক থেকেই উদ্বিগ্ন করে আসছে। তিনি একাধিকবার এসব অস্ত্রের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। পাশাপাশি, নিজেকে ‘চূড়ান্ত সমঝোতাকারী’ হিসেবে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষাও তার রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ট্রাম্প যদি আন্তরিকভাবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনায় না যান, তাহলে বিশ্ব এমন এক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে এগোতে পারে, যা স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রতিযোগিতার চেয়েও ভয়াবহ হবে। আবার তিনি আলোচনায় গেলেও শঙ্কা পুরোপুরি কাটবে না। যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের পারমাণবিক ছাতার ওপর তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামান্য সন্দেহ তৈরি হলেই, কিছু দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের পথ বেছে নিতে পারে। আর যদি শুল্কনীতির মতো পারমাণবিক আলোচনাতেও তিনি চাপ ও হুমকিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে সেটিও বিশ্বের জন্য হবে এক আতঙ্কজনক ভবিষ্যৎ।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/