মতামত

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে উত্তেজনা

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে উত্তেজনা এখন আর কেবল কূটনৈতিক পর্যায়ের একটি বিষয় নয়। এটি দুই দেশের সাধারণ মানুষের মনেও অনিশ্চয়তা উদ্বেগ এবং দূরত্ব তৈরি করছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা স্পষ্টভাবে বৈরিতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে এই সম্পর্কের মধ্যে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছিল, গত দেড় বছরে নানা ঘটনা সেই টানাপড়েনকে ধীরে ধীরে আরও গভীর করেছে। সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক তলব, রাজনৈতিক নেতাদের কড়া বক্তব্য এবং দুই দেশের কূটনৈতিক স্থাপনার সামনে বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে স্বাভাবিক সম্পর্কের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

এই উত্তেজনার প্রভাব কেবল কাগজে কলমে বা বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ নেই। এর বাস্তব প্রভাব পড়েছে ভিসা সেন্টারের কার্যক্রমে। প্রথমে ভারত বাংলাদেশে ভিসা সেন্টারের কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে বাংলাদেশও একই সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী কিংবা আত্মীয় স্বজনের কাছে যেতে চাওয়া মানুষ হঠাৎ করেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অভিযোগ রয়েছে যে ভারত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ‘নসিহত’ দেওয়ার চেষ্টা করছে। একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে এ ধরনের আচরণ স্বাভাবিকভাবেই আস্থার সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস খুবই গভীর এবং জটিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকা দুই দেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছিল। ভৌগোলিক নৈকট্য, সাংস্কৃতিক মিল, ভাষাগত যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা এই সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবেই ঘনিষ্ঠ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই সম্পর্ক কখনও পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। সীমান্তে প্রাণহানি, পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত প্রশ্ন বাণিজ্য ঘাটতি এবং একে অন্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে সন্দেহ বহুবার এই সম্পর্ককে চাপে ফেলেছে। তবু কিছুদিন ধরে য চলছে, এত বড় মাত্রার প্রকাশ্য উত্তেজনা এর আগে কখনও দেখা যানি।

স্বাভাবিক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় থাকলে লাভ হয় উভয় পক্ষেরই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে প্রয়োজন সংযম ও দায়িত্বশীলতা। বড় দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে যেমন কর্তৃত্বমূলক বা ‘দাদাগিরি’ আচরণ প্রত্যাশিত নয়, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও উসকানিমূলক বক্তব্য বা আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া কাম্য নয়। পারস্পরিক সম্মান, যুক্তিবোধ ও বাস্তবতার আলোকে সংলাপই হতে পারে এই উত্তেজনা কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর পথ। সেই পথেই হাঁটতে পারলেই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক আবারও স্থিতিশীল ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারে।

২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করে। এই পরিবর্তন ভারতের কাছে কেবল প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না। বরং এটি ভারতের নিরাপত্তা রাজনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই আশঙ্কা তৈরি হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে গেলে উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনায় প্রভাব পড়তে পারে। সেই উদ্বেগ থেকেই সতর্ক নজরদারি শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে পরোক্ষ হস্তক্ষেপের অভিযোগ সামনে আসে।

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে চোখে পড়া বিষয় হলো কূটনৈতিক তলবের ঘনঘটা। মাত্র দশ দিনের মধ্যে চার দফা একে অন্যের কূটনীতিককে তলব করা হয়েছে। কূটনীতিতে তলব মানেই একটি কঠিন বার্তা দেওয়া। এত অল্প সময়ে বারবার তলব হওয়া স্পষ্ট করে দেয় যে দুই দেশের মধ্যে আস্থার জায়গা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের প্রকাশ্য মন্তব্য। বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে বক্তব্য এবং এর জবাবে ভারতের আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর ভাষা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এসব বক্তব্য অনেক সময় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে দেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রতিক্রিয়া এড়ানো যায় না।এই উত্তেজনার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো কূটনৈতিক স্থাপনার সামনে বিক্ষোভ এবং হামলা। নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন কলকাতায় উপহাইকমিশন চট্টগ্রাম ও খুলনায় ভারতীয় উপহাইকমিশনের সামনে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা স্বাগতিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। দিল্লিতে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা শিলিগুড়িতে হামলা কিংবা চট্টগ্রামে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুই দেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

এই উত্তেজনার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ফলে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী, শিক্ষার জন্য আবেদনকারী শিক্ষার্থী কিংবা ব্যবসার কাজে যাতায়াত করা মানুষ সবাই অনিশ্চয়তায় পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ যাতায়াত করে। এই মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগই আসলে দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে। সেই যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হলে জনমনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চললে তা ভবিষ্যতে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। ঢাকার অভিযোগ যে ভারত নির্বাচন নিয়ে নসিহত দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক আবেগ এমনিতেই তীব্র থাকে। এই সময়ে বাইরের কোনো মন্তব্য বা ইঙ্গিত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। যদি এই উত্তেজনাকে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো কাজে লাগাতে পারে, তাহলে তার প্রভাব শুধু নির্বাচনের ওপর নয় বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও পড়তে পারে।

সম্প্রতি সংঘটিত শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ড এবং দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও আবেগপ্রবণ করে তোলে। এসব ঘটনায় সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক অনুভূতি একসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফলে উত্তেজনা খুব দ্রুত সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে যায়। নয়াদিল্লিতে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ চট্টগ্রাম ও খুলনায় পাল্টা বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় কীভাবে একটি সহিংস ঘটনার প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে।

বর্তমানে দুই দেশের কর্মকর্তা পর্যায়ে যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ধারা দেখা যাচ্ছে, তা সুস্থ কূটনীতির পরিচয় দেয় না। কূটনীতি মূলত সংযম আস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের ভারসাম্যের জায়গা। কে আগে কী বলল তার জবাব দেওয়া এই প্রতিযোগিতা সম্পর্ককে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেয়। অনেক সময় নীরব আলোচনা পর্দার আড়ালের সংলাপ এবং ধৈর্যশীল অবস্থানই সবচেয়ে কার্যকর হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই পরিণত কৌশলের ঘাটতি স্পষ্ট।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের অবনতি শুধু এই দুই দেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই উদ্বেগের। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা এমনিতেই দুর্বল। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে বাণিজ্য জ্বালানি পরিবহন এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও ভারত বড় একটি বাজার এবং অংশীদার। সম্পর্ক খারাপ হলে ক্ষতি শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষেরই।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হলো সম্পর্কের অবনতি থামানো। তার জন্য দায়িত্বশীল বক্তব্য অত্যন্ত প্রয়োজন। রাজনৈতিক লাভের জন্য প্রতিবেশী দেশ নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে সরে আসতে হবে। কূটনৈতিক চ্যানেলকে আরও সক্রিয় করতে হবে। প্রকাশ্য বক্তব্যের চেয়ে নীরব আলোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি দূর করা অনেক বেশি ফলপ্রসূ। পাশাপাশি কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুই দেশেরই দায়িত্ব। এতে অন্তত ন্যূনতম আস্থার জায়গা তৈরি হবে।

সবশেষে একটি বাস্তব সত্য মেনে নিতে হবে। প্রতিবেশী কখনও বদলানো যায় না। ইতিহাস ভৌগোলিক অবস্থান এবং মানুষের যোগাযোগ বাংলাদেশ ও ভারতকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে। স্বাভাবিক সম্পর্ক মানে নতজানু হওয়া নয়। এর মানে পারস্পরিক সম্মান সমতা এবং স্বার্থের স্বীকৃতি। সম্পর্কের উত্থান পতন স্বাভাবিক। কিন্তু তা যেন স্থায়ী বৈরিতায় রূপ না নেয়, সেদিকে উভয় দেশকেই সচেতন থাকতে হবে।

উভয় দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাস্তবতা হলো, দুই দেশের স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক দিক থেকে যেমন এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নিরাপত্তার প্রশ্নেও একে অন্যের ওপর নির্ভরতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণের প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি প্রতিবছর ভারতে যান। একইভাবে বাংলাদেশের বাজার ভারতের জন্য সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি গন্তব্য, যেখানে ভারতীয় পণ্য স্বাভাবিকভাবেই প্রবেশ করে। এই পারস্পরিক নির্ভরতার বাস্তবতা উপেক্ষা করে সম্পর্ককে দীর্ঘদিন বৈরিতার পথে ঠেলে দেওয়া কারও পক্ষেই যুক্তিসংগত নয়।

স্বাভাবিক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় থাকলে লাভ হয় উভয় পক্ষেরই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে প্রয়োজন সংযম ও দায়িত্বশীলতা। বড় দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে যেমন কর্তৃত্বমূলক বা ‘দাদাগিরি’ আচরণ প্রত্যাশিত নয়, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও উসকানিমূলক বক্তব্য বা আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া কাম্য নয়। পারস্পরিক সম্মান, যুক্তিবোধ ও বাস্তবতার আলোকে সংলাপই হতে পারে এই উত্তেজনা কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর পথ। সেই পথেই হাঁটতে পারলেই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক আবারও স্থিতিশীল ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারে।

এইচআর/এএসএম