অর্থনীতি

অনিশ্চয়তাই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু

খেলাপি ঋণের পাহাড়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এমন বাস্তবতায় ব্যাংকখাত থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস।

তিনি বর্তমান সরকারের নীতি, দুর্নীতির বাস্তব চিত্র, পাচার অর্থ উদ্ধার, নতুন রাজনৈতিক শক্তি এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা—সবকিছু নিয়েই খোলামেলা মত দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়ে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপন।

জাগো নিউজ: দেশের ব্যাংকখাতের সবচেয়ে বড় সংকটটা আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. আব্দুল বায়েস: ব্যাংকখাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। মোট ঋণের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এখন খেলাপি—আমার সঠিক হিসাব না থাকলেও এটা যে বিশাল অংক, তা স্পষ্ট। এই ঋণের বড় অংশ কোনোদিনই পুরোপুরি আদায় করা যাবে না।

দেশে এখন গভীর অনিশ্চয়তা চলছে, যা অতীতে কখনো এত তীব্র ছিল না। বিনিয়োগকারীরা জানে না আগামীকাল কী হবে, ফলে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই অনিশ্চয়তা কাটানোর একমাত্র উপায় হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

জাগো নিউজ: যারা খেলাপি হয়েছেন, তাদের কি আদৌ অর্থ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা নেই?

ড. আব্দুল বায়েস: সক্ষমতা আছে বলেই তো সমস্যা। যারা খেলাপি হয়েছেন, তারা দরিদ্র নন। তারা দেশ-বিদেশে নানা খাতে বিনিয়োগ করেছেন, সম্পদ গড়েছেন। প্রয়োজনে তারা আরও বড় সম্পদ কিনতে পারবেন, কিন্তু ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার আগ্রহ দেখান না। রাজনৈতিক বৈধতা ও স্থিতিশীলতা ছাড়া খেলাপি ঋণ, পাচার অর্থ কিংবা বিনিয়োগ সংকট—কোনোটারই সমাধান হবে না। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে যেতেই হবে।

জাগো নিউজ: পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা কি বাস্তবসম্মত?

ড. আব্দুল বায়েস: এটা খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। সম্প্রতি বলা হয়েছে, দেশে ও দেশের বাইরে মিলিয়ে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো ফেরত আনতে গেলে দীর্ঘ আইনি লড়াই হবে। সেখানে সরকার যেমন জিততে পারে, তেমনি বিপরীত পক্ষও জিততে পারে। সব অর্থ যে অবৈধ—তা নয়। ট্রেড–রিলেটেড বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে কিছু ধারণা পাওয়া যায়—যেমন আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং। তবে সব টাকা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন।

দুর্বল ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে আমানত নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হতে পারে। মানুষ এখন সঞ্চয় করছে না, বরং ডি-সেভিং করছে—সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে

জাগো নিউজ: সরকার দুর্নীতি কমেছে বলে দাবি করছে। আপনি কী মনে করেন?

ড. আব্দুল বায়েস: আমি সে দাবির সঙ্গে একমত নই। বড় প্রকল্প বন্ধ থাকলে দুর্নীতি কম মনে হতে পারে। কিন্তু ছোট ও মাঝারি প্রকল্পে এখনো ঘুস ও দুর্নীতি চলছে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।

আরও পড়ুনবিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য অধিকার বড় চ্যালেঞ্জবিমানের লয়্যালটি ক্লাবে সদস্য হলে ফ্রি টিকিট-লাউঞ্জ সুবিধামধ্যপ্রাচ্যে ভাষা না জানার খেসারত দিচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট করাই পুলিশের ‘মাথাব্যথা’

জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষের অনুভূতি আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. আব্দুল বায়েস: আমি সম্প্রতি উবারে চলাচল করেছি, চালকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে—ঘুস দেওয়া এখনো বড় সমস্যা। এটা শুধু আজকের নয়, বহু প্রজন্ম ধরে চলমান একটি ব্যাধি। নতুন দলগুলোর প্রতি মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির কারণে সেই সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে—পুরোনো বোতলে নতুন মদ। দেশে এখন গভীর অনিশ্চয়তা চলছে, যা অতীতে কখনো এত তীব্র ছিল না। বিনিয়োগকারীরা জানে না আগামীকাল কী হবে, ফলে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই অনিশ্চয়তার একমাত্র উপায় হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। খারাপ নির্বাচনও নির্বাচন না থাকার চেয়ে ভালো। অন্তত একটি নির্বাচিত সরকার থাকলে মানুষ জানবে—পরবর্তী পাঁচ বছর কী হতে যাচ্ছে।

নতুন সরকার এমন এক সময়ে দায়িত্ব নেবে, যখন নির্বাচন নিয়েই ব্যাপক বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা থাকবে। এই অনিশ্চয়তাই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু

জাগো নিউজ: ব্যাংকগুলো এখন জোর দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে, কিন্তু বিনিয়োগ নেই—এটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

ড. আব্দুল বায়েস: খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমানত নিলে সুদ দিতে হয়। কিন্তু সেই টাকা বিনিয়োগ করা না গেলে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়ে। দুর্বল ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে আমানত নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হতে পারে। মানুষ এখন সঞ্চয় করছে না, বরং ডি-সেভিং করছে—সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এ অবস্থায় টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

জাগো নিউজ: নতুন বছরে দেশের ব্যাংকখাতকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. আব্দুল বায়েস: নতুন বছরে দেশের ব্যাংকখাত একাধিক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার। সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর মতো দুর্বল ব্যাংকগুলোর কারণে এ আস্থার সংকট আরও গভীর হয়েছে। চলমান ব্যাংকখাত সংস্কার আদৌ ব্যাংকখাতকে আবার স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না, তা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক সরকার এলেও সংকট কাটবে কি না—তা নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। খেলাপি ঋণ ইতোমধ্যে প্রত্যাশার সীমা ছাড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনিয়োগে স্থবিরতা। ব্যাংকগুলোর নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমে গেছে।

জাগো নিউজ: নতুন সরকার এলেই কি দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে?

ড. আব্দুল বায়েস: নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেই পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ সম্ভব—এমন আশা বাস্তবসম্মত নয়। প্রথমেই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আসন্ন নির্বাচন সহজ হবে না, ক্ষমতায় যাওয়ার পথও মসৃণ হবে না। এর মধ্যেই অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে। বর্তমানে কেবল প্রবাসী আয়ের সহায়তায় অর্থনীতি কোনোভাবে টিকে আছে—যেন ভেন্টিলেশনে রাখা রোগী।

মানুষ আতঙ্কে রয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সাহস পাচ্ছে না। রাজনৈতিক চাঁদাবাজির অভিযোগ আগের মতোই শোনা যাচ্ছে। অভিযোগ যদি একই থাকে, তাহলে পরিবর্তন কোথায়—সে প্রশ্ন থেকেই যায়

জাগো নিউজ: অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন?

ড. আব্দুল বায়েস: অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি—অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নিম্নমুখী। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, রেমিট্যান্সের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে; কিন্তু বিনিয়োগ ও ভোগ কম থাকায় এ রিজার্ভ কার্যকর চাহিদা তৈরি করতে পারছে না। ফলে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে।

জাগো নিউজ: নির্বাচন-পরবর্তী অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে?

ড. আব্দুল বায়েস: নতুন সরকার এমন এক সময়ে দায়িত্ব নেবে, যখন নির্বাচন নিয়েই ব্যাপক বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা থাকবে। এই অনিশ্চয়তাই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু। দুর্নীতি বা স্বৈরশাসন থাকলেও যদি মানুষ নিশ্চিত থাকে যে তার কাজকর্মে বাধা আসবে না, তাহলে অর্থনীতি চলতে পারে। কিন্তু অনিশ্চয়তা থাকলে কিছুই টেকে না।

জাগো নিউজ: ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ড. আব্দুল বায়েস: বর্তমানে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। মানুষ আতঙ্কে রয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সাহস পাচ্ছে না। রাজনৈতিক চাঁদাবাজির অভিযোগ আগের মতোই শোনা যাচ্ছে। অভিযোগ যদি একই থাকে, তাহলে পরিবর্তন কোথায়—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

জাগো নিউজ: খেলাপি ঋণের সংকট কেন আরও বাড়ছে?

ড. আব্দুল বায়েস: কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, বিনিয়োগ না থাকলে খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপি এক বিষয়, কিন্তু যারা ব্যবসা চালাতে না পেরে খেলাপি হচ্ছে, তাদের সংখ্যাই বাড়ছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, ফলে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও তৈরি হচ্ছে না।

ইএআর/এএসএ/এমএফএ/এএসএম