বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য অধিকার বড় চ্যালেঞ্জ
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক জটিল সময় পার করছে। বিনিয়োগ স্থবির, বেকারত্ব বাড়ছে, টাকার মান কমেছে, আর নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের চাপ বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক ধরনের মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও হতদরিদ্র মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও আগামী দিনের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তিনি দেশের অর্থনীতিকে ‘স্থবিরতা ও মূল্যস্ফীতির যুগল সংকট’ হিসেবে চিহ্নিত করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
জাগো নিউজ: দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম এম আকাশ: বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে তাকালে দুটি পরিস্থিতির দিকে আমাদের নজর পড়ে। একটা হচ্ছে মন্দা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। বিনিয়োগ কম, বেকারত্ব বাড়ছে, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। এগুলো সবই মন্দার লক্ষণ। আরেকটা দিক চোখে পড়ে সেটা হলো মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে না ঠিক আছে, কিন্তু মূল বৃদ্ধির যে হার বা জিনিসপত্রের দামের যে সূচক, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য, এক সময় ভোগ্যপণ্যের সূচক প্রায় ৯ শতাংশের হারে বাড়ছিল, সেটা কিছুটা কমেছে বলে কেউ কেউ। ফলে কিছুটা কমেছে, কিন্তু আমার ধারণা ৯ শতাংশেই এটা স্থির হয়ে আছে। আমাদের অতীতে যে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হতো সাধারণত, ৯ শতাংশটা তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। সুতরাং, আমি বলবো যে এক ধরনের মূল্যস্ফীতিও আছে।
আমার ধারণা বিনিয়োগ কিছুটা আস্তে আস্তে ফিরবে। প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা আস্তে আস্তে বাড়বে। বৈদেশিক বিনিয়োগও আসবে, স্থানীয় বিনিয়োগও বাড়বে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন
আরও পড়ুন
বিশ্ববাজারে আরও কমবে চালের দাম, ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যে কঠোর ব্যবস্থা
অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে টিকে থাকার জ্ঞান ও কৌশল
২০২৫ সালে যে ঝুঁকি আছে বিশ্ব অর্থনীতিতে
আরেকটা জিনিস আমরা দেখতে পাচ্ছি- টাকার মান একটা জায়গায়, মানে অনেক কমে গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় আগে ছিল ৮০ টাকার মতো, এখন এটা ১২১-১২২ টাকায় গিয়ে আটকে আছে। এখন এই জিনিসগুলো থেকে আমি অর্থনীতির সার্বিক অবস্থাকে বলবো যে অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশন (মন্দাস্ফীতি) চলছে। স্ট্যাগনেশন অ্যান্ড ইনফ্লাশন যেটাকে একত্রে বলে মন্দাস্ফীতি। এখন এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। যদিও নীতিতে তা প্রায় অসাধ্য- কারণ মন্দা ঠেকাতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে, আর মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে মন্দা বেড়ে যেতে পারে।
জাগো নিউজ: এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় কী?
এম এম আকাশ: এটা থেকে রক্ষার জন্য যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাকে টুকটাক সংস্কার নয়, তাকে মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের কাজ করতে হবে। একটা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে সব অর্থনৈতিক খেলোয়াড়দের জন্য ন্যায্য ও স্বচ্ছ নিয়মের বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। বিনিয়োগের অনুকূল আবহাওয়া তৈরি করা এবং দেশি পুঁজিপতিদের (বিশেষত, ছোট ও মাঝারিদের) উদ্বুদ্ধ করা যে আমরা ক্ষমতায় এসেছি, অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ম-কানুনে এখন স্থীতিশীলতা আসবে, কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এখন মিলিটারি বা অন্তর্বর্তী সরকার বা মব দিয়ে নানা রকম হইচই, আজ রাস্তাঘাট এখানে বন্ধ, কাল ওখানে বন্ধ, কলকারখানা বন্ধ, এ ওর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে- এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং, এখন আপনারা বিনিয়োগ করবেন। এই জিনিসটা আমি মনে করি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা অনেকটা নির্ভর করবে আগামীতে নির্বাচনটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয় কি না এবং একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন থেকে একটা মোটামুটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে কি না তার ওপর।
জাগো নিউজ: বিনিয়োগ বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কি?
এম এম আকাশ: আমার ধারণা বিনিয়োগ কিছুটা আস্তে আস্তে ফিরবে। প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা আস্তে আস্তে বাড়বে। বৈদেশিক বিনিয়োগও আসবে, স্থানীয় বিনিয়োগও বাড়বে। তবে মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন। কারণ, মূল্যস্ফীতিটা বাজারে যারা সিন্ডিকেট আছে তাদের ভেঙে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর পুরোপুরি তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, আমদানি করা জিনিসের দাম, ফসিল ফুয়েলের দাম এগুলো তো সব সময় বেশি থাকবে। কারণ আমাদের তো টাকার মান কমে গেছে, দ্রুত তা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটা শুধু মনিটরি পলিসি দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। এজন্য যেটা করতে হবে, উৎপাদকদের জন্য সব রকম প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। সেটার পাশাপাশি আপৎকালীন সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে
জাগো নিউজ: মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?
এম এম আকাশ: মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটা শুধু মনিটরি পলিসি দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। এজন্য যেটা করতে হবে, উৎপাদকদের জন্য সব রকম প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। সেটার পাশাপাশি আপৎকালীন সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, যারা মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে নিচে চলে যাচ্ছে এবং হতদরিদ্র হয়ে গেছে, এমনকি খাদ্যের কষ্টে ভুগছে তাদের জন্য ইউনিভার্সাল (সর্বজনীন) খাদ্য অধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা রেশনের মাধ্যমেই হোক বা ১৫ দিন পর পর একটা খাদ্য প্যাকেজ হিসেবেই হোক এটা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমার ধারণা অন্তত ২০ শতাংশ লোকের জন্য এটার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি আমরা ধরি ১৮ কোটি লোক, তাহলে তার ২০ শতাংশ তিন কোটি। তিন কোটি না হলেও একদম হতদরিদ্র যারা দুই কোটি লোক, তাদের জন্য এই ব্যবস্থাটা করতে হবে।
জাগো নিউজ: কাজের বিনিময়ে নাকি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ ধরনের কর্মসূচি নেওয়া উচিত?
এম এম আকাশ: প্রথমত ওই দুই কোটি লোক এমন ক্ষুধার্ত যে তাদের কাজ করার সামর্থ্য হয় তো নেই। তাদের জন্য এটা সামাজিক সুরক্ষার অধিকার, এক ধরনের মানবাধিকার এভাবেই নিতে হবে। আইন করে এটা করতে হবে, যেমন ভারতে আছে। ভারতে কিন্তু এই আইনটা আছে যে যাদের রাইট টু ফুড দেওয়া আছে, তারা যদি রাষ্ট্র থেকে বা কোনোখান থেকে খাবার না পায় তাহলে তারা আদালতে গিয়ে মামলা করতে পারে।
জাগো নিউজ: তার মানে রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদ্যের নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করতে হবে?
এম এম আকাশ: অন্তত ওই দুই কোটির জন্য। বাকিরা হয়তো কষ্ট করে বাজার থেকে প্রতিযোগিতা করে আয় করে নিজের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারবে। ওই দুই কোটির খাদ্য না হলে ওদের আয়ু কমতে থাকবে, অর্ধভুক্ত থাকবে। পুকুরে একটা সামান্য ঢেউ হলে যেমন গুঁড়ি পানা ডুবে যায়, সে রকম ওরাও তলিয়ে যাবে।
জাগো নিউজ: নতুন বছর ২০২৬ সালে অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ কী দেখছেন?
এম এম আকাশ: বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকছে। আর একটা হলো খাদ্য অধিকার। সর্বজনীন খাদ্য অধিকারটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে। অর্থাৎ, আগামী বছর বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য অধিকার বড় চ্যালেঞ্জ।
বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকছে। আর একটা হলো খাদ্য অধিকার। সর্বজনীন খাদ্য অধিকারটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে। অর্থাৎ, আগামী বছর বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য অধিকার বড় চ্যালেঞ্জ
জাগো নিউজ: আগামী বছরের সুযোগ বা সম্ভাবনাগুলা কী কী আছে?
এম এম আকাশ: সম্ভাবনা বা সুযোগ হচ্ছে, যেহেতু ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন সুতরাং আপনার জিনিসপত্রের বাজার তৈরি হয়েছে। কারণ আপনার যেটা ৮০ টাকা ছিল, তখন সেটারই দাম এক ডলার ছিল। এখন ১২২ টাকার জিনিস আপনি এক ডলারে বিক্রি করছেন। আপনার জিনিসের দাম ডলারে যারা কেনে অর্থাৎ বিদেশিরা তাদের কাছে এটার দাম কমে যায়। সুতরাং, প্রতিযোগিতায় আপনি হয়তো বাড়তে পারেন। কিন্তু অন্যদের আবার প্রযুক্তি ভালো হওয়ায় ওদের উৎপাদনশীলতা বেশি ও উৎপাদন খরচ কম। আর আমরা শুধু ডলারের সুবিধাটা পাবো। কিন্তু প্রযুক্তির সুবিধাটা যদি যুক্ত করতে পারি তাহলে পুরো সুবিধাটাই পেতাম।
জাগো নিউজ: ডলারের দাম বেশি হলে তো আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এম এম আকাশ: হ্যাঁ, আমদানিকারকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমাদের এখানে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং মূল্যস্ফীতিটাও বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা তো কিছু করতে পারবো না, কারণ ডলারের সঙ্গে আমাদের টাকার মানটা তো নির্ভর করবে- আমরা ১২২ টাকায় কী পরিমাণ জিনিস তৈরি করি, আর ওরা এক ডলারে কী পরিমাণ জিনিস তৈরি করে তার ওপর। বাস্তবে ওদের উৎপাদনশীলতা আমাদের চেয়ে বেশি, ওদের মুদ্রার দাম বেশি। এজন্যই আমি বললাম যে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারলে আপনার দুটি সুবিধাই পাবে।
এমএএস/এএসএ/এমএফএ/এমএস